এক মহাজীবনের ছোটগল্প
আস্থা-বিশ্বাস-ভক্তি ভারততীর্থের প্রতি প্রশ্বাসে প্রবাহিত। জড়ে-জীবে, বস্তুতে-কল্পনায় সর্বত্রই ইষ্টদর্শন সম্ভব আমাদের এ’দেশে। এখানে মানুষ দেবত্বপ্রাপ্ত হন, আবার দেবতা হন ঘরের ছেলেটি। আত্মা-পরমাত্মার অভেদ কল্পনা এতই সহজ এখানে। আজ থেকে পাঁচ শতক আগে ঠিক এমন করেই একজন মানুষ হয়ে উঠেছিলেন ভগবানের স্বরূপ। যদিও ‘নদীয়ার চাঁদ’ বিশ্বম্ভর থেকে শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য হয়ে ওঠার পথে এসেছিল সহস্র বাধা। কিন্তু শাস্ত্রের শত শস্ত্রকে সেদিন পরাস্ত করেছিল প্রেম-ভক্তিবাদের এক স্বতঃস্ফূর্ত প্রবাহ। আর এই বিচিত্র আন্দোলনের মুখ হয়ে উঠেছিলেন - অঙ্গে কৃষ্ণ-কান্তি; অন্তরে রাধা-রাগ বিশিষ্ট সেই অনন্য ব্যক্তিত্ব। অল্পকালের মধ্যেই বৃহৎ ভক্তি আন্দোলনের নেতা থেকে জনসাধারণের দৃষ্টিতে তিনি হয়ে উঠেছিলেন স্বয়ং ঈশ্বর। আর সেই থেকে একাধারে মানুষ, অন্যদিকে ভগবান - এই দুই সত্তাকে আজও বয়ে চলেছেন তিনি। বিবিধ জীবনী, জনশ্রুতি, গবেষণার মতে-মতান্তরে তাই চৈতন্যের ‘অন্ত্যলীলা’ অধ্যায়টি আজও গভীর কুয়াশাচ্ছন্ন।
এই বিতর্কিত অধ্যায়ের মূল দু’টি ধারা – ভক্তিবাদ আর যুক্তিবাদ। ভক্তিবাদীরা চৈতন্যকে বসিয়েছেন ঈশ্বরের আসনে। ফলে সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাঁর যত মিল, তা সবই ‘লীলা’ বলে দেগে দেওয়ার একটা প্রবণতা তাঁদের মধ্যে দেখা যায়। আর এই মহাজীবনের অন্তিম পরিণতি বিষয়ে হয় তাঁরা মুখে কুলুপ এঁটেছেন, নয়তো অঙ্গুলিনির্দেশ করেছেন দেববিগ্রহে বিলীন হয়ে যাওয়ার মতো কিছু কষ্টকল্পিত অলীক কাহিনির দিকে। কারণ ভক্তের বিশ্বাসে ভগবানের মৃত্যু নেই। ভাবতে অবাক লাগে যুগ যুগ ধরে তাঁরাই এমন মত প্রচার করে আসছেন যাঁদের এক দেবতার মৃত্যু হয়েছিল ব্যাধের শরাঘাতে আর একজন দেবতা ‘মর্ত্যমণ্ডলে দেহ বহি দেবতা হইলে মরই’ নীতি অনুসরণ করে জন্ম-মৃত্যু-পুনর্জন্মের উদাহরণ দিয়ে চলেছেন প্রতি ‘নবকলেবর’-এ। সুতরাং ভক্তিবাদের পথে যে চৈতন্য অন্তর্ধান রহস্যের সমাধান অসম্ভব তা বলাই বাহুল্য।
অন্যদিকে ইতিহাসের পাতা খুঁড়ে, কিছু প্রমাণ ও কিছু যুক্তিনিষ্ঠ অনুমানের উপর ভিত্তি করে আজও চলছে এই রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা। আর সেই গবেষণায় যাঁরা নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন তাঁদের মধ্যেই অন্যতম ছিলেন ড. জয়দেব মুখোপাধ্যায়। ‘কাঁহা গেলে তোমা পাই’ সেই বিশাল গবেষণার সামান্য আভাসমাত্র দেয়। ড. মুখোপাধ্যায় চাননি তথ্যভারে ন্যুব্জ কোনো নিরস গবেষণাগ্রন্থ রচনা করতে। তাই সরস উপন্যাসের আঙ্গিকে গড়েছেন এই গ্রন্থের আখ্যানভাগ। চৈতন্য অন্তর্ধান কেন্দ্রিক নানা সম্ভাবনা, মতামত ও যুক্তির চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন সাবলীল গল্পের ছলে। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বিশ্বাস, নানা গবেষকের সিদ্ধান্তকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্থান দিয়েও তিনি যুক্তি-প্রতিযুক্তির মাধ্যমে একটি সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে চাইছিলেন। বাকি সব তত্ত্বকে ক্রমশ ম্লান করে গুপ্তহত্যার তত্ত্বটিই প্রকট হয়ে উঠছিল ধীরে ধীরে। তাঁর আরও কিছু প্রমাণ প্রয়োজন ছিল অন্তিম সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার জন্য। এমন সময় আচমকা শেষ হয়ে যায় এই ‘গল্প’।
একদিকে যেমন জগন্নাথের চেয়ে চৈতন্যের প্রভাব বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ভীত করে তুলেছিল পুরীর পাণ্ডাদের তেমনই অন্যদিকে জাতি-বর্ণভেদ ব্যবস্থাকে ফুৎকারে উড়িয়ে প্রেমধর্ম প্রচারের জন্য উচ্চবর্ণীয় হিন্দুদের বিরাগভাজন হয়েছিলেন তিনি – হত্যার এই মোটিফগুলি প্রবলভাবে স্পষ্ট হতে থাকে আর খারিজ হতে থাকে অদ্বৈতাচার্যের সাংকেতিক পত্রে লেখা আন্দোলন প্রত্যাহারের পরামর্শ এবং চৈতন্যের স্বেচ্ছা অন্তর্ধানের মতো তত্ত্বগুলি। হয়তো এক মর্মান্তিক সত্যের উপর থেকে বহু শতাব্দী লালিত মিথ্যার পর্দা উঠতে চলেছিল এই গ্রন্থের পরবর্তী খণ্ডে, যা আর হয়নি। দ্বিতীয় খণ্ডের পাণ্ডুলিপি প্রকাশকের দফতরে পৌঁছানোর আগেই ১৯৯৫ সালের ১৭ই এপ্রিল পুরীর আনন্দময়ী আশ্রমের চৌবাচ্চায় মেলে ড. মুখোপাধ্যায়ের অর্ধনিমজ্জিত মৃতদেহ। অজ্ঞাত কারণে এই তদন্তও থেমে যায় মাঝপথে। আর একটি জীবনের সঙ্গেই শেষ হয়ে যায় সত্য উন্মোচনের বহু আশা। জয়দেববাবু লিখতে চেয়েছিলেন এমন একটি উপন্যাস যা সত্যকে উন্মুক্ত করবে কিন্তু তা শেষ হয়ে যায় বহু সম্ভাবনাময় এক অসমাপ্ত ছোটগল্পের মতো। কিন্তু বিপুল জনপ্রিয় বইটি পাঠকের মনে জাগিয়ে তোলে অসংখ্য প্রশ্ন। বহুকালের অনালোচিত বিষয়কে জনসাধারণের চর্চার বিষয় করে তুলে এই বইটি যে সাজানো মিথ্যার প্রকাণ্ড কপাটে সজোরে আঘাত হেনেছে তা লেখকের অস্বাভাবিক মৃত্যুতেই একপ্রকার নিশ্চিত হয়ে গিয়েছে। এবার আশা, এই আঘাত প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে একদিন সকলের ‘চৈতন্য’ উদিত করবে।