খেলা

একটি ঐতিহাসিক জয় এবং ‘টিম ভারতবর্ষের’ গল্প

অর্পণ দাস Jan 20, 2021 at 8:16 am খেলা

একটা ভারতবর্ষ—যার সর্বাঙ্গে আধুনিক সভ্যতার রঙচঙে সাজ। তার গায়ে নীল-কালো-হলুদ জার্সি, মুখে রঙ। তার ব্যাকগ্রাউন্ডে চলে একটা মাথামুণ্ডুহীন বলিউডি সিনেমা আর দুর্গাপূজা-দিওয়ালির নাচ। বিনোদন ছাড়া তার পাওয়ার কিছু নেই, হারানোর তো কিছু নেইই। যেমন একটা আইপিএল টুর্নামেন্ট। ক্ষণিক উত্তেজনা আর প্রমোদের দুকূল ভাসানো স্রোতে মশগুল ভারতবর্ষ। আর একটা ভারতবর্ষ—লড়ছে, পড়ছে, মার খাচ্ছে। আর অনবরত চেষ্টা করছে জিতে যাওয়ার। তাকে সামলাতে হচ্ছে সমাজের বিষ মেখানো বাউন্স, রাজনীতির স্লেজিং, ব্যক্তিজীবনের চোট-আঘাত। সবাই ধরেই রেখেছে, এ তো হেরেই যাবে। আর সেই ভারতবর্ষ জানে তাকে লড়ে যেতে হবে। প্রত্যেকটা দিনে, প্রত্যেকটা ইনিংসে, প্রত্যেকটা বলে।

সেই ভারতবর্ষ জিতেছে। রোজকার জীবনের জায়গায় আজ খেলাটার নাম ক্রিকেট। অষ্ট্রেলিয়ার মাটিতে গিয়ে তাদেরকে ২-১-এ হারিয়ে বর্ডার-গাভাসকার টেস্ট সিরিজ আরও একবার জিতে নিল ভারত। কে বিশ্বাস করেছিল যে টিমটা সিরিজের প্রথম টেস্টে ৩৬ রানে শেষ হয়ে গিয়েছিল, সেই টিমটা এভাবে সিরিজে ফিরে আসতে পারবে? অনেক ক্রিকেট পণ্ডিতই তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে জানিয়েছিলেন ‘ওয়াইট ওয়াশ’ বা ‘ব্রাউন ওয়াশ’ তো নেহাত সময়ের অপেক্ষা। তার উপর আবার টিমের অধিনায়ক এবং সেরা ব্যাটসম্যান বিরাট কোহলি পিতৃত্বকালীন ছুটিতে। আর পরীক্ষা তো শুধু মাঠে নয়। মাঠের বাইরেও। অস্ট্রেলীয় দর্শকদের একটা অংশ থেকে উড়ে আসতে শুরু করেছে বর্ণবিদ্বেষী আক্রমণ। করোনা পরিস্থিতির জন্য কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে ভারতীয় খেলোয়ারদের গতিবিধির উপর। অস্ট্রেলিয়ান মিডিয়াও ক্রমাগত বিতর্ক উস্কে চাপে রাখছে ক্রিকেটারদের। চোট-আঘাতে জর্জরিত হয়ে একের পর এক ছিটকে গেছে প্রথম দলের খেলোয়াড়রা। ফলে অজিঙ্ক রাহানের নেতৃত্বে ব্রিসবেনের গাব্বায় যে টিমটা এদিন জাতীয় সঙ্গীত গাইল তাদের তো ইন্ডিয়া ‘বি’ টিম বললেও কম বলা হয়। ভারতের বোলিং বিভাগের দায়িত্ব এসে পড়ল যাঁদের উপর, সেই মহম্মদ সিরাজ, শার্দূল ঠাকুর, নবদীপ সাইনি, ওয়াশিংটন সুন্দর আর টি নজরাজনদের মোট টেস্ট ম্যাচের সংখ্যা দু-হাতের মোট আঙুলের থেকেও কম। উলটো দিকে ‘ফিরে আসা’ স্টিভ স্মিথ, ডেভিড ওয়ার্নার। উলটো দিকে প্যাট কামিন্স, মিচেল স্টার্ক, হেজেলউড, নাথান লিঁও-র নিয়ে সাজানো বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বোলিং আক্রমণ।

কিন্তু তাতে কী? এটাও তো ‘টিম ইন্ডিয়া’! ফের একবার যার প্রমাণ দিয়ে গেল ওয়াশিংটন সুন্দর আর শার্দূল ঠাকুররা। দ্বিতীয় ইনিংসে ভারতের ব্যাটিং যখন প্রায় ধ্বসে পড়েছে, সেখান থেকে পালটা আঘাত ফিরিয়ে দিল তারা। যার ফলে চতুর্থ ইনিংসে পঞ্চম দিনে ভারতের জেতার জন্য প্রয়োজন রইল ৩২৪ রান, হাতে ১০ উইকেট। অস্ট্রেলিয়া দল দিন শুরুই করল তাদের চিরাচরিত আগ্রাসন দিয়ে। একের পর এক বাউন্সার আছড়ে পড়তে চেতেশ্বর পূজারার সারা শরীরে। যেন মনে হলো ‘বডিলাইন সিরিজ’ ফিরে আসছে। কিন্তু তার বিপরীতেই শুভমন গিলের ৯১ রানের ইনিংসটা ততক্ষণে সেই বিখ্যাত অস্ট্রেলীয় মানসিকতার কোমর ভেঙে দিতে শুরু করেছে। আর তারপর একসময়ে শুরু হলো ঋষভ পন্থের তাণ্ডব। প্রতি ঘন্টায় ১৪০ কিমি বেগে আসতে থাকা বাউন্সারগুলোকে অনায়াসে সে ফেলতে লাগলো মাঠের বাইরে। তিন ওভার বাকি থাকতেই চলে এলো প্রতীক্ষিত জয়। ৩২ বছর পর গাব্বায় কোনো টেস্ট ম্যাচ হারল অস্ট্রেলিয়া। ব্রিসবেনের মাটিতে তে-রঙা পতাকা ওড়াল ‘টিম ইন্ডিয়া’।

কিন্তু এ কোন ‘টিম ইন্ডিয়া’? অধিনায়ক অজিঙ্ক রাহানে ট্রফিটা তুলে দিলেন যে টি. নটরাজনের হাতে, তার তো সব বিভাগের ক্রিকেটেই অভিষেক ঘটল অস্ট্রেলিয়ায় এসে। অজিঙ্ক রাহানে নিজেই তো ‘ভারপ্রাপ্ত’ অধিনায়ক! যে চেতেশ্বর পূজারা সারাদিন ধরে নীলকণ্ঠের মতো গ্রহণ করে নিলেন সমস্ত বাউন্সারগুলোকে, তাঁকেও তো কয়েকদিন আগে সমালোচনা শুনতে হচ্ছিল তাঁর স্ট্রাইক রেটের জন্য। এই যে ঋষভ পন্থ নামের দুরন্ত বাচ্চাটা, কিছুদিন আগে পর্যন্ত তাঁর ভাবমূর্তিই হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাঁর সবচেয়ে বড়ো শত্রু। আর একজন মহম্মদ সিরাজ। সিরিজের শুরুতে বাবার মৃত্যুসংবাদেও যে ছেলেটা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল, তাকেই দেখলাম জাতীয় সঙ্গীতের সময় চোখের জল মুছতে। কীভাবে ভুলব তৃতীয় টেস্টে রবিচন্দ্রন অশ্বিনের কোমরের চোট আর হনুমা বিহারীর হ্যামস্ট্রিং-এ টান নিয়ে ম্যাচ বাঁচানো ইনিংসটাও। সেদিন রবীন্দ্র জাদেজা ভাঙা হাত নিয়েও কিন্তু অপেক্ষায় ছিলেন ব্যাট করার জন্য। ভারতবর্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানালেন বিরাট কোহলি; যিনি গত কয়েকবছর ধরে দলের মজ্জায় ঢুকিয়ে দিয়েছেন এই সর্বগ্রাসী জেতার আগুনটাকে। যার শুরু করেছিলেন যে বাঙালি ভদ্রলোক, ঘটনাচক্রে সেই সৌরভ গাঙ্গুলি আজ বিসিসিআই প্রধান। ব্যাঙ্গালোর ক্রিকেট আকাদেমিতে বসে হয়তো রাহুল দ্রাবিড় তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে হেসে ফের কোনো উঠতি খেলোয়াড়ের ভুলত্রুটি ঠিক করে দিলেন। যিনি প্রচারের আলো থেকে আলোকবর্ষ দূরে বসে ঘষেমেজে তৈরি করে চলেছেন নতুন কোনো শুভমন গিল, ওয়াশিংটন সুন্দর, ঋষভ পন্থ-দের। 

আরও পড়ুন : মজার ক্রিকেট, ক্রিকেটের মজা / সুদেব বোস  

তাই এই জয়টা শুধু সাদা জার্সি পরা এগারো জনের নয়। এই জয়টা তার পিছনে জমতে থাকা দীর্ঘ লড়াইয়ের ইতিহাসের শেষ পাতাটা মাত্র। এই জয়টা আইপিএল নামক এক ক্রিকেট প্রতিযোগিতারও। যাকে আমরা দেখেছি নিছক বিনোদন নামে; আর কোনো উঠতি যুবক দেখেছে বিশ্বের সেরা বোলারদের বাউন্ডারির ওপারে ছুঁড়ে ফেলার মঞ্চ হিসেবে। সে সারারাত জুড়ে উত্তাল পার্টি করেছে, আবার পরদিন ফিরে এসেছে তিনদিক ঘেরা নেটে। তারপর একদিন তাকে ছুড়ে দেওয়া হয়েছে অস্ট্রেলিয়ায় বা ইংল্যান্ডে। যেখানে মুখ লক্ষ্য করে আসা গনগনে বাউন্সের সামনে তাকে ধ্যানস্থ হতে হবে। ব্যাটের মাঝখানে লেখা থাকবে প্রত্যেকটা স্লেজিং-এর জবাব। মাটি কামড়ে পড়ে থেকে চলবে মধ্যবিত্তের দিন বাঁচানোর লড়াই। এই সবটা নিয়েই আমাদের ‘টিম ইন্ডিয়া’। এই সবটা নিয়েই আমাদের ভারতবর্ষ। সে শুধু স্বপ্ন দেখে একটা বিশ্বকাপের। একটা টেস্ট সিরিজ জয়ের—যেখানে সে দুমড়ে-মুচড়ে দিতে পারে তার সমস্ত প্রতিবন্ধকতাকে। এই জয়টা আমাদের সেই ভারতবর্ষের, যার শেষ পাতায় কখনই জিতে যাওয়া মানুষের গল্পটা লেখা হয় না। সেই অসমাপ্ত বইটা লেখা শেষ করে সে শুধু গুনগুন করে ওঠে একটা গান—‘মউলা মেরে লে লে মেরি জান’।

...........................................

[ছবি : গেটি ইমেজেস] 


#India #Team India #India Vs Australia #Test Series #Border-Gavaskar Trophy #Australia #Ajinkya Rahane #Risabh Pant #Cheteshwar Pujara #Mohammed Siraj #Shardul Thakur #Washington Sundar #ভারত #টেস্ট সিরিজ #অস্ট্রেলিয়া #অর্পণ দাস #সিলি পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

5

Unique Visitors

219107