বিবিধ

অন্তর্বাস বিষয়ে ব্যক্তিগত দু-চার কথা

পথিক মিত্র Sep 11, 2022 at 8:33 am বিবিধ

বিগত বেশ কিছুদিন থেকেই ব্রা-স্ট্র্যাপ বিতর্ক শুরু হয় গেছে সোশাল মিডিয়াতে। আসলে ছাপোষা মফঃস্বলের মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হওয়া মানুষজন স্বাভাবিক নিয়মেই এই সব বিতর্ক এড়িয়ে যায়। কিন্তু আলোচনা না হওয়ার দরুণ মনের ভিতর নিজের অজান্তেই একটা ধারণা তৈরি হয়ে যায়, যেটা অভ্যেসে পরিণত হতে বিশেষ সময় নেয় না।

ছোটবেলায় একটা কথা শুনতাম 'লারেলাপ্পা হিন্দি ছবি'! আমি আজ অবধি জানি না এই কথাটির আসল অর্থ কী। হিন্দি ছবিতে নাচ-গান ও স্বল্পবাস নারীদের দেখা যায় আর তাতেই আমাদের গ্লোরিয়াস সংস্কৃতি খতরে মে - এরকম একটা ভার্সন বিকেলে রকে বসে খেজুর করা রিটায়ার্ড জেঠুদের থেকে শুনেছি বটে। তবে মজার বিষয় হল, শুধু পোশাক, এমনকি অন্তর্বাসের ভিসিবিলিটিও আমাদের ভারতীয় সংস্কৃতি মাপকাঠি হয়ে দাঁড়িয়েছে আজ। কী অদ্ভুত ভাবুন তো, প্রকাশ্যে শুধু গামছা পরিহিত পুরুষদের দেখলে আমাদের ভাবাবেগে আঘাত লাগে না, কিন্তু পাশের বাড়ির বুল্টির ব্রা-স্ট্র্যাপ দেখা গেলেই তার চোদ্দোগুষ্টির কালচারের উপর ভালচারের আক্রমণ শুরু হবে। যেটা আমরা না বুঝেই করছি বা বুঝেই সেয়ানাগিরি করছি - সেটা হলো এই যে মহিলাদের অন্তর্বাসকেও আমরা পুরুষতান্ত্রিক অবজেক্টিফিকেশনের অঙ্গ বানিয়ে ফেলেছি। একাধারে সেটা যৌনতার বা যৌন সুড়সুড়ির প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে অন্য ধারে সেটা আবার ভদ্রতা ও শিষ্টাচারের পরিমাপক। সে কারণে লোকচক্ষুর সামনে অন্তর্বাস পরিহিতা নারী নয়, স্রেফ ওই পোশাকটাই যৌন উস্কানির প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই মানসিকতার ব্যবসায়িক ফায়দা তুলছে বহু সংস্থা। তাই 'লজাঁরি' বা সেই রকতুতো জ্যেঠুদের ভাষায় 'লিঙ্গারি' বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে তার ব্যবহারিক গুণাগুণকে ছাপিয়ে যাচ্ছে যৌন আবেদন। চরা দামে বিক্রি হচ্ছে হানিমুন স্পেশাল। আর পুরুষ, নারী নির্বিশেষে সকলে এই পুরুষতান্ত্রিক ফাঁদে পা দিচ্ছে। এক্ষেত্রে জানিয়ে রাখা ভালো যে ১৯২২ সাল থেকেই অন্তর্বাসকে এই ফরাসি নামে ডাকার রেওয়াজ শুরু হয়। এই শব্দটার আক্ষরিক অর্থ "Things made of linen "! অর্থাৎ এই তথাকথিত নিষিদ্ধ শব্দটার আদি অর্থের সাথে যৌন আবেদনের দূরদূরান্তেও কোনো সম্পর্ক নেই। যদিও উইকিপিডিয়ার মতে বর্তমানে এই শব্দের মানের সাথে একটা Erotic sense যোগ হয়েছে।


অতএব মানতেই হবে যে, পুরুষদের অন্তর্বাসকে পিছনে ফেলে, মহিলাদের অন্তর্বাস একটা taboo-র জায়গা নিয়ে নিয়েছে, যা নিয়ে নিষিদ্ধ চুটকি, গুজগুজ-ফিসফিস হতে পারে কিন্তু খোলা আলোচনা কভি নেহি। ছেঁড়া স্যান্ডো আর লুঙ্গি পরিহিত কাকা চায়ের দোকানে বসে অনায়াসে ব্রা-স্ট্র্যাপ নিয়ে বর্তমান প্রজন্মের মুণ্ডুপাত করতেই পারেন। এমন কি গরমের তাড়নায় গেঞ্জিটাকে ব্লাউজের কায়দায় ভুঁড়ি উপর তুলে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির কুপ্রভাবের উপর একটা থিসিস অবধি লিখতে পারেন। কিন্তু মহিলাদের কারও স্ট্র্যাপ উঁকি দিলেই তুলকালাম । এই সামান্য পুঁচকে পোশাকটা কারুর কাছে যৌন সুড়সুড়ি, কারুর কাছে নারীবাদী প্রতিবাদের প্রতীক, তো কারুর কাছে ভারতীয় সংস্কৃতির স্খলন।


যে ঘটনাটা বলব বলে এত ভূমিকা, সেটা খুব সাধারণ। কিন্তু তার তাৎপর্য নেহাত কম না। চাকরির প্রথম অধ্যায়ে আমি পুনেতে একটি আউটহাউসে ভাড়া থাকতাম । আউটহাউজগুলো ছিল গৃহস্বামীর বাগানে। মোট আটখানা ঘর। অফিসের তিন বন্ধু থাকতাম এক-একটি ঘরে । তাদের মধ্যে একজন ছিলেন মহিলা। এবার আমার ঠিক পাশের ঘরেই একজন জার্মান তরুণী ভাড়ায় থাকতে এলেন। বয়স ২২-২৩, ৬ ফুট লম্বা, সুশ্রী, ব্লন্ড। মফঃস্বলে বড় হওয়া আমাদের মনে এই ব্যাপারটা ভয়ানক চিত্তচাঞ্চল্য তৈরি করল। তাকে দেখেই অনেক আজেবাজে চিন্তা মাথায় দোকান খুলল। মহিলাদের স্বাভাবিক চোখে আমাদের দেখতে শেখানোই বা হয়েছে কবে।  হাফপ্যান্ট পরে প্রাতঃভ্রমণ সেরে এসে সে যখন আমাদের দেখে 'গুড মর্নিং' বলত, সত্যি এক অদ্ভুত মুগ্ধতা ছেয়ে যেত মনেপ্রাণে। ওদিকে আমাদের গৃহস্বামীর গৃহিণী ছিলেন একজন সংস্কৃতিপরায়ণ পঞ্জাবি ভদ্রমহিলা। তিনি এসব মোটেই বরদাস্ত করবেন না। তিনি ডেকে আগেভাগে সচেতন করে দিলেন জার্মান কন্যাকে। ফলে অচিরেই বিদায় নিল সকাল বেলার হাফপ্যান্ট-সম্বর্ধনা। অবশ্য দেখতে দেখতে তার সাথে বন্ধুত্বটা কিন্তু বেশ জমে উঠলো। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো তার নাম ছিল মারা।

পুনেতে বর্ষাকাল এমনিতে খুব মনোরম। কিন্তু বর্ষাকালের অবিরাম বর্ষণের কাব্যিক সৌন্দর্যটাকে অনুধাবন করতে আপনাকে একটি বহুতল ফ্ল্যাটের সুসজ্জিত ব্যালকনিতে বসতে হবে। তখন দেখবেন গরম কফি কাপে চুমুক দিয়ে বৃষ্টি দেখতে দারুণ লাগে। কিন্তু যখন দেখবেন টানা পাঁচদিন বৃষ্টির প্রকোপে জামা,গেঞ্জি,জাঙ্গিয়া কিছুই শুকোচ্ছে না, আর ঘরে রাখলেও ভ্যাপসা গন্ধ ছাড়ছে - তখন ব্যাচেলর জীবন অতিষ্ট হয়ে উঠবেই। আমাদের ঘরের সামনের টানা বারান্দায় তখন কাপড় মেলার একচিলতেও জায়গা নেই। কারণ আমাদের সামনের বারান্দায় একটা টিনের চাল ছিল। অন্য ধারের ঘরগুলোয় যারা থাকত তাদের তখন করুণ অবস্থা। কাপড় মেলবে কোথায়? এমত সময় এক বিকেলে মারা এসে বলল, সে আমার ঘরের সামনে কিছু কাপড় মেলার অনুমতি চায়। আমি আর বারণ করতে পারি? হাজার হোক বিদেশিনীর রিকোয়েস্ট, তাও ব্লন্ড। ফলে পরবর্তী কিছুদিন সে আমার ঘরের সামনে জামা কাপড় মেলল। জামা,প্যান্ট,অন্তর্বাস - সবাই পাশাপাশি গোধূলি বেলায় শুকোচ্ছে। এরই মধ্যে আমার ঘরে দুজন বন্ধু আসে। ঘরের বাইরের ঝুলন্ত সেক্স সিম্বলগুলো তাদের কাছে বড় আবেদনময় লাগে। তারা নেড়ে-ঘেঁটে দেখে আর পর্যাপ্ত হাসিঠাট্টা করে। ব্যাপারটা আমার কাছে খুবই নিম্নরুচির মনে হত। কিন্তু কী করব?  আমাদের সমাজটাই তো এক টুকরো অন্তর্বাসকে এক জলজ্যান্ত মানুষের যৌন চিত্র বানিয়ে দিয়েছে।

ঝামেলাটা বাঁধল এর পরে। আমার সেই দুই বন্ধুকে সে সময় দেখে ফেলেছিলেন গৃহকর্ত্রী আন্টি। ব্যাস, জরুরি তলব আমাদের। আমার তো লজ্জায় মাথা কাটা যায়। আমার বান্ধবীটিও চিন্তিত হয়ে বললো যে এই সমস্যা এড়াবার জন্য নাকি সে বারবার তার অন্তর্বাস টাওয়েলের তলায় ঢেকে শুকোতে দেয়। তার মা নাকি ছোট থেকে শিখিয়েছে। এসবের আমি কি জানি। একমাত্র ছেলে আমি। জামা কাপড় কেচে যে শুকোতে দিতে হয় সেটাই জেনেছি চাকরি সূত্রে বাইরে আসার পর। 

আমি তো দুরুদুরু বুকে হাজির হলাম। কিন্তু গিয়ে দেখি মারা মাথা নিচু করে দাড়িয়ে। ছলছলে চোখ। আমাকে দেখে মাথা নামিয়ে ক্ষমা চেয়ে বলল, "সরি"। আমি অবাক। আরও তাজ্জব ব্যাপার যে আন্টিও 'সরি' বললেন আমাকে। বললেন, "বেটা ওরা তো বিদেশি -  আমাদের সংস্কৃতির কিছু বোঝে না, না হলে কোনো পাগল পুরুষদের ঘরের সামনে ওইসব (অন্তর্বাস) মেলতে যায়?" 

অদ্ভুত ব্যাপার যে আমার সেই দুই বন্ধুর কৃতকর্মের কোনও উল্লেখই এল না আলোচনায়, এমনকি আমাকেও বিন্দুমাত্র কথা শুনতে হলো না। বেচারি মারা-কে যে কী পরিমাণ ভর্ৎসনা শুনতে হয়েছিল তার প্রমাণ ধরা পড়ছিল ওর চোখেমুখে। আমি বেরিয়ে এলাম। লজ্জায় আমার মাথা তখন মিশে যাচ্ছে মাটিতে। মারা-র সাথে চোখ মেলাতে পারছি না। আর দু-মাসের মাথায় মারা বার্লিন ফিরে যায়। আমাকে বেশ কয়েকবার 'সরি' বলেছিল সে। আর আমি আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলাম তাকে বোঝাতে যে এটা ভারতীয় সংস্কৃতি নয়। বোঝাতে পারিনি সম্ভবত। তাকে আমি 'সরি' বলেছিলাম।  

আন্টি ছিলেন সাধারণ ছাপোষা মানুষ - আমাদের মা, মাসিদের মতোই। শুনেছিলাম যৌবনে নাকি আঙ্কেল খুব রাগি ছিলেন। অযথা চেঁচামেচি, গালিগালাজ,এমন কি মারধর অবধি করতেন। আমাদের সামনেই চাকরদের মার খেতে দেখেছি বুড়োর হাতে। আন্টিও নাকি একসময় মারধোরের শিকার ছিলেন যৌবনে।

পরে একবার মনে প্রশ্ন জেগেছিল, জার্মান মেয়েটিকে সেদিন তিনি যে সহবতের পাঠ দিয়েছিলেন, তা কি তিনি নিজে বিবাহিত জীবনে ঠেকে শিখেছিলেন? কে জানে। 

"The answer my friend is blowing in the wind"। 

...........................

#lingerie #গদ্য #silly পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

20

Unique Visitors

219065