'রায়বাহাদুর' বিতর্ক ও বঙ্কিমচন্দ্র
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে চেনেন না, এমন বাঙালি কমই পাওয়া যাবে। কিন্তু বঙ্কিম যে ‘রায়বাহাদুর’ উপাধিও পেয়েছিলেন, কোনও এক অজানা কারণে এ তথ্য খুব বেশি প্রচারিত নয়। ১৮৯২ সালে তৎকালীন ইংরেজ সরকার তাঁকে 'রায়বাহাদুর' উপাধিতে ভূষিত করেন। মজার কথা, সমকালে এ ঘটনা প্রবল বিতর্কের আবহ তৈরি করেছিল।
ইংরেজ সরকার তো রায়বাহাদুর দিলেন, আর সদ্য-অবসরপ্রাপ্ত ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট বঙ্কিমচন্দ্র তা নিলেনও। কিন্তু কেচ্ছাপ্রিয় বাঙালি তো এত বড় পিএনপিসির খোরাক বিনা চর্চায় ছেড়ে দিতে পারে না। ছেড়ে দেয়ও নি। এই নিয়ে সেকালের পত্রপত্রিকায় বিস্তর লেখালিখি হয়। নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত ‘উপাধি উৎপাত’ নামে এক কড়া আর্টিকেল লেখেন। তা ছাপা হয় সুরেশচন্দ্র সমাজপতির ‘সাহিত্য’ পত্রিকার ১২৯৯ শ্রাবণ সংখ্যায়। নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত সেখানে লেখেন, “রায়বাহাদুর উপাধি দিয়া বঙ্কিমবাবুর প্রতি অবমাননা প্রকাশ করা হইল।" তাঁর মতে ইংরেজ সরকারের দেওয়া এই উপাধি অবশ্যই প্রত্যাখ্যান করা উচিত ছিল বঙ্কিমচন্দ্রের - “ইংরাজের কৌশলে তিনি স্বয়ং ধরা পড়িলেন।"
এ সমস্ত বাঁকা লেখালিখি বঙ্কিমের চোখ এড়ায় নি। পূর্বোক্ত প্রবন্ধটি ছাপানোর পরে ‘সাহিত্য’ পত্রিকার সম্পাদক সুরেশচন্দ্র সমাজপতি নাকি “একখানি বিশ্বস্ত পত্র প্রাপ্ত” হন। তিনি ‘সাহিত্য’ পত্রিকার ভাদ্র সংখ্যায় নিজেই এই নিয়ে ‘উপাধি উৎপাতের বঙ্কিমবাবু’ নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। তাতে লেখেন, সেই ‘বিশ্বস্ত’ পত্র পড়ে তিনি নাকি জেনেছেন - “ নিজ উপাধির প্রার্থী হওয়া দূরে থাক,গেজেটে উপাধির তালিকা মুদ্রিত হইবার পূর্বে,শ্রদ্ধাস্পদ বঙ্কিমবাবু এ সম্বন্ধে বিন্দুবিসর্গও জানিতে পারেন নাই।” এখন এই ‘বিশ্বস্ত পত্র’টি বেনামে বঙ্কিম নিজেই লিখেছিলেন নাকি তাঁর কাছের কাউকে দিয়ে লিখিয়েছিলেন -- সে তথ্য অজানা।
বঙ্কিমচন্দ্রের খেতাবগ্রহণ নিয়ে গোলযোগের যথেষ্ট কারণও ছিল। রায়বাহাদুর হওয়ার আট বছর আগেই ১৮৮৪ সালে ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার আশ্বিন সংখ্যায় বেরিয়েছিল বঙ্কিমের ‘মুচিরাম গুড়ের জীবনচরিত’, যে রচনায় বঙ্কিমচন্দ্র অর্ধশিক্ষিত চাকুরিজীবী মধ্যবিত্ত বাঙালির ইংরেজতোষণ এবং চাটুকারবৃত্তির এক ঐতিহাসিক ব্যঙ্গচিত্র তুলে ধরেছিলেন। একটা গোটা রচনাই আবর্তিত হল মুচিরাম নামে অযোগ্য এক ব্যক্তি কীভাবে পদলেহন-প্রতিভার দ্বারা রায়বাহাদুর খেতাবপ্রাপ্ত হচ্ছে সেই প্রক্রিয়াকে কেন্দ্র করে। স্বভাবতই এ রচনা প্রকাশের মাত্র আট বছর পরে স্বয়ং রচয়িতা ইংরেজ সরকারের কাছ থেকে নতমস্তকে সেই রায়বাহাদুর উপাধিই গ্রহণ করবেন, তা হজম করতে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের সমস্যা হয়েছিল বৈকি। সবচেয়ে বড় কথা, খেতাবগ্রহণকারী যখন বাঙালির জাতীয়তাবোধ গড়ে তোলার অন্যতম কারিগর বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, তখন এ বিষয়ে বাঁকা প্রশ্ন একেবারে অযৌক্তিকও বলা যায় না বোধহয়।
এহেন পরিস্থিতিতে রবীন্দ্রনাথের অবস্থান ঠিক কী ছিল তা জানা যাচ্ছে ‘সাধনা’ পত্রিকার ১২৯৯ বঙ্গাব্দের ভাদ্র-আশ্বিন সংখ্যায় “সাময়িক সাহিত্য আলোচনা” বিভাগে।নগেন্দ্রনাথ গুপ্তের “উপাধি উৎপাত" প্রবন্ধের সমালোচনায় রবীন্দ্রনাথ স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিচ্ছেন বঙ্কিমবাবুকে ইংরেজ গভর্নমেন্ট উপাধি প্রদানের মাধ্যমে কোন সাহিত্যিক স্বীকৃতি দেন নি। বরং তিনি রাজকর্মচারী হিসাবে নিজের দক্ষতা ও কর্তব্যনিষ্ঠার পুরষ্কারস্বরূপ রায়বাহাদুর খেতাব অর্জন করেছেন, “অতএব তাহা লইয়া ক্ষোভ করিতে বসা মিথ্যা।" সাহিত্যিক বঙ্কিমের জীবনদর্শন আর তাঁর পেশাগত নৈতিকতা ও আনুগত্য যে ভিন্নখাতে বয়ে যেতে পারে -- তা ভূয়োদর্শী রবীন্দ্রনাথ যত অনায়াসে বুঝেছিলেন, সেদিনের বাঙালি তত সহজে সেটা মেনে নিতে পারে নি।