ফিচার

‘কুইক আর ফ্লুপকে’ : টিনটিন-স্রষ্টা অ্যার্জের আরেক স্মরণীয় সৃষ্টি

অলর্ক বড়াল Jan 27, 2021 at 5:01 am ফিচার

বেলজিয়ান কার্টুনিস্ট অ্যার্জে ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘টিনটিন’-এর নাম শোনেননি, এমন বইপ্রেমী পাওয়া দুষ্কর। গোটা বিশ্বজুড়ে এমন অখণ্ড জনপ্রিয়তা সম্ভবত আর কোনও কমিক চরিত্রের কপালে জোটেনি। অ্যার্জে-র ‘জো-জেট-জোকো’-র কথাও বাঙালি পাঠকেরা অনেকেই জানেন। তবে তাঁর আরেক জনপ্রিয় কমিক সিরিজ ‘কুইক আর ফ্লুপকে’ বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদের আনুকুল্য না পাওয়ায় অনেকটাই আড়ালে থেকে গেছে।

১৯৩০-এর দশকে অ্যার্জে তাঁর ‘দ্য অ্যাডভেঞ্চারস্‌ অফ টিনটিন’-এর পাশাপাশি আরও একটি কমিক সিরিজ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করতে থাকেন। বেলজিয়ান সংবাদপত্র ‘ল্য ভঁতিয়েম সিয়েক্‌’ (‘Le Vingtième Siècle’) এর চিলড্রেন্স সাপ্লিমেন্ট ‘ল্য প্যতি ভঁতিয়েম’ (‘Le Petit Vingtième’) এর পাতায় ‘কুইক এত্‌ ফ্লুপকে, গ্যামন দ্য ব্রুসেল’ (‘Quick et Flupke, gamins de Bruxelles’ – ‘The Exploits of Quick and Flupke’) নামে প্রকাশ হতে থাকে ব্রাসেলস শহরের দুই দুর্ব্যবহারকারী বালক ‘কুইক’ ও ‘ফ্লুপকে’ এবং এলাকার পুলিশের সঙ্গে তাদের ঝামেলার নানা কাহিনি।  


‘ল্য ভঁতিয়েম সিয়েক্‌’ সংবাদপত্রের সম্পাদক অ্যাবে নরবের ওয়েলেজ যখন অ্যার্জে-কে ‘ল্য প্যতি ভঁতিয়েম’-র সম্পাদকরূপে নিয়োগ করেন তখন প্রথমে তিনি ঐ পত্রিকারই এক ক্রীড়া সাংবাদিকের একটি কমিক সিরিজের জন্য ইলাস্ট্রেশনের কাজ শুরু করেছিলেন। কিন্তু নিজের কাজে সন্তুষ্ট না হওয়ায় অ্যার্জে স্থির করেন নিজের উদ্যোগেই কমিক্স রচনা করবেন। ঐ পত্রিকার সংবাদদাতা লিওঁ দেগ্রেল (যিনি সে সময় মেক্সিকোয় ক্রিস্তেরো যুদ্ধের খবর সরবরাহের কাজ করছিলেন) জর্জ ম্যাকমানাস-এর ‘ব্রিঙ্গিং আপ ফাদার’, জর্জ হেরিমান-এর ‘ক্রেজি ক্যাট’ ও রুডলফ ডার্ক্স-এর ‘কাটজেনজ্যামার কিডস্‌’ প্রভৃতি মার্কিন কমিক্সগুলি অ্যার্জের কাছে পাঠান। ঐ কমিক্সগুলিতে ব্যবহৃত নতুন পদ্ধতি অ্যার্জে-কে চমৎকৃত করে। 

অ্যার্জে পরবর্তীকালে নিজেই একবার স্মৃতিচারণ করে বলেছিলেন, একবার কিছুদিন ছুটি কাটিয়ে কাজে ফেরার পর তিনি জানতে পারেন যে তাঁর সহকর্মীরা তাঁর টাকাপয়সার খরচ নিয়ে মজা করতে গিয়ে জনসমক্ষে ঘোষণা করে বসে আছেন যে অ্যার্জে নাকি আবার নতুন একটা কমিক তৈরি করছেন। বাধ্য হয়েই অ্যার্জে-কে মাত্র কয়েকদিন সময়েই নতুন একটি কমিক তৈরি করতে হয়। এভাবেই শুরু হয় কুইক আর ফ্লুপকের যাত্রা। এই কমিকের গল্প, দৃশ্যায়ন ও চরিত্র নির্মাণে ব্রাসেলস্‌ শহরে অ্যার্জের নিজের শৈশবজীবনের পাশাপাশি ফরাসী ছায়াছবি ‘লে দু গস’ (‘Le Deux gosses’ – ‘The Two Kids’)– এর প্রভাব ছিল। এই কমিকের পুলিশ চরিত্রগুলি অ্যার্জে নির্মাণ করেছিলেন চার্লি চ্যাপলিনের সিনেমার পুলিশদের আঙ্গিকে। ২৩শে জানুয়ারী ১৯৩০-এ ‘ল্য প্যতি ভঁতিয়েম’-এর পাতায় যাত্রা শুরু হয় এই কমিকের। প্রথমদিকে কুইক-এর সঙ্গে ফ্লুপকে-কে রাখা হয়নি। কুইক চরিত্রের নামটি অ্যার্জে তাঁর এক বন্ধুর নাম থেকে নিয়েছিলেন। তিন সপ্তাহ পরে অ্যার্জে কুইকের সাগরেদ হিসেবে দ্বিতীয় বালকের চরিত্রটিকে গল্পে যুক্ত করেন ও নাম দেন ‘সুস্কে’। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি সেই নাম পরিবর্তন করে রাখেন ‘ফ্লুপকে’, ফ্লেমিশ ভাষায় যার অর্থ ‘ছোট্ট ফিলিপ’। ধারাবাহিকভাবে পরের ছয় বছর প্রতি বৃহস্পতিবার প্রকাশ হত এই কমিক সিরিজটির বিভিন্ন পর্ব। অ্যার্জে বাস্তবে এই কমিক সিরিজের পেছনে খুব একটা সময় ব্যয় করতেন না – প্রকাশের দিন সকালে টাইপসেটের কাজ শেষের ঠিক আগে মাত্র দেড়-দুঘণ্টা সময়ের মধ্যেই তিনি সেইদিনের প্রকাশিতব্য অংশের সম্পূর্ণ কাজটি করতেন। অ্যার্জের সহকারী পল জামঁ বলেছিলেন, যেহেতু প্রতি সপ্তাহে সম্পূর্ণ নতুন ভাবনার প্রয়োজন ছিল, অ্যার্জের পক্ষে টিনটিন-এর তুলনায় ‘কুইক ও ফ্লুপকে’ সিরিজ নিয়ে কাজ করতে বেশি সমস্যা হত।


কমিকটির কাহিনিক্রমে বেশ অনেকবার অ্যার্জে নিজেকেও নিয়ে এসেছেন। যেমন একবার “The Kidnapping of Hergé” পর্বে কুইক ও ফ্লুপকে অ্যার্জে-কে তাঁর অফিস থেকে অপহরণ করে তাঁকে দিয়ে জোর করে মুচলেকা লেখায় যে – “I, the undersigned, Hergé, declare that, contrary to how I make it seem every week, the parties of Quick and Flupke are good, smart, obedient, etc.” 

গোটা সিরিজ জুড়েই অ্যার্জে চরিত্রগুলির নামকরণে শব্দ নিয়ে মজার খেলা করেছেন। যেমন, ফরাসী ভাষায় ‘mort aux rats’ (উচ্চারণ ‘মোরওরা’) এর অর্থ হল ‘ইঁদুরদের কাছে মৃত্যু’ আর কাহিনিতে পশুচিকিৎসকের নাম ‘এম. মোরওরা’। কাহিনিতে দুজন মুষ্ঠিযোদ্ধার নাম হল – ‘ম্যাক আরনি’ (যা বাস্তবে ‘ম্যাকারনি’ পিৎজা শব্দের মজার ব্যবহার) ও ‘স্যাম সুফি’ (ফরাসী শব্দবন্ধ ‘ça me suffit’ – উচ্চারণ ‘সামা সুফি’ ও অর্থ হল ‘এটা আমার পক্ষে যথেষ্ট’) ।

১৯৩৫-এর শেষদিকে অ্যার্জে ‘কেওর ভ্যালিওঁ’ নামের এক ফরাসী ক্যাথলিক সংবাদপত্রের অনুরোধে ‘জো, জ্যেতে ও জোকো’ নামে এক নতুন কমিক সিরিজ লেখার ও আঁকার কাজে মনোনিবেশ করলে ধীরে ধীরে ‘কুইক ও ফ্লুপকে’ নিয়ে তাঁর আগ্রহ ও কাজের পরিমাণ দুই-ই কমে আসে। ১৯৩৮-এর নববর্ষের জন্য অ্যার্জে একটি বিশেষ প্রচ্ছদ আঁকেন যেখানে কুইক ও ফ্লুপকে-র পাশে টিনটিন কমিকের চরিত্রগুলি এবং ‘জো, জ্যেতে ও জোকো’-এর চরিত্রেরা জায়গা পেয়েছিল। শেষপর্যন্ত টিনটিন-এ মনোনিবেশ করার জন্য তিনি ‘কুইক ও ফ্লুপকে’ সিরিজ নিয়ে কাজ করা বন্ধ করে দেন। ১৯৪০-৪১ নাগাদ এই সিরিজের শেষ তিনটি কিস্তি ‘ল্য সোয়া জুনেস্‌’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।


অ্যার্জের জীবনীকার পিয়ের আসুলিন “Hergé, the Man Who Created Tintin” গ্রন্থে লিখেছেন যে ‘কুইক ও ফ্লুপকে’ সিরিজটি টিনটিন সিরিজের “Tintin in the Land of the Soviets”-এর ঠিক উল্টো মানসিকতা নিয়ে রচিত হয়েছিল। তাঁর মতে, ‘কুইক’ ও ‘ফ্লুপকে’ চরিত্রদ্বয় জার্মান লেখক উইলহেলম বুশ-সৃষ্ট ‘ম্যাক্স’ ও ‘মরিৎজ’ চরিত্রদুটির “আপডেটেড ভার্সান”। অ্যার্জের আরেক জীবনীকার বেনুয়া পিটারস্‌-এর কথায়, চরিত্রদুটি ‘দ্য অ্যাডভেঞ্চারস্‌ অফ টিনটিন’-এর এক “পারফেক্ট কাউন্টারপয়েন্ট” হিসেবে কাজ করেছিল।  ছেলেদুটি যেখানে শৃঙ্খলার বিরুদ্ধে কাজ করে, সেখানে টিনটিন শৃঙ্খলাস্থাপনার কাজে ব্যস্ত। এই কমিক সিরিজে ব্রাসেলস্‌ শহরের প্রতি অ্যার্জে-র ভালোবাসার প্রকাশ লক্ষ করার মতো। ১৯৩০-এর দশকের ইউরোপের শহরজীবনের একটা বাস্তব চিত্র যেমন এখানে পাওয়া যায় তেমনই বালকদুটির অভিভাবকহীন-জীবনে একা একা বেড়ে ওঠার মাধ্যমে অ্যার্জে ক্ষমতালোলুপ নেতা ও রাষ্ট্রযন্ত্রের নিপীড়নের মাঝে শহুরে শৈশবজীবনের একটা ভয়াবহ দিক তুলে ধরেছেন। কাহিনিতে তাই বারেবারে তিনি হিটলার, মুসোলিনি-র ভাষণের প্রসঙ্গও তিনি এনেছেন। 


কুইক ও ফ্লুপকে চরিত্রদুটি বেশ কয়েকবার টিনটিন-এর নানা পর্বে ‘ক্যামিও অ্যাপিয়ারেন্স’ দিয়েছে – ‘টিনটিন ও কঙ্গো’-এর ১৯৩১ ও ১৯৪৬ উভয় সংস্করণেই টিনটিন-কে বিদায় জানানো জনতার প্রথম সারিতে তাদের দেখা যায়; ‘দ্য শুটিং স্টার’ পর্বে অভিযাত্রী দলের যাত্রা শুরুর সময় তাদের জাহাজের দিকে দৌড়াতে দেখা যায়। ‘দ্য অ্যাডভেঞ্চারস্‌ অফ টিনটিন’-এর বেশকিছু বইয়ে তাদের দেখা যায় ক্যাপ্টেন হ্যাডক ও তাঁর হুইস্কি বোতলের দিকে গুলতি তাক করে থাকতে।

১৯৯০ নাগাদ লেসলি লন্সডেল-কুপার ও মাইকেল টার্নার ‘কুইক ও ফ্লুপকে’র ইংরেজিতে অনুবাদ শুরু করলেও মাত্র দুটি বই-ই প্রকাশ হয়েছিল। ১৯৮০-এর দশকে ‘স্টুডিও অ্যার্জে’-র তত্ত্বাবধানে চরিত্রদুটিকে নিয়ে একটি টেলিভিশন সিরিজও তৈরি হয়েছিল। অ্যার্জের নিজের  কতটা আবেগ এই সিরিজের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল, বলা কঠিন। সম্ভবত, নিছক কর্তব্যের খাতিরেই কিছুদিন এই সিরিজ টানতে হয়েছিল তাঁকে। তারপর টিনটিন যখন জনপ্রিয় হতে শুরু করে, তিনি এই সিরিজের জন্য সময় বের করতে চাননি। তবে টিনটিনের চরিত্রটি যেমন অ্যার্জে-র তরুণজীবনের রোমাঞ্চকর রিপোর্টার হওয়ার স্বপ্নের এক প্রতিচ্ছবি, তেমন এই বিচ্ছু বালকদ্বয় – কুইক ও ফ্লুপকে, তাঁর ছেলেবেলার দুর্দম অথচ শিশুসুলভ ফ্যান্টাসির প্রতিফলন। 

..................................................

[ছবি : ইন্টারনেট] 

#Quick & Flupke # Hergé #Le Petit Vingtième #Le Vingtième Siècle #Belgian newspaper #The Adventures of Tintin #cartoonist #Comic Series #টিনটিন #হার্জ #অ্যার্জে #বেলজিয়াম #কুইক #ফ্লুপকে #অলর্ক বড়াল #সিলি পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

54

Unique Visitors

184458