‘মানিকবাবুর মেঘ’ : জীবনমৃত্যুর বিষাদলিপি ও বিশল্যকরণী
.....................
পরিচালনা : অভিনন্দন বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রযোজনা : মোনালিসা মুখোপাধ্যায়, বৌদ্ধায়ন মুখোপাধ্যায়
কাহিনি ও চিত্রনাট্য : অভিনন্দন বন্দ্যোপাধ্যায়
সংলাপ : অভিনন্দন বন্দ্যোপাধ্যায় ও বৌদ্ধায়ন মুখোপাধ্যায়
প্রধান ভূমিকায় : চন্দন সেন, দেবেশ রায়চৌধুরী, অরুণ গুহঠাকুরতা, নিমাই ঘোষ, ব্রাত্য বসু প্রমুখ
..............
“এইরকম লোকেদের এখন আর কোথাও দেখা যায় না।”
না। কোনও সিনেমা নিয়ে নয়, বন্ধুদের সান্ধ্য আড্ডায় সেদিন কথা হচ্ছিল হারানো সময় নিয়ে। রাস্তায়, পাড়ার মোড়ে, অনুজ্জ্বল চায়ের দোকানে দেখা যেত এইসব চরিত্রদের। দশটা পাঁচটার কাজ নেই যাদের। সারাদিন অকাজ আর আড্ডায় দিন কাটত নিষ্কর্মা লোকগুলোর। আবার আচমকা বিপদে আপদে দুর্দিনে সবার আগে দেখা মিলত এদেরই। বিশ্বায়নের পৃথিবী কবেই বাতিল করে দিয়েছে এই মানুষগুলোকে! শিখিয়েছে মানুষের মূল্য নির্ধারিত হয় তার Utility Value দিয়ে। কাজের মানুষ হলে তবেই তোমার দাম আছে। নচেৎ নয়।
এই লোকগুলোর তবু কিছু না থেকেও ছিল অনেককিছুই। মানুষের সঙ্গ। নির্ভেজাল আড্ডা। চায়ের ভাঁড়ে ঘনিয়ে ওঠা মজলিশ। মানিকবাবুর সেসবও ছিল না তেমন। মনুষ্যসমাজ যদি বিরাট একটা জিগস পাজল হয়, তিনি সেই খেলনার এমন বেমক্কা এক টুকরো, অন্য কোনও খণ্ডের সঙ্গেই যার জোড় মেলে না। চাকরি একটা ছিল বটে। কিন্তু তাতে কেবল টিকে থাকাই যায়। বেঁচে থাকা যায় না।
তবু বেঁচেই ছিলেন মানিকবাবু। প্রত্যেকটা দিন হবহু একইরকম দেখতে হলেও, দিন একরকম কেটে যাচ্ছিল তাঁর। চলচ্ছক্তিরহিত বাবার সেবাযত্ন, চিনির শিশি উপুড় করে অভুক্ত পিঁপড়েদের খেতে দেওয়া, অফিস যাওয়ার পথে পাতাবিহীন কাঠখোট্টা গাছে ঢেলে দেওয়া শুশ্রূষার জলবিন্দু আর রাতের ঘুমন্ত পাড়ায় নেড়িকুকুরদের ভোজপর্বের আয়োজন – এমন নানা ভালোমন্দ মুহূর্তের যৌথ কোলাজ হয়ে ছিল তাঁর জীবন। অফিসের নীরস রোজনামচার পর কখনও সখনও আবৃত্তির টিউশনিতে শোনা যেত তাঁর মিতভাষী গলার মন্দ্রস্বর। মেঘভাঙা রোদ্দুরের মতোই ঘরের বিষণ্ণ আবহে ঢেউ তুলত আবোল তাবোলের শব্দমালা।
কিন্তু এমন সংবেদী, এমন মায়াময় মানুষ যেন আজকের বাস্তবে বড্ড বেমানান। যে বাস্তব কেবলই ছুটে চলে যোগ্যতা, সামর্থ্য আর সাফল্যের এল ডোরাডোকে নিজের দখলে আনতে… যে বাস্তব সহায়সম্বলহীন শোকস্তব্ধ ভাড়াটেকে বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দিতে দ্বিধা করে না…যে বাস্তব ছাদওয়ালা বাড়ির একচিলতে স্বপ্নকে ঠকিয়ে হাতিয়ে নেয় মানুষের শেষ সম্বল --- মানিকবাবুদের অস্তিত্বকে ধারণের যোগ্যতা কি আদৌ আছে সেই বাস্তবের? তাঁদের পৃথিবী তো সেই অবাস্তব প্রদেশ, যেখানে সিনেমা শুরুর আগে কোনও গাছপালা বা মেঘকেও যে আঘাত করা হয়নি, সে কথা জানিয়ে দিতে ভোলেন না পরিচালক!
অবশ্য সমস্ত প্রেমের গল্পের শুরু বোধহয় সেখান থেকেই, বাস্তব আর অবাস্তবের ভেদ যেখানে আবছা হয়ে আসে। বাংলা সিনেমার পর্দা যেন অপেক্ষায় ছিল এমনই এক আশ্চর্য গল্পের। মানিকবাবু যেমন অপেক্ষায় ছিলেন ‘তাঁর’ মেঘের। কলকাতাবাসী যেমন অপেক্ষায় ছিল শহর-ধোয়ানো বৃষ্টির।
সাদা-কালো রঙের ব্যবহারে ‘মানিকবাবুর মেঘ’ অপূর্ব এক রূপকথার সাক্ষী করে রাখে আমাদের। সে রূপকথার প্রতিটি পরতে অপরিসীম যত্ন। জীবনকে ছুঁয়ে দেখার নাছোড় মায়াটান। এখানে জীবন বিষণ্ণ। মৃত্যুও বিষণ্ণতার। আর সমস্ত বিষণ্ণতাকে নস্যাৎ করে দেওয়ার অবুঝ বিশল্যকরণী – ভালোবাসা। ঘটনার স্রোত এখানে গৌণ হয়ে যায়। প্রতিটি ফ্রেম, তাদের প্রতিটি আনাচ কানাচ এবং আবহের শব্দবিন্যাস কথা বলে তাদের নিজস্ব ভাষায়। তাই সংলাপের প্রয়োজন কমে আসে। চিত্রনাট্যের এই অবাক-করা সংযমের জন্য কুর্নিশ প্রাপ্য চিত্রনাট্যকারদের।
কুবেরের অভিশাপে নির্বাসিত যক্ষ সেই কালিদাসের কালেই বিরহজ্বালায় অস্থির হয়ে গুলিয়ে ফেলেছিল জড় আর সজীবের সীমারেখা! মেঘকে দূত করে পাঠাতে চেয়েছিল অলকাপুরীতে, তার প্রেমিকার কাছে। মানিকবাবুও তো তার থেকে খুব দূরের মানুষ নন। ‘যে-জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের— মানুষের সাথে তার হয়নাকো দেখা’ – মানিকবাবুর জীবনও মানুষের সঙ্গে দেখা না হওয়ার জীবন। বাহ্য বাস্তবের সঙ্গে মিলতে না পারা জীবন। আপাতদৃষ্টিতে ‘অস্বাভাবিক’। ‘A Beautiful Mind’—এর জন ন্যাশের মতোই। মানিকবাবুর গল্প অন্য আঙ্গিকে বলা হলে তা হয়ে উঠতে পারত স্কিৎজোফ্রেনিয়া আক্রান্ত কোনও ব্যক্তির আখ্যান। কিন্তু এখানে সে সব প্রসঙ্গ অবান্তর। এই ছবি মানিকবাবুর কার্যকলাপের আড়ালে আমাদের চেনাজানা বাস্তবকেও প্রশ্ন করতে শেখায় বলে মনে হয়। ডিএসএম স্বীকৃত অসুস্থতার চেয়েও ভয়ংকর যে রোগ বাসা বেঁধে আছে সমাজের গহিন অন্দরে, তাকে চিনতে শেখায়। সে রোগ সংবেদনহীনতার। একাকীত্বের। মানুষকে একা করে দেওয়ার। তাই সিনেমার শেষে আবার ফিরে আসতে ইচ্ছে হয় ছবির মুখবন্ধ হিসেবে রেখে যাওয়া সেই বাক্যের কাছে –
“When life itself seems lunatic, who knows where madness lies?”
আপন পরিপার্শ্বের মানুষ থেকে চোখ ফিরিয়ে লেফট কিংবা রাইট সোয়াইপে যোগ্যতম সঙ্গী-সঙ্গিনীর নিরন্তর খোঁজ করে চলে যে সময়; মেঘের সঙ্গে কথা-বলা মানিকবাবুর বাস্তব কি তার চেয়েও বেশি অস্বাভাবিক?
................
#film review #মানিকবাবুর মেঘ #The Cloud and the Man