‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’ থেকে ‘খণ্ডহর’ : প্রেমেন্দ্র মিত্রের গল্প থেকে মৃণাল সেনের ছবি
এগারো ক্লাসের সিলেবাসে থাকা প্রেমেন্দ্র মিত্রের 'তেলেনাপোতা আবিষ্কার' গল্পটা ছাত্রছাত্রীদের একেবারেই না-পসন্দ। খুব বেশি শিক্ষককেও গল্পটা পছন্দ করতে দেখা যায় না। তবে এ গল্প বাংলা সাহিত্যে একটি জলজ্যান্ত বিস্ময় তা নিয়ে সন্দেহ নেই। বাঙালি বিদ্যাজীবীরা বিদেশি লেখকদের লেখায় জটিল অন্তর্গূঢ় সব তত্ত্ব খুঁজতে যতটা উদ্বাহু, বাংলা সাহিত্যের আশ্চর্য মণিমুক্তো নিয়ে ততটা মনোযোগী হলে প্রেমেনবাবুর এ লেখা নিয়ে নিশ্চিতভাবেই আন্তর্জাতিক জার্নালে মোটা মোটা থিসিস জমা পড়ত। এহেন গল্প অবলম্বনে ফিল্ম তৈরি করেছিলেন আর এক বাঙালি মহীরুহ। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বাঙালি চলচ্চিত্র-নির্মাতা মৃণাল সেন। অবশ্য বাংলায় নয়, হিন্দিতে। ফিল্মের নাম ‘খণ্ডহর’।
'তেলেনাপোতা আবিষ্কার' গল্পটি থেকে অবশ্য এর আগেও একটি ছবি তৈরি হয়েছিল। 'স্বপ্ন নিয়ে' নামে সেই অ্যাডাপটেশনটি করেছিলেন বিখ্যাত লেখক ও শিল্পী পূর্ণেন্দু পত্রী। ছবিটা নাকি প্রেমেন্দ্র মিত্রের একদম পছন্দ হয়নি। কথায় কথায় মৃণালকে সেকথা একদিন বলেওছিলেন তিনি। সেটা শুনেই যে মৃণাল ‘তেলেনাপোঁতা’ থেকে ছবি তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তা অবশ্য নয়। সে ছবির পরিকল্পনা তাঁর মাথায় এসেছিল আরও পরে।
তখন রমাপদ চৌধুরীর উপন্যাস 'খারিজ' থেকে ছবি করে ফেলেছেন মৃণাল। পরের ছবি নিয়ে ভাবতে ভাবতে আচমকা একদিন বইয়ের তাক থেকে নামালেন 'প্রেমেন্দ্র মিত্রের শ্রেষ্ঠ গল্প'। আর অদ্ভুতভাবে এক টানে বইটা খুলে যে গল্পটা প্রথম বেরোলো, সেটা 'তেলেনাপোতা আবিষ্কার'! তিনি এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললেন। একবার, দু'বার, কয়েকবার। মাথার মধ্যে ভিড় করতে লাগল পর পর শট। তখনই ঠিক করে ফেললেন, এটাই ছবি করবেন। কিন্তু বাংলাতে করা মুশকিল। এ ছবি করতে হলে হিন্দিতে করতে হবে। পরদিন সকালেই ছুটলেন প্রেমেন্দ্র মিত্রের কাছে। তাঁকে ছবির কথা বলতেই তিনি তো বেজায় খুশি, "করো করো, তুমি করলে ভালো হবে। তবে একটু তাড়াতাড়ি করো, চোখ দুটো শেষ হয়ে যেতে বসেছে, দেখো, ছবিটা যেন দেখতে পাই।"
তখন প্রেমেন্দ্র মিত্রের দৃষ্টিশক্তি ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে আসছিল, এগিয়ে যাচ্ছিলেন অন্ধত্বের দিকে। তবে তিনি সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে যাবার আগেই তাঁর ইচ্ছে পূরণ করতে পেরেছিলেন মৃণাল। খুব তাড়াতাড়ি ছবির কাজ শেষ করেছিলেন এবং বাণিজ্যিক রিলিজের আগেই স্পেশ্যাল স্ক্রিনিং-এর ব্যবস্থা করেছিলেন প্রেমেনবাবুর জন্য। ছবি দেখে প্রেমেনবাবু নাকি আনন্দে কেঁদে ফেলেছিলেন। আবেগে জড়িয়ে ধরেছিলেন মৃণালকে।
‘খণ্ডহর’ ছবি হিসেবে এমনিতে খুবই প্রশংসিত। চলচ্চিত্র-গবেষক তানবীর মোকাম্মেল একটি লেখায় মন্তব্য করেছেন, “সবচেয়ে অমৃণালীয় ছবি হচ্ছে ‘খণ্ডহর’। শ্রেণির সংঘাত নেই, দারিদ্র্যের নির্মমতা নেই, বড় কোনো দ্বন্দ্বও নেই। তবে সবচেয়ে বিষণ্ন এক ছবি। এক ভগ্নস্তূপে এক বিষাদময়ী নারীর এক করুণ জীবনগাথা। গভীরভাবে মানবিক এক ছবি।” ১৯৮৩ সালে এ ছবি তৈরি হয়। অভিনয় করেছিলেন বলিউডের অল্টারনেটিভ ধারার তাবড় অভিনেতারা। মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন নাসিরুদ্দিন শাহ ও শাবানা আজমি। পার্শ্বচরিত্রে ছিলেন পঙ্কজ কপুর, অন্নু কাপুরের মতো অভিনেতা। ‘খণ্ডহর’-এর ঝুলিতে এসেছিল তিনটে জাতীয় পুরস্কার :- সেরা পরিচালক, সেরা অভিনেত্রী (শাবানা আজমি) ও সেরা এডিটর (মৃণ্ময় চক্রবর্তী)-এর পুরস্কার। শিকাগো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সেরা ছবির পুরস্কার এবং মন্ট্রিয়ল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সিলভার অ্যাওয়ার্ডও পায়। তবে সবচেয়ে বড় পুরস্কার বোধহয় লেখকের পরিপূর্ণ তৃপ্তি।
ঋণ :
১) মৃণাল সেনের সঙ্গে কয়েকটি স্মরণীয় মুহূর্ত/ পার্থসারথি পাণ্ডা
২) আমৃত্যু প্রতিবাদী থাকতে চাওয়া এক চলচ্চিত্রকার মৃণাল সেন/ তানবীর মোকাম্মেল