‘কোরাস’ : মানুষ হব বলে যেটা হয়ে বেঁচে আছি
কোরাস। যাকে সিপিয়েম সর্বহারা, টিয়েমসি মা-মাটি-মানুষ, বিজেপি ‘মিঁত্রোওওওও’ বলে ডেকে থাকে। রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যায় এরা কখনও ‘জনতা চরিত্র’, কখনও একই বৃন্তে দুটি কুসুম। শরৎচন্দ্র তো এদের জন্য আজীবন কেঁদে ভাসিয়ে গেলেন। এদের আবার দুটি দল—একদল যারা সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা দেখেছে, আরেকদল যারা দেখেনি। অ্যারিস্টটলের শিশুশয্যা ছেড়ে যারা কলকাতার গ্রুপ থিয়েটারের উপবনে ফাই-ফরমাশ খাটে আর কি! তারাই কোরাস। পাতি কথায় আমার আপনার মতো আম-পাব্লিক। যারা ইস দুনিয়াকি রঙ্গমঞ্চমে ক্ষমতাবানদের কাটপুতলিয়ার মত ভিড়ের চরিত্রে অভিনয় করে চলেছি, তাদের নিয়ে ফোর্থ বেল থিয়েটার্সের নাটক ‘কোরাস’। নাটক নয়, একে বরং হুলাবিলা বলা যেতে পারে।
পৌনে দু-ঘন্টার নাটকে এত হুলাবিলা যে, এর মধ্যে ওই নাটক, নাটক ব্যাপারটাই নেই। এটাতে কোনো মহান চরিত্রের উত্থান-পতনের টানটান গল্প নেই। দ্বন্দ্ব-সংঘাত-সানডেসুলভ সাসপেন্স নেই। দর্শকের বুকে ছুরি মেরে দেওয়া ডায়লগ নেই। সিনেমায় নামকরা নায়ক মঞ্চে ঢুকে গলা ফুলিয়ে চিৎকার করলেই দর্শকের অকারণ হাততালি নেই। আলোকপ্রক্ষেপনের নামে একটু সিরিয়াস দৃশ্যকে লাল আলোয় রাঙিয়ে দিয়ে যাওয়া নেই। নায়কের ফিটনেস দেখানোর জন্য মঞ্চে শ-খানেক ব্লক নেই। আবহসঙ্গীত বলে হলিউড সিনেমার মিউজিক ঝেঁপে দেওয়া নেই। শুধু নেই, নেই আর নেই। তাহলে আছেটা কী? বাংলা থিয়েটারের দায়িত্ববান, মননশীল, নাট্যমোদী দর্শক হিসেবে আপনি কী পাবেন এখান থেকে? অনেক কিছুই আছে। চাইলে আপনি একটা চেক-লিস্ট নিয়ে বসতে পারেন। সমাজ, রাজ, অর্থ থেকে শুরু করে নীতি আয়োগ পর্যন্ত সব কিছু আপনি এ নাটকে পাবেন। অল্পবিস্তর বেহালা বাজানো নীতিকথাও আছে। আর আছে সর্বরোগনাশক বটিকা - ‘খিল্লি’। এই হয়তো কেউ সারুক্ষানের মতো হাত ছড়িয়ে দুটো কথা বলে গেল, পরক্ষণেই কেউ ‘হায় গরমি’ নোরা ফতেহির মতো পশ্চাদ্দেশ দুলিয়ে গেল। কেউ বুম্বাদার মতো পিটি ড্যান্স করছে, তো কোনো এক হেমন্তকণ্ঠী ‘আয় খুকু আয়’ গাইছে। আর সুযোগ পেলেই সবাই মিলে খানিক নেচে নিচ্ছে। লাইভ গান-বাজনা পাবেন। ‘ব্যান্ডমাস্টার’ আপ্পুর পরিকল্পনায় খান সাত-আটেক অসাধারণ গান আছে। মঞ্চের উপর প্রায় সব সময়ই জনা পঁচিশ-তিরিশেক অভিনেতা-অভিনেত্রীর অসামান্য সামঞ্জস্যপূর্ণ সম্মিলিত অভিনয় পাবেন। কোরাস বলে কাউকে দুচ্ছাই করা হয়নি। সেট বলতে পাবেন মঞ্চের মাঝখানে সবেধন নীলমণি একটা গাছতলা। কথায়-কথায় এতো খোরাক আছে যে হাসতে হাসতে ভুলেই যাবেন কীসের জন্য হাসছিলেন। পান, স্যাটায়ার, হিউমার-এসব আছে, সুড়সুড়ি দেওয়া খিল্লিও আছে। ওভার-অ্যাকটিং আছে, গ্যাগ আছে। দু-চারটে অপবাক্য আছে। আবার দুম করে সবকিছু সিরিয়াস করে দেওয়া নীরবতা আছে। আপনি কনফিউফড হয়ে যাবেন, এখানে হাসা উচিত কি উচিত না! সব মিলিয়ে চূড়ান্ত বাওয়াল-বাট্টা।
একটা গল্প অবশ্য নাটকে আছে, সেটা তেমন ইমপরট্যান্ট নয়। মানে আমাদের জানা গল্প, আমাদের নিয়েই গল্প, আমাদের বারোটা বেজে যাওয়ার গল্প। তাই ইমপরট্যান্ট নয়। আরে ওই যে সিপিএম বনধ্ ডাকত, ইউনিয়নের নামে জুলুমবাজি করত, ভোটে রিগিং করত, বিরোধী পার্টি করলে প্রচুর ক্যালাতো, খালি মার্ক্স-লেনিন আওড়াত, ভিত্তি-ভবিষ্যতের নাম করে অর্থনীতির বারোটা বাজাত-এইসব আর কি। তাদের নেতা সাদা ধুতি পরত বলেই তো আর সবকিছু টিএমসি-র অপপ্রচার হয়ে যায় না। উঠতি সিপিএম সে কথা জানে না, পুরনো সিপিএম সেটা মানে না। নাটকে একজন নায়ক আছে, যার বাবা পাঁড় সিপিএম। যে বাবা ভাত দিয়েছে, সে বাবার মতাদর্শ মেনেই ছেলে ছোটোদের সিপিএম করে। সিরিয়াল দেখা মা, ন্যাকা প্রেমিকা আর বাইরে নেতাদের মতো ফ্যানফলোয়ার্স নিয়ে তার ভালোই চলছিল। তারপর এলো ২০১১-তে রাজ্যজোড়া পরিবর্তন। কী করবে আমাদের নায়ক? বাবার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটিয়ে সে কি পালটি খাবে? ওদিকে যে লুচির বদলে বিরিয়ানি দিচ্ছে, দেশির বদলে বিদেশি দিচ্ছে, ফাঁকা ফ্ল্যাটের জায়গায় ওপেন রাস্তায় লেনিন বুঝিয়ে দিচ্ছে, মা সারদাকে দক্ষিণেশ্বর থেকে কালীঘাটে পাঠিয়ে দিচ্ছে। হাওয়ায় টাকা ভাসছে। কয়লার টাকা, স্কুলের টাকা, গরুর টাকা, মাটির টাকা, মানুষের টাকা। একটু দেরিতে হলেও নায়ক পালটি খায়। বেসিকটা যেহেতু সিপিএমের, ফলে দুদিনেই ‘দাদা’ হয়ে উঠতে অসুবিধা হয়নি। তারপর গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ও আমাদের নায়কের খুন। এটাই গল্প, আর এর মাঝে মাঝে নাচা-গানা, একটু রোমান্স, মদ্যপান, বিবেকের প্রবেশ-প্রস্থান, বুদ্ধিজীবীদের বাতেলা, পেজ থ্রি-র গ্ল্যামার, বিশ্বায়ন, পুঁজিবাদ, নারীবাদ ইত্যাদি ইত্যাদি।
এর জন্য এত কিছু? এরকম কত লোকই তো মরে যাচ্ছে প্রতিদিন। থুড়ি ‘লোক’ নয়, কর্মী। সংখ্যামাত্র। তারা আমরাই। আমাদের কাঁধে ভড় দিয়ে ঠিক হচ্ছে কে ইতিহাসে কতটা জায়গা করে নেবে। আমরা সেই ভিড়টা, যারা ঠিক করে দিচ্ছি কে ভোটে জিতবে, কে আমাদের শোষণ করবে। আবার আমরাই এই দুরবস্থার জন্য তাদের গালাগালি দিচ্ছি। কেউ প্রশ্ন করতেই পারেন এতে সিপিএম আমলকে টেনে আনার কী দরকার ছিল? থিয়োরিটিক্যালি আছে। তারা তৈরি করতে চেয়েছে বিশ্বস্ত পার্টি-ক্যাডার, যারা প্রশ্ন তুলবে না, বিরোধিতা করবে না। রাজ্যের প্রতিটি প্রান্তের ঘরের খবর তাদের কাছে থাকবে। প্রতিটি নিয়মনীতি পার্টির লাইন ধরে এগোবে। তারা সফলও হয়েছে। যেখানে একক ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তি বা শক্তিকে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে দেখেছে, সেখানে তারা বাধ সেধেছে। শুধুই মধ্যমেধার কোরাস তৈরি হয়েছে। আর প্র্যাক্টিকালি কী ঘটেছে, সেটা আমরা যারা নব্বইয়ের দশকের প্রজন্ম, যারা দু-আমলের দ্বন্দ্বে নিজেদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলো কাটিয়েছি বা কাটাচ্ছি, তাদের আর আলাদা করে কিছু বলে দিতে হবে না। টিএমসি এই ফর্মুলাই নিয়েছে- আরও নোংরাভাবে, নির্লজ্জভাবে, নৃশংসভাবে। তাদেরও বিচার নিশ্চয়ই হবে। অন্য কেউ ক্ষমতায় আসবে। তাতে কি এই কোরাসত্ব থেকে আমাদের মুক্তি ঘটবে? ক্ষমতাদখলের হিংসা, কর্মবিরতির সংস্কৃতি, শিকড়হীন টুকলিবাজি শিল্প-সাহিত্য এইসব তো আমাদের মজ্জাগত। শুধু অন্যের আগ্রাসনকে দোষ দিয়ে কী হবে, আমাদের আছেটাই বা কী যে আমরা তাকে আটকাব?
এটা নিয়েই বাওয়াল। এটা নিয়েই ‘কোরাস’। নির্দেশক অনিরুদ্ধ দাশগুপ্ত আজব খেল দেখিয়েছেন মাইরি। এই নাটকের রচনাকারও তিনি। তবে এরকম স্বতঃস্ফূর্ত প্রযোজনা আসলে সকলে মিলে রচনা করে। এরকম অনুমান করলে তিনি আশা করি আপত্তি করবেন না। ‘কোরাস ২’ আসার আগে তাদের কাছে শুধু দুটি অনুরোধ। ওই সিপিএম আমলের ২০০৬-১০-এর অংশটা আরেকটু কাটাছাঁটা যায় না কি? ওখানে খিল্লিটা একটু পড়তির দিকে লাগে। আর রাজনীতি ছাড়া সমাজের অন্য দিকগুলোতেও কোরাসের ভূমিকাটা খতিয়ে দেখলে মন্দ হয় না। এটুকু সিকায়েত নয়, জাস্ট কিছু ভাবনা। নতুবা কয়ে ওকার কো, রয়ে আকার রা, দন্ত্যে স- কোরাস হয়ে হাততালিতে, মিছিলে, ভ্যাপসা যানজটে, হাসপাতালের বেডে, শ্মশানে-কবরখানায় মৃতর চরিত্রে অভিনয় করতে আমাদের আর আপত্তি কি? অন্তত যদ্দিন না কোরাস থেকে মানুষ হয়ে বেঁচে ওঠার সুযোগ পাচ্ছি।
.................................
#নাটক সমালোচনা #4th Bell Theatre #chorus #play