বর্ণবিদ্বেষী মন্তব্য থেকেই জন্ম ‘চায়নাম্যান’ বোলারের
কুলদীপ যাদবের নাম নিশ্চয়ই শুনেছেন? হ্যাঁ, পুরুষদের ভারতীয় ক্রিকেট দলের গুরুত্বপূর্ণ বাঁ-হাতি স্পিনারের কথাই বলা হচ্ছে। গত বছরের ক্রিকেট বিশ্বকাপে যিনি আগুনে ফর্মে ছিলেন। তাঁর স্পিনের জাদুর সামনে বোকা হয়েছে বহু বিখ্যাত ব্যাটার। এক সময় কলকাতা নাইট রাইডার্স ভক্তদেরও চোখের মণি ছিলেন তিনি। যদিও ক্রিকেট বিশ্ব আরেকটি নামে চেনে কুলদীপকে। তা হল ‘চায়নাম্যান বোলার’। শুধু কুলদীপ নন, এর আগে অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটার ব্র্যাড হগও পরিচিত ছিলেন এই নামে। অদ্ভুত বিষয়! তাঁদের সঙ্গে তো দূর-দূরান্তে চিনের কোনো সম্পর্কই নেই। তাহলে হঠাৎ ‘চায়নাম্যান’ ডাকার মানে কী?
সেই গল্পে ঢোকার আগে জেনে দেওয়া দরকার কাকে বলে ‘চায়নাম্যান বোলার’? বা তার বিশেষত্বই বা কোথায়? আসলে বোলিংয়ের সময় দুভাবে বলকে স্পিন করানো যায়। এক হল আঙুলের সাহায্যে, যাকে বলা হয় ‘ফিঙ্গার স্পিনার’। আর দ্বিতীয়ত কবজির মোচড়ে বা ‘রিস্ট স্পিন’-এ। যদি কোনো বাঁ-হাতি রিস্ট স্পিনার লেগ স্পিন করেন, তাহলে তাকে বলা হয় ‘চায়নাম্যান বোলার’। এদের বল ডানহাতি ব্যাটারদের ক্ষেত্রে চলে আসে ভিতর দিকে আর বাঁ হাতি ব্যাটারদের ক্ষেত্রে চলে যায় বাইরের দিকে। ফলে এই বল খেলা যথেষ্ট মুশকিলের কাজ। দক্ষিণ আফ্রিকার চার্লি লিউয়েলিনকে সাধারণত এর জনক হিসেবে ধরা হয়। আশ্চর্যের হলেও সত্যি, ক্রিকেটের ইতিহাসে ‘চায়নাম্যান’ স্পিনার দূরবীন দিয়ে খুঁজতে হয়। কুলদীপ বা ব্রাড হগ পড়েন এই বিরল তালিকায়।
কিন্তু ‘চায়নাম্যান’ কেন? ডান হাতি লেগ স্পিনারও তো বিশ্বে কম নেই। তাহলে বাঁ হাতি বোলারদের জন্যই এই বিশেষ নাম বরাদ্দ কেন? তার কাহিনি জানতে হলে পিছিয়ে যেতে হবে প্রায় একশো বছর আগে। এবং দুঃখজনক হলেও এই নামকরণের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বর্ণবিদ্বেষের ইতিহাস।
১৯৩৩ সাল। ইংল্যান্ডের ওল্ড ট্রাফোর্ডে মুখোমুখি বিশ্ব ক্রিকেটের দুই শক্তিশালী দল— ইংল্যান্ড ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ইংল্যান্ডের হয়ে তখন ব্যাট করছেন ওয়াল্টার রবিন্স। বিপরীতে বল হাতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বাঁ হাতি স্পিনার এলিস এডগার আচং। এমনিতে অফ স্পিনার হিসেবেই পরিচিতি ছিল তাঁর, মাঝে মাঝে লেগ স্পিন করে ফাঁদে ফেলতেন ব্যাটারকে। কিন্তু সেদিন এক অদ্ভুত চাল দিলেন আচং। ফিঙ্গার স্পিনের বদলে মোচড় দিলেন বাঁ-হাতের কবজিতে। অফ স্ট্যাম্পের বাইরে বল পড়তে দেখে এগিয়ে গিয়ে বাউন্ডারিতে পাঠাতে চেয়েছিলেন ওয়াল্টার রবিন্স। অদ্ভুতভাবে সেই বল চলে আসে ভিতর দিকে। বল মিস করে স্ট্যাম্পড হয়ে যান ইংল্যান্ড ব্যাটার।
আউট হওয়ার পরেও যেন কিছুতেই এই ঘটনা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না রবিন্স। প্যাভিলিয়নের দিকে ফেরার পথে গজগজ করে উঠলেন একটি লাইন, “Fancy being done by a bloody Chinaman”। বাংলা করে বলার আর দরকার নেই। যে ভাষাতেই বলা হোক না কেন, ভিতরের বর্ণবিদ্বেষী ভাবটি চাপা থাকে না কোনো মতেই। ব্রিটিশ মিডিয়ার হাত ধরে ক্রিকেটের অভিধানে ঢুকে পড়ে ‘চায়নাম্যান’ শব্দটি। আসলে আচংয়ের জন্ম-কর্ম ত্রিনিদাদ ও তোবাগোতে হলেও তিনি চিনা বংশোদ্ভুত। এক দিক থেকে তিনিই ক্রিকেট জগতের প্রথম চৈনিক খেলোয়াড়। তাঁর জন্ম ১৯০৪ সালে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে আন্তর্জাতিক ম্যাচে অভিষেক হয় ১৯৩০ সালে। ৮টি টেস্টে ৮ উইকেট নিয়ে ক্রিকেট জীবনের পরিসমাপ্তি। তাছাড়া ফুটবলও খেলেছেন দীর্ঘদিন।
ক্রিকেট কেরিয়ার হয়তো আহামরি কিছু নয়। তবু সেদিন রবিন্সের বর্ণবিদ্বেষী উক্তিতে ‘চায়নাম্যান’ হিসেবেই বিখ্যাত হয়ে আছেন তিনি। পরবর্তীতে ব্র্যাড হগ বা কুলদীপ যাদবরা সম্মানের সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে গেছেন এই উপাধির বিশেষত্ব। একশো বছর পরেও ‘চায়নাম্যান’-এর স্পিনের ভেলকিতে হতভম্ব হয়ে যায় ব্যাটাররা। ‘মেড ইন চায়না’-র অপবাদকে একেবারে ক্লিন বোল্ড করে দিয়েছেন এলিস এডগার আচং।
.........................
#chinaman bowler #Ellis Achong #Kuldeep Yadav