নিবন্ধ

‘হাতের উপর হাত রাখা খুব সহজ নয়’: ভার্চুয়াল ক্লাসরুমের পড়াশোনা

রোহিণী সেনগুপ্ত Feb 6, 2022 at 4:34 am নিবন্ধ

ভবিষ্যৎ দেখার যন্ত্র একখানা বানিয়ে ফেললে মনে হয়, বেশ হত! কার সঙ্গে কোন দেখা হওয়াটা শেষবারের মতো হবে, জানা গেলে ২০২০ সালের, ১৭ই মার্চ যখন ক্লাস নিচ্ছি, প্রিয় মুখগুলো আরেকটু সময় নিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নিতাম। হয়তো অসময়ের কোনো মজার কথা বলে আরেকটু হাসিয়ে দিতাম ওদের। সেই হাসির হররায় গমগম করে উঠত ক্লাস ঘর। সেইদিনই সমস্ত কাজ মিটিয়ে বাড়ি ফেরার ঠিক আগে, অনিবার্য কারণবশত আগামী পনেরো দিন স্কুল ছুটি থাকার সেই বিজ্ঞপ্তিটা এসেছিল। ‘লকডাউন’, ‘কোয়ারেন্টাইন’, ‘নভেল কোরোনা ভাইরাস’ এই শব্দগুলো তখনও শুধুই বাতাসের ফিসফাস। সরকারিভাবে সম্পূর্ণ লকডাউন ঘোষণা না হওয়া অবধি তার আঁচ আমাদের গায়ে সরাসরি লাগেনি। কিন্তু এবার লাগল। সেই যে বন্ধ হল স্কুল, ছোটো ছোটো মুঠোগুলোকে স্পর্শ করার অধিকারও বাতাসে বুদুবুদ হয়ে গেল।


পনেরো দিনের ছুটি বাড়তে বাড়তে এক মাস। আরো বাড়তে বাড়তে প্রায় দুমাস পেরিয়ে একদিন ঢুকে পড়লাম ভার্চুয়াল ক্লাসঘরে। দেখা আর শোনার সেই জগতে শুধুমাত্র দেখা আর শোনার কাজটিই যথাযথভাবে চালু রাখতে প্রথম প্রথম বেগ পেতে হল বেশ। জুম-এর দৌলতে ক্লাসগুলোর নাম হয়ে উঠল ‘মিটিং’, আর তার শিরোধার্য সময় মাত্র চল্লিশ মিনিট। সেইসব মিটিং-এর আবার হাজার একটা সমস্যা। 

সদ্য ব্যবহার করতে শেখা জুম ক্লাসে নতুন মিটিং তৈরি করে অপেক্ষা করে আছি। এদিকে বাচ্চাদের কাছে দেওয়া মিটিং আইডি-এর সঙ্গে নতুন মিটিং আইডি মিলছে না। সময় শেষ হয়ে আসছে দ্রুত। বাচ্চাদের দেখা মিলছে না! কখনও আবার বাচ্চারা অন্য কোনো শিক্ষিকা বা শিক্ষকের মিটিং রুমে অপেক্ষা করছে, কোন সময়ের কোন আইডি সেসব গুলিয়ে যাওয়ায়। একটা ক্লিকের পার্থক্যে কখনও ‘অ্যাডমিট’ হয়ে গেছে ‘রিমুভ’। বাচ্চাটি সেই ক্লাসে আর ঢুকতেই পারছে না। কখনও আবার আমি কথা বলে যাচ্ছি। অনেকক্ষণ কথা বলার পর বোঝা গেল আমি ‘মিউট’ করে রেখেছিলাম নিজেকেই। এতক্ষণের এত কথা শুনেছে শুধু আমার ঘরের দেওয়ালরা । তার উপর যদি শাপে বর হয় নেটওয়ার্ক, তবে তো সোনায় সোহাগা। কম্পিউটারের পুরো স্ক্রিন তখন ‘সব অন্ধকার ফুলগাছ’। থেমে থেমে ভেসে আসা কথার অর্থ উদ্ধার করতে ‘মগজাস্ত্র’-ও হার মেনে যাবে। 

প্রথম এক মাসে এমন সব নিত্যনতুন অভিজ্ঞতায় ঝুলি ভরে উঠল। জুম মিটিংকে বাগে আনতে আরও কদিন সময় লাগল। ক্রমশ ‘সময়’ বিষয়টাই কেমন অদ্ভুত হয়ে উঠল। প্রথম প্রথম মনে হত, যেন অন্য কোনো টাইমলাইনে আছি, যেখানে দিনের যেকোনো সময়ই কাজের সময়। ‘রাতের বেলা’ সত্যি সত্যিই এবার ‘দুপুর’ হয়ে উঠল। দুপুর অবধি ক্লাস করে, বিকেলে স্টাফরুমের মিটিং সেরে, সন্ধে থেকে রাত অবধি চলল বাচ্চাদের পাঠানো পিডিএফ-এর সংশোধনের কাজ। দৈনিক কাজের কোনো নির্দিষ্ট বাঁধাধরা সময় আর রইল না। 

এসবই তো গেল যান্ত্রিক নানা গোলযোগের দিক। দেখতে দেখতে একের পর এক ভাইরাস স্ট্রেন আসে, আর সঙ্গে নিয়ে যায় একেকটা শিক্ষাবর্ষ । এমন করেই পার হয়ে গেল দু-দুটো শিক্ষাবর্ষ। বাচ্চারা বন্দী হয়ে রইল ‘ভার্চুয়াল ক্লাসরুমে’, আমরাও বাঁধা রইলাম দূরত্বের খুঁটোয়। এতদিন পরে তাকালে পাঁচ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা মনে হয় দুটো ভিন্নতর জীবন। পুরোনো সেইসব ক্লাসঘরের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে! জীবনকে চেখে দেখার সেইসব বিচিত্র রঙিন অভিজ্ঞতার কথা মনে করে প্রস্তুতি নিই পরবর্তী ‘ভার্চুয়াল ক্লাস’-এর । 

প্রথম শ্রেণির আঁখি। সেদিনের মতো পড়ানোর কাজ শেষ। আঁখি উঠে এসে দাঁড়াল পাশে। ‘ম্যাম! ও ম্যাম!’ চোখ বড়ো বড়ো করে বললাম ‘আঁখি, জায়গা ছেড়ে উঠে এলে কেন?’ ভয় পাওয়া তো দূর, গায়ে গা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে, আমার হাতখানা ধরে নিজের নতুন ওঠা দাঁত দেখিয়ে বলল- ‘দ্যাখো না ম্যাম, আমার দাঁতটাও তোমারই মতো বাঁকা!’ বকা দিতে গিয়ে হেসে ফেলি। 

তৃতীয় শ্রেণির বিশাখা, অয়ন, নৈঋতা। ক্লাস শেষের ঘন্টা পড়লেই ছুটে এসে জড়িয়ে ধরত। তাদের দাবি, ‘আরেকটু থাকো না ম্যাম! ‘রেড রুমের’ গল্পটা আজকে শেষ করে যাও!’ দুহাতে ধরা খাতা, বই, জলের বোতল সামলে পরেরদিন ক্লাসে এসে আগেই গল্প বলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তবে ক্লাস থেকে বেরোনোর অনুমতি পাওয়া যেত। 

লকডাউনে কেমন ছিল প্রথম বিশ্বের লেখাপড়া? পড়ুন - অনলাইন ক্লাসের গল্প: ইচ্ছে আর উপায় // দেবলীনা ত্রিপাঠি

চতুর্থ শ্রেণির রেহান। টিফিনের পরের ক্লাস। জানালার ধারের বেঞ্চে মাথা ঝুঁকিয়ে বসে আছে। বুঝলাম পড়া শুনছে না। কাছে গিয়ে মাথায় হাত রেখে আস্তে আস্তে ডাকি। দেখি তার চোখ ছলছল। শুনি, টিফিনের সময় আবৃত্তি প্রতিযোগিতার অডিশন ছিল। মনোনীত না হওয়ার চেয়েও বেশি ব্যথা লেগেছে টিফিন খেতে না পারায়। আস্তে আস্তে বলি মাথা ঝুঁকিয়েই চুপিচুপি খেয়ে নিতে। রেহান চোখ বড়ো বড়ো করে মুখের দিকে তাকায়। এমনটা শুনবে বলে বোধহয় ভাবেনি। খানিক পর দেখি, ছেলের গাল নড়ছে, ঝলমলে চোখমুখ আর চোখ সোজা বোর্ডের দিকে। 

প্রথম শ্রেণির ক্লাস। বাচ্চাদের বসার জায়গা ওদেরই মাপে। পড়ানোর মাঝখানে হঠাৎ জামায় টান পড়তে ঘুরে তাকাই। দেখি ঋদ্ধি আমার জামার একটা খুঁট এক হাতে ধরে, আরেক হাত আলতো করে বোলাচ্ছে জামার উপর। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘কী হয়েছে, ঋদ্ধি? কী করছ তুমি?’ উত্তর আসে “ম্যাম, তুমি খুব ভালো!” – “কেন?” ঋদ্ধির উত্তরের সারবত্তা থেকে উদ্ধার করি- যাদের জামা খুব নরম, তারা সবাই খুব ভালো! আহারে জীবন! 

মনে পড়ে পুরোনো দিনের এইসব টুকরো টাকরা এলোমেলো স্মৃতি। আর পরের ভার্চুয়াল ক্লাসে চেষ্টা করি অন্তৎ একবার করে সবকটা মুখের সঙ্গে কথা বলতে। ওরা আমায় রিডল ধরে, জোকস শোনায়, ছবি এঁকে দেখায়, নতুন খেলনা গাড়ি কিনলে আমায় তাতে করে ঘুরতে নিয়ে যাবে বলে। আমি শুধু ওদের কথা শুনি। কারও বাড়িতে হয়তো সবাই অসুস্থ। বাচ্চাটি মাস্ক পরে অন্য ঘরে বসে ক্লাস করছে। দুটো হাতের পাতা মুখের নিচে একটা বৃন্তের মতো করে ধরে, আমি তাকে ফুল হওয়া শেখাই। হয়তো সামান্য হেসে ওঠে সে। বুকের ভেতরটা টনটন করে ওঠে। ভীষণ ইচ্ছে করে বাচ্চাটির মাথায় একবার হাত বুলিয়ে দিতে। বলতে ইচ্ছে করে কালকেই সব ঠিক হয়ে যাবে! কিন্তু পারি না। বরং সাইকেল চালাতে গিয়ে আমি আগেরদিন ছাদে কেমন পড়ে গেছি, সেই সব বানানো গল্প শোনাই। স্ক্রিনের ওপারে ওরা হেসে ওঠে। বলে ওরা থাকলে আমায় একদিনে সাইকেল চড়া শিখিয়ে দিত। আরও কত কী যে বলে চলে! আমি শুধু দেখি ওদের হেসে ওঠাটুকু। দেখি! দেখতেই থাকি। দেখা ছাড়া ওদের ছুঁয়ে থাকার আর কোনো উপায়ই আমার এই মুহূর্তে আর জানা নেই বলে! 


(লেখক একটি বেসরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষক)


#lockdown #education #pandemic #covid 19 #online education #quarantine #silly point #রোহিণী সেনগুপ্ত #লকডাউন #অতিমারী #নিবন্ধ #সিলি পয়েন্ট #অনলাইন শিক্ষা #শিক্ষা #বাংলা পোর্টাল

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

39

Unique Visitors

219561