‘নাই বা বুঝুক বেবাক লোক’
“আমার পরম স্নেহভাজন যুবকবন্ধু সুকুমার রায়ের রোগশয্যার পাশে এসে যখন বসেছি এই কথাই বার বার আমার মনে হয়েছে। আমি অনেক মৃত্যু দেখেছি কিন্তু এই অল্পবয়স্ক যুবকটির মতো, অল্পকালের আয়ুটিকে নিয়ে মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে এমন নিষ্ঠার সঙ্গে অমৃতময় পুরুষকে অর্ঘ্যদান করতে প্রায় আর কাউকে দেখি নি। মৃত্যুর দ্বারের কাছে দাঁড়িয়ে অসীম জীবনের জয়গান তিনি গাইলেন। তাঁর রোগশয্যার পাশে বসে সেই গানের সুরটিতে আমার চিত্ত পূর্ণ হয়েছে।”
মারা যাচ্ছেন সুকুমার রায়। যে মানুষটি নিজের ছোটো জীবন ভরে অকারণ, অহৈতুকী হাসি বিলিয়ে গেলেন, তিনি চলে যাচ্ছেন আরেক চির হাসির দেশে। পাশে বসে আছেন আরেকজন মানুষ। রবীন্দ্রনাথ।
পরে তাঁরই আখরে ধরা থাকবে সাতানব্বই বছর আগেকার সেই আশ্চর্য মৃত্যুদৃশ্য। শান্তিনিকেতনের উপাসনায় সেই মৃত্যুর কথাই বলবেন রবীন্দ্রনাথ। যে মৃত্যু রবীন্দ্রনাথকেও নিয়ে গেছে এক পরম উপলব্ধির গহিনে। মৃত্যু তো কম দেখেননি রবীন্দ্রনাথ। পরমাত্মীয়ের। আত্মজ আত্মজার। তবু সুকুমার রায়ের মৃত্যুদৃশ্য কোথায় যেন আলাদা হয়ে যাচ্ছে তাঁর কাছে।
মৃত্যুশয্যায় সুকুমার তাঁর কাছে গান শুনতে চেয়েছিলেন। দুটি গান। প্রথমটি বহুপরিচিত।
“আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে,
তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।”
আরেকটি গান ততটা পরিচিত নয়। তবে সেই গানই সুকুমার শুনতে চাইবেন দু-বার। সে গান কবিতার শরীরে আমরা পড়েছি গীতালি-তে।
“দুঃখ এ নয়, সুখ নহে গো -
গভীর শান্তি এ যে,
আমার সকল ছাড়িয়ে গিয়ে
উঠল কোথায় বেজে।
ছাড়িয়ে গৃহ, ছাড়িয়ে আরাম, ছাড়িয়ে আপনারে
সাথে করে নিল আমায় জন্মমরণপারে--
এল পথিক সেজে।
দুঃখ এ নয়, সুখ নহে গো -
গভীর শান্তি এ যে।
চরণে তার নিখিল ভুবন নীরব গগনেতে
আলো-আঁধার আঁচলখানি আসন দিল পেতে।
এত কালের ভয় ভাবনা কোথায় যে যায় সরে,
ভালোমন্দ ভাঙাচোরা আলোয় ওঠে ভরে,
কালিমা যায় মেজে।
দুঃখ এ নয়, সুখ নহে গো –
গভীর শান্তি এ যে।”
একবার ভাবুন, এঁর নাম সুকুমার রায়! আবোল তাবোল, হযবরল, লক্ষ্মণের শক্তিশেল প্রভৃতি আশ্চর্য সব সুকুমারীয় কীর্তি এঁরই। সুকুমারের আগে বা পরে বাংলা সাহিত্যে ওঁর ঘরানার লেখক খুঁজলেও মিলবে না। সমস্ত পৃথিবীতেও কি মিলবে? তার কারণটাও খুব পরিষ্কার। সুকুমার রায় একজনই হন। কিন্তু একবার এটাও ভেবে দেখুন, যিনি কার্যত ঈশ্বরের মতোই তৈরি করে গেছেন এক অন্য-যুক্তির উদ্ভট জগৎ, পঁয়ত্রিশ বছরের সেই যুবক মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে কতটা শান্ত। কতটা সমাহিত। লেখক সুকুমার রায় আর মৃত্যুশয্যার সুকুমার রায় এই দুজনকে কি আপনি মেলাতে পারছেন? অথবা এদেরই মিলিয়ে নেওয়া যায় এক আশ্চর্য না-যুক্তির যুক্তিতে। যিনি লিখতে পারেন, “মেঘ মুলুকে ঝাপসা রাতে”-এর মতো কবিতা তাঁকেই মানায় গানের পালা সাঙ্গ করে ঘনিয়ে আসা ঘুমের দেশে এমন অনায়াসে পাড়ি জমানো। আসলে আমরা শিশু-সাহিত্যিকের চেনা পরিচয়ের বাইরে অন্য সুকুমারকে দেখতে তেমন অভ্যস্ত নই। কোয়েস্ট পত্রিকার প্রাবন্ধিক, বিলেতের ‘জার্নাল অফ ফটোগ্রাফি’র প্রাবন্ধিক সুকুমারকে আমরা ক-জন মনে রেখেছি? “প্রেমের মন্দিরে তাঁর আরতি বাজে”, “নিখিলের আনন্দ গান এই প্রেমেরই যুগল বন্দনায়”- এইসমস্ত ব্রহ্মসংগীতরচয়িতা সুকুমারও হারিয়ে গেছেন আমাদের মন থেকে।
লীলা মজুমদারের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়, সুকুমারের শেষ দিনগুলো কেটেছিল দীর্ঘ রোগভোগে। হাওয়া পরিবর্তন করেও স্বাস্থ্যের পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু শীর্ণ মুখখানির প্রসন্নতা মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়েও ম্লান হয়নি এতটুকু। লীলা মজুমদার সেসময়ের একটি দিনের স্মৃতিচারণে লিখেছেন, “একদিন ট্যাঁশ গরুর ছবি শুধরোচ্ছেন দেখলাম। একগাল হেসে বললেন, ‘ল্যাজে বোধহয় আরেকটা প্যাঁচ দেওয়া দরকার, কী বলিস?’ আমি বললাম, ‘নিশ্চয়ই।’”
আসলে জীবনের অর্থহীন অর্থকে যিনি খুঁজে পেয়েছেন, মৃত্যু তো তাঁর কাছেই ধরা দেবে অমন অনিবার্য সহজতায়। সুকুমারের মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথ সুপ্রভাদেবীকে স্বহস্তে একটি কবিতা লিখে পাঠান। সে কবিতা তথা গান আমাদের বহুপরিচিত, বহুশ্রুত।
“শেষ নাহি যে, শেষ কথা কে বলবে?
আঘাত হয়ে দেখা দিলে,
আগুন হয়ে জ্বলবে।”
সুকুমারের সত্যিই শেষ নেই। বাংলা ভাষার আয়ুর সঙ্গে সুকুমারের আয়ু জড়িয়ে গেছে অঙ্গাঙ্গী নিবিড়তায়।
সুকুমারের মৃত্যুর ছয় বছর পর তাঁকে প্ল্যানচেটে ডেকেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। দীর্ঘ কথোপকথন হয়েছিল। সেখানেও সুকুমারের আত্মা গান শুনতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের কাছে। ফরমাশ করেছিলেন, “তরী আমার হঠাৎ ডুবে যায়” এই গানের। কিন্তু কথা আর সুর ভুলে যাওয়ায় বৃদ্ধ রবীন্দ্রনাথের পক্ষে সম্ভব হয়নি সেই গান পুরোটা শোনানো। তারপর তিনি সুকুমারকে “অন্ধজনে দেহ আলো” গানটি শোনান।
এই প্ল্যানচেট সেশনে রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও সুকুমারের আত্মার সঙ্গে কথা বলেন অলোকেন্দ্রনাথ এবং অবনীন্দ্রনাথ।
এখানে সুকুমারের আত্মা রবীন্দ্রনাথকে অনুরোধ করেন তিনি যেন সত্যজিৎ রায়কে নিজের আশ্রমে ঠাঁই দেন। রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবি যে এক নতুন যশের পথ খুলে দেবে তাঁর সামনে সে কথা জানান। এমনকি, ব্রাহ্মসমাজের পথ যে ঠিক পথ নয়, এই কথাও উঠে আসে তাঁদের আলাপচারিতায়।
প্ল্যানচেটে আমরা বিশ্বাস করি বা না করি, বাংলা সাহিত্যের দুই অ-পূর্ব স্রষ্টার পারস্পরিক সম্পর্ক খানিকটা হলেও বুঝে নেওয়া যায় এই ঘটনা থেকে। দুজনের মধ্যে বয়সের পার্থক্য নেহাত অল্প নয়। অথচ প্রবীণ রইলেন মর্তলোকে। আর যিনি আক্ষরিক অর্থেই সুকুমার, তিনি পাড়ি দিলেন অমৃতলোকের উদ্দেশে। সেই চলে যাওয়ার সাক্ষী রইলেন প্রবীণ মানুষটি।
গতকাল সুকুমার রায়ের মৃত্যুদিন গেল। সাতানব্বই বছর আগের সেই মৃত্যুতিথিকে ছুঁয়ে দেখার জন্য রবীন্দ্রনাথের মত সহায় আর কে আছেন আমাদের?
আজ যখন দেশের ক্ষমতাসীন দলের মুখপাত্র প্রকাশ্য সংবাদ মাধ্যমে স্পষ্টত বলেন, “বাংলা ভাষার অধিকার নেই, যোগ্যতা নেই”, যখন আমরা দেখি, আমাদের রাষ্ট্র বাংলাকে ধ্রুপদি ভাষার সম্মানটুকুও দিল না, তখন সেই সমাহিত মৃত্যুদৃশ্যের কাছে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। সুকুমার-রবীন্দ্রনাথের বাংলাকে তার যোগ্য সম্মান আমরা দিতে পারিনি। তাই সেই পবিত্র মৃত্যুদিনের কাছে মাথা নিচু করে বার বার ফিরে যাওয়া ছাড়া উপায় কী আমাদের!
#সুকুমার রায় #স্মরণ #শ্রদ্ধা #Sukumar Ray #মৃত্যুদিন #Remembrance #Regards #Feature #ফিচার #বিবস্বান দত্ত