হাথরস যে নতুন ও পুরোনো প্রশ্নগুলি আবার তুলল
ধর্ষণ নিয়ে বহুবার কথা বলা এবং বলে চলার মধ্যে একরকম যন্ত্রণা আছে, যা শুধু মানসিক নয়, শারীরিকও। তবু যেহেতু বলে যেতে হয়, তাই একরকম যান্ত্রিকতা অবলম্বন করতে হয়। অমুক অমুক কথাগুলি আবার মনে করিয়ে দিতে হবে। অমুক অমুক ভ্রান্তি আবার দূর করতে হবে ইত্যাদি।
হাথরস নিয়েই যদি মূলত বলি, তাহলেও কতগুলি সাধারণত ধর্ষণ সংক্রান্ত লেখায় যে কথাগুলি বলতে হয়, সেগুলি ছাড়াও কিছু নির্দিষ্ট প্রসঙ্গ আছে, কিছু পয়েন্ট আছে, যা নিয়ে নির্দিষ্ট আলোচনা প্রয়োজন। প্রতিটি পৃথক নিবন্ধ দাবি করে হয়ত। স্বল্প-পরিসরে যতদূর সম্ভব আলোচনার চেষ্টা করছি।
******
হাথরসের ঘটনার পর একটি মত শোনা গেল। বিজেপির কণ্ঠে সে মত শোনা গেলে আমরা অবাক হই না। কিন্তু এমনকি প্রখ্যাত নারীবাদী লেখিকা তসলিমা নাসরিনও একই মত পোষণ করলে আমরা ব্যথিত হই বটে। প্রসঙ্গটি হল, ধর্ষণে বর্ণভেদের কোনো ভূমিকা কি আছে? উপরি-উক্ত পক্ষদের মতে, নেই। এঁরা কী যুক্তি দিয়েছেন, তা দেখা প্রয়োজন। নাসরিন যা যা বলেছেন তার মূল সুর হল, নারীমাত্রেই কি ধর্ষিতা হয় না? উচ্চবর্ণের নারী ধর্ষিতা হয় না? তাহলে কেন বর্ণ তোলা? বিজেপির বক্তব্যও এক। বর্ণ নিয়ে নাকি অকারণ রাজনীতি করা হচ্ছে।
উচ্চবর্ণের নারী অবশ্যই ধর্ষিতা হয়। সেক্ষেত্রেও অবশ্যই ক্ষমতার আস্ফালন কাজ করে, ধর্ষক নিজের পৌরুষ জাহির করে। নারীকে নিজের থেকে নিচে অবস্থানকারী ভাবছে বলেই সে তার সম্মতির তোয়াক্কা করছে না এবং তাকে যৌনবস্তু মাত্র ভাবছে।
কিন্তু দলিত মেয়ের ধর্ষণের ক্ষেত্রে যে লিঙ্গগত প্রান্তিকতার সঙ্গে বর্ণগত (এবং শ্রেণিগত) প্রান্তিকতাও ইন্টারসেক্ট করছে, তা মেনে নিতে অসুবিধে কি? ইনটারসেকশনালিটি নারীবাদে এই মুহূর্তে বহু আলোচিত। তৃতীয় তরঙ্গ থেকেই তা আলোচনার কেন্দ্রে। হাথরাসের ওই চার যুবকের দলিত-ঘৃণার কথা লোকে জানত।
আর 'রাষ্ট্রীয় সাবর্ণ পরিষদ' ধর্ষকদের সপক্ষে সাংসদের কাছে ডেপুটেশন জমা দেওয়ার পরও সন্দেহের অবকাশ থাকে কী করে যে, বর্ণবাদ ও ধর্ষণ নিয়ে ভারতবর্ষে আলোচনার প্রয়োজন আছে?
কাঠুয়ার নাবালিকাটির ক্ষেত্রে একইভাবে নারী-বিদ্বেষের সঙ্গে ইন্টারসেক্ট করেছিল সংখ্যালঘু-বিদ্বেষ। উল্লেখ করা যায়, গত ৯ই সেপ্টেম্বর জলপাইগুড়িতে দুই আদিবাসী নাবালিকাও ধর্ষিতা হয়েছিল বলে অভিযোগ। তাদের মধ্যে একজন কীটনাশক খেয়ে আত্মহত্যাও করে। অন্যজন কীটনাশক খেলেও বেঁচে যায়। তাদের ও বাড়ির লোকের দাবি, ধর্ষণ হয়েছিল বলেই আত্মহত্যার চেষ্টা। কিন্তু মেডিক্যাল পরীক্ষা নাকি ধর্ষণের যথেষ্ট প্রমাণ পায়নি। এক্ষেত্রে নারীবিদ্বেষের সঙ্গে ইন্টারসেক্ট করেছিল (এবং প্রায়শই করে) আদিবাসী-বিদ্বেষ।
কিছু নীরস তথ্য প্রয়োজনেই দিতে হয়। যোগী আদিত্যনাথের উত্তরপ্রদেশ এমনিতেই ভারতের ধর্ষণকেন্দ্র। উন্নাও-এর দুটি ঘটনা মনে আছে নিশ্চয়। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের NCRB রিপোর্ট অনুসারে উত্তরপ্রদেশ মহিলাদের বিরুদ্ধে হওয়া অপরাধের ক্ষেত্রে ভারতে শীর্ষ স্থানেই ছিল।
কিন্তু একইসঙ্গে, দলিত মেয়েদের বর্ণগত ঘৃণার কারণে ধর্ষণ উত্তরপ্রদেশ-মধ্যপ্রদেশ-গুজরাত-মহারাষ্ট্র-হরিয়ানা জুড়ে প্রায়শই ঘটে। ২০১৯ সালে ডিসেম্বরে গুজরাটে এরকমই এক উনিশ বছরের মেয়েকে ধর্ষণ করে গাছে ঝুলিয়ে দিয়েছিল উচ্চবর্ণের পুরুষরা। ২০১৪ সালে উত্তরপ্রদেশের বাদাউনে দুই দলিত কিশোরীকে ধর্ষণ ও হত্যা করা হয়, কারণ তারা যে উচ্চবর্ণের পুরুষ মালিকের কাছে কাজ করত, তাকে তিন টাকা বেতন বাড়াতে বলেছিল, যে ঘটনার পরোক্ষ উল্লেখ আছে 'আর্টিকল ফিফটিন' চলচ্চিত্রে। ২০১৮ সালের এপ্রিলে মধ্যপ্রদেশের সাতনা জেলায় এক দলিত মেয়ে প্লাস্টিক ব্যাগে ছ মাসের ভ্রূণ নিয়ে থানায় গেছিল। তার মতে ভ্রূণটি ছিল 'প্রমাণ', সে তিনজন বর্ণহিন্দু পুরুষের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ করেছিল। ২০১৬ সালে হরিয়ানায় জাটদের সংরক্ষণ-বিরোধী বিক্ষোভের সময় নজন দলিত নারীকে হঠাৎই বাড়ি থেকে টেনে এনে ধর্ষণ করা হয়৷ কী বলবেন এগুলোকে? এখানে শুধু নারীবিদ্বেষই ফ্যাক্টর? বর্ণবিদ্বেষ নয়?
বিশেষত দলিত নারীটি যদি কোনোভাবে বর্ণবাদী বিধান অমান্য করে, তাহলে প্রতিহিংসা ঘনিয়ে আসেই। নারীকে ধর্ষণ করে উচ্চবর্ণ শুধু দলিত নারীকেই শাস্তি প্রদান করতে চায় না, নিম্নবর্ণের পুরুষকে দেখাতে চায় যে, সে তার নারীকে 'রক্ষা করতে' অক্ষম। এভাবেই বর্ণবাদী পৌরুষের অহং প্রতিষ্ঠা পায়। ২০১৬ সালের NCRB রিপোর্ট অনুযায়ী, শিডিউল্ড কাস্টের প্রতি অপরাধের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক অপরাধ ঘটেছে শিডিউল্ড কাস্ট নারীর প্রতি এবং তা যৌন প্রকৃতিরই। ২০১৬ সালের তথ্যে প্রতিদিন চার জন দলিত নারীর ধর্ষণ দেখা যাচ্ছে। এও যেন যথেষ্ট ছিল না! তাই সেই সংখ্যাও ধীরে ধীরে বেড়েছে। সাম্প্রতিক তথ্যে দেখা যাচ্ছে সংখ্যাটা আট। 'দ্য ন্যাশনাল ক্যাম্পেইন এগেনস্ট দলিত হিউম্যান রাইটস' নামক এনজিও-র তথ্য অনুসারে, ২৩% দলিত নারী ভারতে ধর্ষিত হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এইসব ধর্ষণ সামাজিক কলঙ্কের ভয়ে নথিভুক্তই হয় না। হলেও বর্ণবাদী পুলিশ ও প্রশাসন তৎপর হয় না।
*****
এবারে আসি, দ্বিতীয় প্রসঙ্গে। ডাক্তারি পরীক্ষা ও ধর্ষিতা।
ধর্ষিতার টু ফিঙ্গার টেস্ট করানো হত এককালে, তার ধর্ষণ হয়েছে কি না বোঝার জন্য। দেখা হত হাইমেন আছে কি না, যদিও হাইমেন ছিঁড়তে পারে শুধু যৌন সম্পর্কে নয়, সাইকেল চালালে বা গাছে চড়লেও। তার থেকেও বড় কথা, এই পরীক্ষার দ্বারা ধর্ষিতার ব্যক্তিগত যৌন যাপন সম্পর্কেও কিছু সিদ্ধান্তেও আসা হত। সোজা কথায় তার যোনিপথ কতটা উন্মুক্ত হয়েছে, তাও দেখা হত। যেন ব্যক্তিগত যৌনজীবন থাকলেই, ধর্ষণ হতে পারে না, বিশেষত অবিবাহিতদের। এই পরীক্ষা ছিল যেমন অবমাননাকর, তেমনই অপ্রয়োজনীয়। নারীবাদীরা তো একমাত্র 'সম্মতিবিহীনতা'-র উপরেই জোর দেন, ধর্ষিতার যোনিপথের মাপজোকের উপর বা তার যৌন জীবনের উপর নয়। সেই নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা থাক৷ কিন্তু দেশের আইনটি অন্তত জানা প্রয়োজন। ভার্মা-কমিশন-উত্তর সময়ে ভারতীয় ধর্ষণ আইনের সংস্কার হয়েছে এবং সে নতুন আইন অনুযায়ীও 'কনসেন্ট'-এর উপরেই জোর দেওয়া হয়। এবারের ঘটনাটিতে টু ফিঙ্গার টেস্ট-এর কথা আমরা খবরের কাগজে দেখতে পাইনি। তার কারণ সুপ্রিম কোর্ট ধর্ষণের ক্ষেত্রে তাকে ব্যান করেছে ওই ২০১৩ সালেই। তাহলে কেন তার প্রসঙ্গ তুললাম? ধর্ষিতার কী ধরনের অবান্তর ডাক্তারি পরীক্ষা হয়, তার ইতিহাসটি বর্ণনা করার জন্য।
এবারে যে 'ডাক্তারি পরীক্ষা'-র ভিত্তিতে হাথরসের এ.ডি.জি ও পরবর্তীকালে আরও নানা জন দাবি করেছে, মেয়েটির ধর্ষণ হয়নি, তা যোনিতে বীর্য খোঁজার পরীক্ষা। এই সম্পর্কেও ধারণা স্বচ্ছ হওয়া দরকার।
১) উক্ত পরীক্ষাটি হয়েছে এগারো দিন পর,যখন যোনিতে বীর্য পাওয়ার সম্ভাবনা শূন্যের কাছাকাছি। কেন? পুলিশ বলছে, তার আগে মেয়েটি ধর্ষণের কথা বলেনি। পরিবারের দাবি, সে প্রথম দিন থেকেই তা বলেছে। এগারো দিনের মাথায় কেন এরকম পরীক্ষা করা হয়? ধর্ষণ প্রমাণ করতে, না ধর্ষকদের বাঁচাতে?
২) বীর্যের উপস্থিতি যোনিতে কতদিন থাকে? বড়জোর তিনদিন, তাও যদি মেয়েটি তার গোপনাঙ্গ না ধুয়ে থাকে,স্নান না করে থাকে। যদি সার্ভিক্সকে ডায়লেট করে অনেকটা ভিতর থেকে নমুনা নেওয়া হয়? তাহলেও ৫-৬ দিন পর্যন্ত বীর্যের উপস্থিতি পাওয়া যেতে পারে। সে জায়গায় এগারো দিন পরে! কেন?
৩) বীর্যের উপস্থিতি প্রমাণের ভূমিকা কী? অন্তত বোঝা যায়, যৌন কার্যটি হয়েছিল। বীর্যের নমুনা পরীক্ষা করে ব্যক্তি/ ব্যক্তিদেরও শনাক্ত করা সম্ভব। কিন্তু তারপরেও ধর্ষক পক্ষের উকিল দাবি করতে পারে, তা সম্মতিক্রমে হয়েছিল। অর্থাৎ আবারও অন্যান্য প্রমাণ( যেমন টানাহেঁচড়া, শারীরিক ভাবে জোর করা, কোনও হুমকির ইতিহাস ইত্যাদি) হাজির করে সাব্যস্ত করতে হয় যে ধর্ষণই হয়েছে। কারণ, ধর্ষণে 'অসম্মতি' প্রমাণ করাটাই আসল কাজ। সম্মতিতে যৌনতা হয়েছে না অসম্মতিতে– এই নারীবাদী প্রশ্নেই আসলে আবর্তিত হয় ধর্ষণ।
৪) এ ছাড়া আরও একটি কথা বলা প্রয়োজন। উপরি-উক্ত ২০১৩ সালে নতুন ধর্ষণ আইন মোতাবেক শুধু যোনিতে লিঙ্গ প্রবেশ করানোই ধর্ষণ নয়। যে-কোনো জায়গায় (মুখেও,পায়ুতেও), যে-কোনো কিছু (এমনকি শারীরিক অঙ্গ ছাড়া অন্য কিছুও) প্রবেশ করালেও ধর্ষণ হয়। তাহলে যোনিতে বীর্য না পাওয়া গেলেও ধর্ষণ হয়।
এসব কিছু পুলিশ-প্রশাসনের অজানা নয়। তাহলে তারা ভুল সময়ে বীর্যের পরীক্ষা করে কেন প্রমাণ করতে চায় যে ধর্ষণ হয়নি?
******
বিজেপি বিধায়ক সুরেন্দ্র সিং হাথরস সম্পর্কে যা বলেছেন, সেটিও একটি প্রসঙ্গ বটে, তবে নতুন প্রসঙ্গ নয়। তিনি বলেছেন, ধর্ষণ আইন করে কমবে না। লাঠি মেরেও কমবে না? বেশ কথা। এর পরে কী বলতে পারেন? ছেলেদের লিঙ্গসাম্যের শিক্ষা দিলে তা কমবে? নাঃ, তা দুরাশা। তিনি বলেছেন, ধর্ষণ কমবে মেয়েদের সঠিক 'সংস্কারের' শিক্ষা দিলে।
বিজেপি এখন নারীবিদ্বেষের নমুনা রোজই হাজির করবে, কিন্তু ভিক্টিম ব্লেমিং নতুন কিছু নয়। এই আমাদের 'ধর্ষণ সংস্কৃতি'। পরিভাষাটি শুনতে অক্সিমোরোনিক লাগে অনেকের। সংস্কৃতি মানে আমাদের কাছে, যা কিছু পরিশীলিত– আমাদের ধর্ম, ভাষা, সাহিত্য, সিনেমা, সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান– এসব নিয়ে আমাদের সংস্কৃতি। আর ধর্ষণ আমাদের কাছে জান্তব কোনও ব্যক্তির দ্বারা কৃত এক ঘৃণ্য অপরাধ। তাই আমরা ভাবি ফাঁসি বা এনকাউন্টারেই এই 'সংস্কৃতি বহির্ভূত' বিষয়ের পরিসমাপ্তি হবে। ভুল ভাবি। ধর্ষণ ব্যক্তির বিকৃতি নাকি সমাজব্যবস্থা-উদ্ভূত অপরাধ– এটা পুরোনো তর্ক৷ ব্যক্তির বিকৃতি ধরে নিয়েই ধর্ষককে আদারাইজ করা হয় এবং তাকে ফাঁসি বা এনকাউন্টার করলে প্রাণ জুড়োয় জাতির। কিন্তু পরের ধর্ষণটি হয়তো সেদিনই ঘটে আর আমরা আবার আদারাইজ করি। এভাবে চলতেই থাকে স্টেটাস কো। আর আমাদের সাধের সংস্কৃতি, ধর্ম,সাহিত্য, সিনেমা– সবই ধর্ষণকে, সম্মতির অপ্রয়োজনীয়তাকে তথা লিঙ্গবৈষম্যের নানা রূপকে 'প্রোমোট' করে চলে। আমাদের চিন্তনে বাসা বেঁধে আছে লিঙ্গবৈষম্য, যা থেকেই ধর্ষণ জন্ম নেয়। তাই ধর্ষণের নানা অদ্ভুত সমাধান শোনা যায়, যেমনটা সম্প্রতি শোনা গেছে বিধায়কের মুখে।
ধর্ষণ সংস্কৃতি প্রসঙ্গে নানা জায়গায় আগে এত লিখেছি, যে, নতুন করে আর কী বলব? 'কুইন্ট'-এর ভিডিওটি হয়তো আপনারাও দেখেছেন। হরিয়ানার আট থেকে আশি সকলেই বলছেন, ধর্ষণের দায় মূলত মেয়েদের। প্রত্যয়ের সঙ্গে বলছেন 'এক হাতে তালি বাজে না’। ব্যক্তিগত ক্লিনিকাল বিকৃতি ধরলে তাঁদের সবাইকে মানসিক রুগি ধরতে হয়। কিন্তু আসলে তাঁরা রেপ-কালচারের মধ্যে বসবাস করছেন।
মধুমিতা পান্ডের সার্ভেটির কথাও হয়তো অনেকেই জানেন। তাও সংক্ষেপে বলি। তিহার জেলে মধুমিতা পান্ডে একটি সার্ভে করেছিলেন সাজাপ্রাপ্ত একশো কুড়িজন ধর্ষককে নিয়ে। তাদের কারও মধ্যে কোনও অনুশোচনা ছিল না বলে জানা যাচ্ছে। 'শি ডিজার্ভড ইট', 'শি আস্কস ফর ইট' মানসিকতাই সর্বব্যাপী ছিল, এমনকি সাজা পাওয়ার পরেও। এই গল্পে একটা টুইস্টও আছে। একজন মাত্র মানুষ অনুশোচনায় কাতর ছিলেন, তিনি এক নাবালিকাকে ধর্ষণ করেছিলেন। অনুতাপ হচ্ছিল বলে 'প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে' তিনি তাকে বিয়ে করতে চাইছিলেন৷ এই পদক্ষেপই নাকি ধর্ষিতাকে 'রক্ষা' করবে। এই সমাধান কিন্তু নানা রাজ্যের খাপ পঞ্চায়েতও দিয়েছে নানা সময়ে।
এর থেকেও কি বোঝা যায় না, ব্যক্তির কোনও ব্যক্তিগত বিকৃতি দিয়ে ধর্ষণকে ব্যাখ্যা করা যায় না? বিকৃতি তো বটেই, কিন্তু সেই বিকৃতি সমাজমানসের, রেপ কালচারের মূলত।
******
ধর্ষণোত্তর হত্যার ঘটনা নিয়েও আলোচনা প্রয়োজন। একসময় মনে করা হত, ধর্ষণের পরে অবশ্যই মেয়েটি লজ্জায় চুপ করে থাকবে। থানায় অভিযোগের সংখ্যা ছিল আরও কম। আদালতেও বিশেষ কিছু প্রমাণ করা যেত না। তাই অন্তত ধর্ষণের পর মেয়েদের মেরে ফেলা হত কম৷ কিন্তু ২০১৩ সালের নতুন আইনের পর হত্যার সংখ্যা বেড়েছে ধীরে ধীরে। তা ধর্ষণ নিয়ে মুখর হওয়ার শাস্তি। এভাবে চুপ করানো যাবে কি?
২০১৮ সালের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর নথি বলছে, ধর্ষণ করে খুন করার সংখ্যা সে বছরই বেড়েছিল ৩১%। ২০১৭ সালে সেই সংখ্যা ছিল ২২৩, ২০১৮ সালে বেড়ে হয়েছিল ২৯১। 'ব্যুরো অফ পুলিস রিসার্চ অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট'-এর এক অফিসার বলেছিলেন, 'সঠিক কারণ বলা সম্ভব নয়, কিন্তু হয়তো ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড এড়াতেই মেয়েটিকে সরিয়ে দেওয়া হয়। আরও তথ্য প্রয়োজন এই তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য।' ২০১৩ সালে ধর্ষণ আইনের সংস্কারের সময়ও অ্যাক্টিভিস্টরা এই আশঙ্কাই করেছিলেন।
ধর্ষিতাদের মধ্যে বেশিরভাগই ধর্ষণের পর থানায় যান না । 'জাতীয় স্বাস্থ্য সার্ভে' অনুযায়ী ভারতে ৮০% ধর্ষিতা ধর্ষণের কথা স্রেফ চেপে যান। লজ্জায় তো বটেই, খুনের ভয়েও। যাঁরা যান না, তাঁদের মধ্যে আবার প্রান্তিক, বিশেষত শিডিউল্ড কাস্টের মেয়েদের সংখ্যা বেশি৷
আমরা নির্ভয়ার ধর্ষণে কেঁপে উঠেছি। কিন্তু একটি ঘটনা জাতিকে আন্দোলিত করলে যেহেতু সমজাতীয় আরও অনেক ঘটনা খবরের কাগজে উঠে আসে, তাই সেরকম ক্ষুদ্রান্ত্র উপড়ে নেওয়ার ঘটনা আমরা আরও জানলাম অনেক৷ কাঠুয়ার ঘটনাতেও মেয়েটিকে লাগাতার ধর্ষণের পর নির্মমভাবে হত্যা করা হল। উন্নাওতে একটি ধর্ষণে ধর্ষক ছিল স্বয়ং বিজেপি এমপি। একাধিক বার মেয়েটিকে খুন করার চেষ্টাও হয়। মেয়েটির বাবাকে হত্যা করা হয় অস্ত্র-আইনে ফাঁসিয়ে লক-আপে নিয়ে গিয়ে। মেয়েটিকে পিষে দিতে আসে নাম্বারপ্লেটহীন লরি। দ্বিতীয় ঘটনায় জামিনে মুক্ত ধর্ষকরা উন্নাওতেই ধর্ষিতাকে জ্বালিয়ে দেয়। হায়দ্রাবাদের ঘটনার পর একাধিক ঘটনার কথা জানা যায়, যেখানে ধর্ষণের পরে ধর্ষিতাকে স্রেফ পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। আগেই বলেছি, দলিত-আদিবাসীদের ধর্ষণ প্রথমে আসত না প্রায়শ প্রথম পাতায়, বিশেষত হাথরসের আগে। কিন্তু বাদাউন থেকে কুশমুন্ডি, ধর্ষণ করে হত্যা তাঁদের ক্ষেত্রেও চলছিলই। এটাই কি নিউ নর্মাল?
আবার এ কথাও অনস্বীকার্য যে, যে ধর্ষণগুলির পর হত্যা করা হয় বা হত্যার চেষ্টা করা হয় ধর্ষিতাকে, বা অতিরিক্ত নির্মমতার কারণে মেয়েটি মারা যায়, সেই ধর্ষণগুলোই আসলে আলোচনার কেন্দ্রে আসতে সক্ষম হয়। এ দেশে প্রতি সতেরো মিনিটে একটি ধর্ষণ ঘটে যে!
মৃত্যু ঘটেনি যেখানে, সেইসব ক্ষেত্রে হয়তো আদৌ ধর্ষণ হয়েছে কি না, তা বিচার করতেই ব্যস্ত হয়ে ওঠে আদালত ও 'ধর্ষণসংস্কৃতি'-তে দীক্ষিত সমাজ। এ ভারী দুর্ভাগ্যের।
*********
পঞ্চম প্রসঙ্গটি অবশ্যই রাষ্ট্রের ভূমিকা সংক্রান্ত। ধর্ষিতাকে মেরে ফেলছেন ব্যক্তি ধর্ষক, এমন ঘটনা আগেও ঘটছিল। কিন্তু হাথরস দেখাল, মৃত্যুর পরে ধর্ষিতার উপর ঘটা অত্যাচারের অভিজ্ঞতাকে 'নিশ্চিহ্ন' করার দায়িত্ব নিচ্ছে স্বয়ং রাষ্ট্র। পুলিশ রাতারাতি তৎপর হয়ে শবদেহ জ্বালিয়ে দিচ্ছে গমখেতে। অর্থাৎ মৃত্যু-পরবর্তী সময়ে হারবার্টের মতোই ওই ধর্ষিতার লাশ বিস্ফোরণ সম্ভাবনাময় হয়ে উঠেছিল। ডিজি, এডিজি, ইন্সপেক্টর, কনস্টেবল– কেমন সব একই সূত্রে গাঁথা, কেউ অন্যরকম কিছু বলে না বা করে না।
তারপর এডিজি ধর্ষণ অস্বীকার করল, কারণ এগারো দিন পর যোনিতে বীর্য পাওয়া যায়নি। এ বক্তব্য যে কত অসার, তা আগেই আলোচনা করেছি।
হাথরসের জেলাশাসক হঠাৎ বর্ডার সিল করে দিল। বিরোধী দল ঢুকতে পেল না। ঢুকতে পেল না মিডিয়া। প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা। কেন গোপনীয়তা? এই জেলাশাসককেই আবার এক ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে মৃতার বাবাকে হুমকি দিতে– মিডিয়া চলে যাবে, কিন্তু ওই পরিবারকে ঘর করতে হবে তাদের সঙ্গেই। এর পরেও কেন ভয় পাবে না পরিবার? বলবে না, তাদের সিবিআই তদন্তেও ভরসা নেই? তারা স্রেফ গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে চায়? এলাহাবাদ কোর্ট হয়তো 'জবরদস্তি দাহ' নিয়ে সুয়োমোটো কেস করেছে, সিবিআই তদন্ত চেয়েছে, কোর্টের চাপে হয়তো পুলিশবাহিনীকে সাসপেন্ড করতে বাধ্য হয়েছে সরকার। কিন্তু তারপর? পরের ঘটনাগুলো আবারও হতাশাজনক। একটি নতুন এফআইআর করে পুলিশ ও সরকার দাবি করেছে, নির্ঘাত কোনও 'আন্তর্জাতিক চক্রান্ত' মৃতার পরিবারকে প্রভাবিত করছে। অর্থাৎ ধর্ষণ হতেই পারে,কিন্তু তা নিয়ে হইচই হলে তা 'আন্তর্জাতিক চক্রান্ত?'
এর পরে এসেছে নার্কো টেস্টের নির্দেশ। পুলিশ ও ধর্ষিতার পরিবার উভয়েরই নাকি নার্কো টেস্ট হবে। মানবাধিকার কর্মীদের মতে নার্কো টেস্ট নিজেই অতি অসংবেদনশীল। কিন্তু ধর্ষিতার পরিবারের নার্কো টেস্ট? এ নীচতা ভারতে এই প্রথম। ভিক্টিমের বা তার পরিবারের লাই ডিটেকশন টেস্ট মানে হল 'রিভিক্টিমাইজেশন'। আসলে রিভিক্টিমাইজেশন খুব প্রচলিত। ব্যক্তি হিসেবে আরও অনেকে ধর্ষিতাকে অবিশ্বাস ও ধর্ষিতাকে দোষারোপ দিয়েই শুরু করেন। তাকেই তো 'ভিক্টিম ব্লেমিং' বলে। এক্ষেত্রে শুধু নতুন ব্যাপার হল, ব্যক্তির সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রও অবিশ্বাস আর ভিক্টিম ব্লেমিং-এর পুরোদস্তুর দায়িত্ব নিয়েছে। কেন মৃতার বাবা ও পরিবারকে দিয়ে বিবৃতি সই করিয়ে নেওয়া হয় যে, তারা সরকারের ভূমিকায় খুশি? কেন পুলিশ বলে ধর্ষণ হয়নি, শুধু খুন হয়েছে? কারণ ধর্ষণের ঘটনার 'নর্মালাইজেশন' ঘটানোকে রাষ্ট্র এখন নিজ দায়িত্ব মনে করছে। রাষ্ট্রই এখানে স্বয়ং পিতৃতন্ত্র। তাদের আলাদা করা যাচ্ছে না। অথচ এ রাষ্ট্রের সংবিধানের ১৪-১৮ নম্বর ধারায় ছিল লিঙ্গ-শ্রেণি-বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে সাম্যের আশ্বাস।
রাষ্ট্র চায় না ধর্ষিতা ও তার আত্মীয়পরিজনদের স্বর কেউ শুনতে পাক। তারা নিজেরাও তা শুনতে চায় না। তারা সেই স্বর স্রেফ নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায়।
কিন্তু কিছু স্বর তাও বড় তীব্র।
'কেন ওরা জোর করে পুড়িয়ে দিল? হিন্দু ধর্মে তো রাতে সৎকার হয় না!'– বলছেন মেয়েটির বাবা।
'ওরা বলছে ধর্ষণ হয়নি। কিন্তু আমি তো ওকে নিজে খেতে খুঁজে পেয়েছিলাম। ওর নিম্নাঙ্গ রক্তে ভেসে যাচ্ছিল। শরীরে কাপড় ছিল না। আমি নিজে কাপড়-ঢাকা দিয়েছি।'– বলছেন ধর্ষিতা ও মৃতার মা।
রাষ্ট্র নিদ্রা গিয়েছেন। নাগরিক কি শুনতে পাচ্ছে? তার দায়িত্ব বোধহয়, এই স্বরদের নিশ্চিহ্ন না হতে দেওয়া।
[পোস্টার : অর্পণ দাস]