বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

স্নায়ু ও শিল্পের সংলাপ : সান্তিয়াগো রামন কাহাল

সিদ্ধার্থ মজুমদার May 3, 2022 at 10:14 am বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

ছেলেটির জন্ম ও বেড়ে ওঠা স্পেনের উত্তরে পাহাড় ঘেরা একটি ছোট্ট গ্রামে। অপরূপ সৌন্দর্য আর পরিবেশ সেই গ্রামের। ঠিক যেন ছবির মতন। মাথার ওপর মেঘের ভেসে যাওয়া আর পাহাড়ি গাছ গাছালি, ফুল, পাখি ।

ছেলেটির ছবি আঁকার হাতটিও চমৎকার। চোখের সামনে প্রকৃতির ওই রূপ-রং-রস সব ফুটে ওঠে ছেলেটির ক্যানভাসে। চারপাশে যা দৃশ্যমান তাই সে এঁকে রাখে। ছবি আঁকার পাশাপাশি ছিল ফোটোগ্রাফিতেও তার খুব আগ্রহ।  ছোটোবেলা থেকেই ইচ্ছে ছিল একদিন সে চিত্রশিল্পী হবে।

ছেলেটির চিত্রশিল্পী হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হয়নি। একেবারেই যে পূরণ হয়নি, তা-ও অবশ্য বলা যায় না। শিল্পকলা নয়, পরবর্তী জীবনে ‘নিউরো-বায়োলজি’র গবেষণা হবে তাঁর কাজের জায়গা। চিত্রশিল্পী না হয়েও আজীবন অঙ্কনচর্চা তাঁর সঙ্গী হয়েছিল। কীভাবে বিজ্ঞান আর শিল্পকলা এই আপাত দুই মেরুর সহাবস্থান সম্ভব করেছিলেন তিনি, তা আমরা এই লেখায় জানব। 

ছেলেটির নাম সান্টিয়গো রামন কাহাল (Santiago Raman Y Cajal)।  তীব্র ভালোবাসা এবং প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও কেন কাহালকে ছবি আঁকার জগত থেকে দূরে থাকতে হয়েছিল ছেলেবেলায়? এর উত্তর জানতে আমাদের কাহালের বাবার কথা জানতে হবে। 

কাহালের বাবা ছিলেন খুব কড়া ধাতের মানুষ। সব ব্যাপারেই ছিলেন দারুণ নিয়মনিষ্ঠ। তাঁর কঠোর শাসনে বাড়ির সবাই তটস্থ হয়ে থাকত। কাহালের বাবা নিজে বারো বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে আসেন এবং তারপর একজন সেনাবাহিনীর চিকিৎসকের কাছে শিক্ষানবিশী হিসেবে কাজ শেখেন। পরে ডাক্তারি পাশ করেছেন। চিকিৎসক বাবার কাছে ‘কাজ’ ছাড়া বাকি সব কিছুই ছিল অপ্রয়োজনীয় আর সময় নষ্ট। তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষের মগজ শুধু ‘জ্ঞান’ বৃদ্ধি করার জন্যে। তাঁর কাছে বিনোদন বা মনোরঞ্জনের কোনও জায়গা ছিল না। তাই বাড়িতে কোনো গল্প, রূপকথা, ফিকশনধর্মী বা ছবির বই ছিল নিষিদ্ধ। তাঁর কাছে বই মানেই ছিল চিকিৎসাবিদ্যা সংক্রান্ত। যদিও কাহালের মা গোপনে কাহালকে রূপকথা ও অন্যান্য গল্পের বই এনে দিতেন পড়ার জন্যে। 

কাহালের বাবা ভাবতেন ছবি যারা আঁকে তাঁরা মানসিক বিকারগ্রস্থ। তাই যখন শুনলেন ছেলে ছবি আঁকায় ডুবে আছে, ছেলেকে ডেকে বললেন - ‘ছবি এঁকে কিচ্ছু হবে না’। এরপর আর দেরি না করে পরের দিনই ছেলেকে জুতো তৈরি করার কাজে শিক্ষানবিশ হিসেবে যুক্ত করে দিলেন। কিন্তু ছবি আঁকার প্রতি যে তীব্র ভালোবাসা গড়ে উঠেছিল, তা কি অত সহজে মিলিয়ে যেতে পারে? যায়ওনি। কাহালের ছবি আঁকার প্রতিভা আর ড্রাফটসম্যানশিপ কুশলতা পরবর্তী জীবনে দারুণভাবে সহায়ক হয়েছিল। বস্তুত তাঁর আঁকা ছবি হয়ে উঠেছিল তাঁর কাজের পরিপূরক। 

বাবার ইচ্ছানুযায়ী চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়ে পড়তে হয় কাহালকে। ডাক্তারি পাশ করার পর তিনি মেডিকেল অফিসার হিসেবে সেনাবাহিনীতে নিযুক্ত হন। পরে সেনা বিভাগ থেকে অ্যাকাডেমিক্সে আসেন এবং শারীরতত্ত্বের অধ্যাপক হন। অধ্যাপনার পাশাপাশি শুরু হয় তাঁর গবেষণা। সামরিক বিভাগে নিজের মাইনে জমানো টাকায় একটি সস্তার মাইক্রোস্কোপ কিনে সেটি দিয়ে শুরু করেন গবেষণা। বছর দশেক পরে তাঁর কাজের দক্ষতা এবং সাফল্যের জন্যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কাহালকে একটি উন্নতমানের মাইক্রোস্কোপ দেওয়া হয়। তারপর নতুন উদ্যমে শুরু হয় অনুসন্ধান। বার্সেলোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরে মাদ্রিদ বিশ্ববিদ্যালয়ে হিস্টোলজিক্যাল এবং প্যাথোলজিক্যাল অ্যানাটমি বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হলেন। শুরু হল মানুষের ব্রেনের গভীরে কীভাবে কাজকর্ম চলে তা নিয়ে গবেষণা। তাঁর হাত ধরেই গড়ে উঠবে 'নিউরো সায়েন্স'। পরবর্তীকালে নিউরো সায়েন্সের জনক হিসেবে মান্যতা দেওয়া হয়েছে তাঁকে। 

নার্ভকোশ তথা নিউরনই যে আমাদের ব্রেন, স্পাইন্যাল কর্ড এবং নার্ভাস সিস্টেমের মূল একক এবং ভিত্তি তা কাহাল-ই শিখিয়েছেন। নিউরনগুলি নিজেদের মধ্যে কীভাবে সংযোগ স্থাপন করে, তা তিনিই আবিষ্কার করেন। তিনিই বলেছিলেন, নিউরনগুলি সংযোগস্থলের সূক্ষ্মতম জায়গায় তড়িৎ সংবহনের কাজ করে। কীভাবে এগিয়েছিল তাঁর এই যুগান্তকারী গবেষণার কাজ তা সংক্ষেপে বোঝার চেষ্টা করব।

এখানে কামিল্লো গলজি-র কথা আসবে। তিনি ছিলেন ইতালির বায়োলজিস্ট এবং প্যাথোলজিস্ট। সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম নিয়ে ছিল তাঁর গবেষণা। আমরা যে সময়ের কথা বলছি, তার দশ-বারো বছর আগে একটি ‘স্টেনিং’ পদ্ধতি উদ্ভাবিত (১৮৭০) করেছেন গলজি। এই পদ্ধতিতে ‘সিলভার নাইট্রেট’ ব্যবহার করে স্নায়ুকোশগুলিকে রঙিন করা সম্ভব, যার ফলে মাইক্রোস্কোপে সুস্পষ্ট ভাবে দৃশ্যমান হয়। গলজি-উদ্ভাবিত এই স্টেনিং পদ্ধতির কথা কাহাল জানতেন। গলজির স্টেইন করার ওই পদ্ধতিটি তাঁর কাজের উপযোগী করে ‘ব্রেন কোশ’ নিয়ে নিবিড় অনুসন্ধান চালালেন কাহাল। তখন ১৮৮৭ সাল। মাইক্রোস্কোপের লেন্সে চোখ রেখে মগজ কোশের অন্দরমহলে কী কী দেখছেন, প্রতিটি বিষয় ‘নোটবুকে লিপিবদ্ধ করে রাখছেন কাহাল। দিনের পর দিন চলল দৃষ্টান্তমূলক এই অনুসন্ধান। এভাবেই তিনি প্রমাণ করলেন নার্ভাস সিস্টেমের ‘নার্ভকোশ’-ই হল মূল একক।  

খাতায় সেই পর্যবেক্ষণের নোট নেবার পাশাপাশি সব মিলিয়ে হাজারের বেশি ছবি এঁকে রেখেছেন কাহাল। প্রতিটি আঁকাই বিজ্ঞানের দিক থেকে একেবারে পুঙ্খানুপুঙ্খ এবং শিল্পের দিক থেকে দেখলেও অত্যন্ত উন্নত মানের চিত্রশিল্প। ব্রেনের গঠন এবং কার্যকলাপ সম্পর্কে সুষ্পষ্ট ধারণা দেয় কাহালের আঁকা প্রতিটি ছবি। 

মনে রাখতে হবে কাহাল যে সময় এই কাজ করেছেন তখন এখনকার মতন উন্নত মাইক্রোস্কোপ ছিল না, যা দিয়ে সহজেই দ্রষ্টব্য বস্তুর ছবি তোলা যায়। ঠিক এখানেই তিনি কাজে লাগিয়েছেন তাঁর শিল্পীসত্তাকে। একদিকে লেন্সে চোখ রেখে প্রতিটি পর্যবেক্ষণ লিপিবদ্ধ করা, অন্যদিকে তাদের নিপুণ ড্রয়িং। চাইনিজ ইংকে আঁকা খয়েরি আর কালো রঙের নার্ভ কোশের শাখা প্রশাখা আর তার সঙ্গে স্বচ্ছ হলদেটে ব্যাকগ্রাউন্ড। সব মিলিয়ে এগুলি যেন উন্নতমানের আলোকচিত্রকেও হার মানায়। শিল্পীর চোখ আর বিজ্ঞানীর চোখ যখন একসঙ্গে দৃষ্টিপাত করে, তখনই এমন এক-একটি অনবদ্য সৃষ্টি সম্ভবপর হয়। 

বলা দরকার যে কাহালের আগে স্নায়ুতন্ত্র তথা নার্ভাস সিস্টেম সম্পর্কে ধ্যানধারণাটা ছিল আলাদা। উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে নিউরো-সায়েন্টিসরা নার্ভাস সিস্টেমকে মাছ ধরার জালের মতন মনে করতেন। তা যেন একটি নিরবচ্ছিন্ন ব্যবস্থা। গলজি-ও এই ধারণায় বিশ্বাস করতেন। কিন্তু কাহাল সম্পূর্ণ অন্য এক সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন। ব্রেনের বিভিন্ন অংশ মাইক্রোস্কোপের তলায় রেখে তিনি বুঝলেন যে ‘নার্ভাস সিস্টেম’ মোটেই মাছ ধরার জালের মতন একটা গোটা ব্যবস্থা নয়। প্রত্যেকটি নিউরনের আলাদা আলাদা অস্তিত্ব আছে। একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত অবস্থায় চেইনের মতন সার্কিট সৃষ্টি করে ওরা। পূর্বসূরিদের ভ্রান্ত ধারণা ভেঙে দিয়ে কাহাল-ই প্রথম বললেন, নিউরনই হল ব্রেন, স্পাইনেল কর্ড এবং নার্ভাস সিস্টেমের বিল্ডিং ব্লক। যারা নিজেদের মধ্যে সংযোগ রক্ষা করে চলে। যদিও কাহালের গবেষণার প্রামাণিক সত্যতা তখনও পাওয়া যায়নি। পাওয়া গেল তারও কয়েক দশক পরে, ১৯৫০ এর দশকে। ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ আসার পরেই বোঝা গেল কাহালের পর্যবেক্ষণ ও সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ নির্ভুল ছিল। কাহালের আঁকা ড্রয়িংগুলি আজও বহু নিউরোসায়েন্সের টেক্সট বইয়ে দেখা যায়। কাহালের সিদ্ধান্ত থেকে নার্ভাস সিস্টেমের মূল নীতি এবং গঠন বিন্যাসের ছবিটি স্পষ্ট হল। 

১৯০৬ সালে ফিজিওলজি এবং মেডিসিন বিভাগে নোবেল পুরস্কার পেলেন কাহাল ও গলজি। নোবেল পুরস্কার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়ে সেই প্রথম দেখা হল গলজির সঙ্গে কাহালের। প্রসঙ্গত বলি যে নিরবচ্ছিন্ন সংযোগ ব্যবস্থার ধারণা আমৃত্যু অটুট ছিল গলজির। এই কারণে তাঁদের দ্বন্দ্ব জারি ছিল জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। এমনকি নোবেল পুরস্কার ভাষণেও গলজি তাঁর বদ্ধমূল ধারণার কথা উল্লেখ করতে ছাড়েননি। অন্যদিকে কাহালও তাঁর ধারণার কথা জোরের সঙ্গে উপস্থাপিত করেছেন সেখানে।  


কাহালের হাজারের বেশি ড্রয়িং থেকে বেছে একটি ছবির অ্যালবাম-বই প্রকাশিত হয়েছে, যার নাম ‘দ্য বিউটিফুল ব্রেন : দ্য ড্রয়িংস অফ সান্টিয়গো রামন ওয়াই কাহাল’। তেমনি সাম্প্রতিক অতীতে বিভিন্ন গবেষণাগারে তাঁর আঁকা ড্রয়িংগুলি নিয়ে প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে।   ‘ড. ব্যাকটেরিয়া’ ছদ্মনামে ১৯০৫ সালে কাহাল পাঁচটি কল্পবিজ্ঞানের কাহিনি লেখেন ‘ভ্যাকেসন স্টোরিজ’ নামে। তাঁর সম্মানে একটি গ্রহাণুর নাম রাখা হয়েছে The asteroid 117413 Ramonycajal’। 

গত ১ লা মে আমরা পেরিয়ে এলাম সান্টিয়গো রামোন ই কাহালের ১৭০ তম জন্মদিন। স্নায়ুবিজ্ঞানের জগতে তাঁর নাম চিরভাস্বর হয়ে থাকবে। তাঁর নোবেল প্রাইজ পাওয়ার একশো বছর পেরিয়ে গেছে, তবু তাঁর আঁকা ড্রয়িংগুলি আজও সমান 'আইকনিক' হয়ে আছে। 

..................... 
                                


#Santiago Ramon Y Cajal #The Beautiful Brain: The Drawings of Santiago Ramon Y Cajal #neuroanatomy #science feature # Siddhartha Majumdar #Silly Point #Web Portal

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

34

Unique Visitors

182406