স্ত্রী গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের উদ্দেশে লেখা গান মানবেন্দ্রকে দিয়ে গাইয়েছিলেন গীতিকার শ্যামল গুপ্ত
আধুনিক বাংলা গানের একটি মাইলফলক বলা যায় এই গানকে। বাংলার সর্বকালের শ্রেষ্ঠ রোমান্টিক গানগুলির মধ্যে একটি বললেও অত্যুক্তি হয় না। মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের মতে, শ্যামল গুপ্ত এ গান সন্ধ্যাকে ভেবে লিখেছিলেন। গানটি লেখা হয় ১৯৫৭ সালে। গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে গীতিকার শ্যামল গুপ্তের বিয়ে হয় ১৯৬৬ সালের ১০ মার্চ। তার আগে চলেছে দীর্ঘ প্রেমপর্ব। ফলে মানবেন্দ্র নিশ্চিত ছিলেন, শ্যামল এ গান লিখেছিলেন সন্ধ্যাকে উদ্দেশ্য করেই। মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে সে গান কিংবদন্তী হয়ে আছে। ‘আমি এত যে তোমায় ভালোবেসেছি’। নিজের প্রেমিকার জন্য লেখা গানই প্রিয় বন্ধু মানবেন্দ্রকে দিয়ে গাইয়েছিলেন শ্যামল গুপ্ত। পরে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের আত্মজীবনীতেও এমন আভাস পাওয়া যায়। আকাশবাণীতে মানবেন্দ্রর অনুষ্ঠানের ফাঁকে হঠাৎ করেই এ গান লিখে ফেলেন শ্যামলবাবু। রাত ৯টা নাগাদ রাগপ্রধান গানের লাইভ অনুষ্ঠান শেষ করে মানবেন্দ্র শ্যামলকে সঙ্গে নিয়ে ছাদে গেলেন হাওয়া খেতে। পৌনে ১১টায় আধুনিক বাংলা গানের লাইভ অনুষ্ঠান। এর মাঝখানেই শ্যামল লিখে ফেললেন এই অসামান্য পদ্য। সুরও বসিয়ে ফেললেন মানবেন্দ্র। ১৯৫৭ সালের ৩০ জুলাই এক ঘণ্টারও কম সময়ে তৈরি হয়েছিল বাংলা আধুনিক গানের অবিস্মরণীয় এই সম্পদটি। সে বছর মানবেন্দ্রর পুজোর ক্যাসেটে গানটি যুক্ত হয়।
এ ছাড়াও আরও কত জনপ্রিয় গান যে শ্যামল গুপ্তের কলম থেকে বেরিয়েছিল তার হিসেব করা কঠিন। সারা জীবনে লিখেছেন প্রায় দু হাজার গান। তার মধ্যে রয়েছে পুজোর গান, আকাশবাণীর রম্যগীতি, রাগাশ্রয়ী গান, লঘুসংগীত এবং বাংলা ছায়াছবির জন্য লেখা গান। গত শতকের পাঁচের দশক থেকে আটের দশক পর্যন্ত বাংলা গানের জগতে যে ক’জন কথাকার দাপিয়ে বেড়িয়েছেন, শ্যামল গুপ্ত সেই তালিকায় একেবারে শুরুর দিকেই থাকবেন। জগন্ময় মিত্র, যূথিকা রায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলে, সুপ্রীতি ঘোষ, ইলা বসু, গায়ত্রী বসু, বাণী ঘোষাল, আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়, কল্পনা মুখোপাধ্যায়, আরতি মুখোপাধ্যায়, নির্মলা মিশ্র, উৎপলা সেন, মাধুরী চট্টোপাধ্যায়, বনশ্রী সেনগুপ্ত, কৃষ্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, হৈমন্তী শুক্লা, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, তালাত মাহমুদ, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, পিন্টু ভট্টাচার্য, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, অনুপ ঘোষাল - কে না গেয়েছেন তাঁর কথায়? মানবেন্দ্রর কণ্ঠে ‘আমি এত যে তোমায় ভালোবেসেছি’ ছাড়াও ‘মেটেরিয়া মেডিকার কাব্য’, মান্না দে-র কণ্ঠে ‘ও আমার মন যমুনার অঙ্গে অঙ্গে ভাব তরঙ্গে কতই খেলা’, ‘আমি আজ আকাশের মতো একেলা’, জগন্ময় মিত্রে কণ্ঠে ‘অন্তবিহীন নহে তো অন্ধকার/ কঠিন আঘাতে ভাঙিবে বন্ধ দ্বার’, বা সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘চন্দন পালঙ্কে শুয়ে একা একা কী হবে জীবনে তোমায় যদি পেলাম না’-র মতো গান এই প্রচণ্ড গতিময় সময়েও বাঙালিকে উদ্বেল করে। তাঁর কথায় এবং বাপ্পি লাহিড়ীর সুরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় আব্দুল জব্বার গেয়েছিলেন বিখ্যাত সেই গান ‘হাজার বছর পরে আবার এসেছি ফিরে বাংলার বুকে আছি দাঁড়িয়ে’।
শ্যামল গুপ্তর জন্ম ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে র ৩ ডিসেম্বর বৃটিশ ভারতের কলকাতায়। তাঁর পিতামহ ও পিতা মুঙ্গের কোর্টের আইনজীবী ছিলেন। শ্যামল গুপ্তর পড়াশোনা কলকাতায় স্কটিশ চার্চ স্কুল ও কলেজে। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে সেন্ট জেভিয়ার'স কলেজ থেকে রসায়নশাস্ত্রে অনার্স সহ স্নাতক হন। স্নাতক হওয়ার পর প্রথমে মহারাষ্ট্রের পুণায় ভারত সরকারের মিলিটারি এক্সপ্লোসিভ ল্যাবরেটরিতে রসায়নাগরিক হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন। কিন্তু ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ইস্তফা দিয়ে কলকাতায় চলে আসেন। এক বৎসর বিজ্ঞাপনের কপি লেখার কাজ নেন। এরপর পুরোদস্তুর লেখালেখির কাজে আত্মনিয়োগ করেন। সঙ্গীত জীবনে তাঁর প্রথম আবির্ভাব গায়ক হিসাবে। কিন্তু অচিরেই নিজের জোরের জায়গা বুঝে নিয়ে গান লেখায় মনোনিবেশ করেন। তারপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। গানের পাশপাশি কবিতা, গল্পও লিখেছেন। কিছু ছায়াছবির চিত্রনাট্যও লিখেছেন। তবে যাবতীয় খ্যাতি এসেছে গান লিখেই। একইসঙ্গে মরমী ও বলিষ্ঠ ভাষা এবং গভীর জীবনবোধ তাঁর গানকে কালজয়ী করেছে।
ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে। সন্ধ্যার পেশাগত সমস্ত কিছু তিনিই দেখতেন। সন্ধ্যা এ বিষয়ে পুরোপুরি নির্ভর করতেন তাঁর ওপর। আদ্যন্ত আদর্শবাদী এই মানুষটি সামাজিক জীবনে কোনও আপোসে রাজি ছিলেন না। এজন্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের অসূয়ার শিকার হতে হয়েছে তাঁকে এবং সন্ধ্যাকে। বাম জমানার এক দাপুটে নেতার ‘অনুরোধ’ শ্যামল রাখেননি বলে একটি অনুষ্ঠানে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান গাইবার সময় ইচ্ছাকৃতভাবে মাইক বিকল করে দেবার মতো ঘটনাও ঘটেছে।
একসময় খুব ধূমপান করতেন। পরে ছেড়ে দেন। খাদ্যরসিক ছিলেন। আগ্রহ ছিল জ্যোতিষবিদ্যাতেও। প্রচণ্ড কাশি নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। প্রাথমিকভাবে প্লুরিসি ধরা পড়েছিল। দু দিন পরেই ধরা পড়ে লাং ক্যানসার। মারা যান ২৮ জুলাই, ২০১০।
গীতিকারদের ‘কবি’-র মর্যাদা দেওয়া হয় না বলে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের মতো তাঁর কোনও ক্ষোভ ছিল কিনা বলা মুশকিল, তবে মহৎ কবির বেশ কিছু গুণই যে তাঁর রচনায় ছিল তাতে সন্দেহ নেই। সমকালে গীতিকার হিসেবে তাঁর চাহিদা ছিল তুমুল। সম্মানও পেয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্যোগে তাঁর গানের সংকলন প্রকাশ করা হয়েছিল, যার নাম ‘বেঁধেছি আমার স্মরণবীণ’। তবে বাংলা গীতিসাহিত্যে নজরুলের পরে বাকিদের নিয়ে চর্চা বেশ কম। রবীন্দ্রসংগীত, দ্বিজেন্দ্রগীতি, রজনীকান্ত-অতুলপ্রসাদের গান বা নজরুলগীতির পর; কবীর সুমন আসার আগে পর্যন্ত বাংলা গানের কথা রক্তাল্পতায় ভুগেছে ঠিকই, কিন্তু শ্যামল গুপ্তের মতো গীতিকারদের বোধহয় আরও একটু নিবিড় চর্চা বা গবেষণা প্রাপ্য।
.................................
[ছবিতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, বেলা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে শ্যামল গুপ্ত ও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়]
# শ্যামল গুপ্ত #মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় #সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় #জগন্ময় মিত্র #হেমন্ত মুখোপাধ্যায় #মান্না দে #আব্দুল জব্বার #টিম সিলি পয়েন্ট