সম্রাট ও শান্তিগোপাল
পেলেকে খেলতে দেখিনি। শান্তিগোপালকেও স্টেজে দেখার সুযোগ হয়নি কোনোদিন। তবু একেকটা পিজে (পচা জোক) ওরাল ট্র্যাডিশনের মতো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এমন অমোঘভাবে বয়ে আসে যে তাকে অস্বীকার করা যায় না কিছুতেই। আমাদের বাবা-কাকারা ছোটবেলায় শুনেছিলেন। আমরাও শুনেছি। কলকাতায় এসে ভদ্রলোক সেদিন তেমন ভালো খেলতে পারেননি। মোহনবাগানের ডিফেন্ডাররা বারবার আটকে দিচ্ছিলেন। তাতেই কীভাবে যেন এই কথাটা চালু হয়ে যায়। ওটা নাকি পেলে ছিলেন না। পেলে নাকি মাঠে নামেনইনি। যাত্রা-সম্রাট শান্তিগোপাল নাকি সেদিন পেলে সেজে খেলতে নেমেছিলেন। নির্ভেজাল রসিকতাই। কিন্তু রসিকতাও যে এমন কালজয়ী হতে পারে, কে জানত!
২৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৭। কলকাতার ফুটবোলপ্রেমীদের কাছে এক স্বপ্নের দিন। খোদ পেলে আসবেন কলকাতায়। চর্মচক্ষে তাঁকে খেলতে দেখা যাবে ইডেন গার্ডেনসে। পেলের কসমস ক্লাব প্রীতি ম্যাচ খেলবে মোহনবাগানের বিরুদ্ধে। এই ম্যাচটি যার জন্য সম্ভব হয়েছিল তিনি ধীরেন দে - কলকাতা ময়দানের বিখ্যাত ফুটবল প্রশাসক এবং মোহনবাগানের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক। অবশ্য আরেকটু হলেই কলকাতাবাসীর স্বপ্নে জল ঢেলে দিচ্ছিলেন বরুণদেব। সেদিন কলকাতা জুড়ে তুমুল বৃষ্টি। মাঠের অবস্থা দেখে বেঁকে বসলেন কসমসের অফিসিয়ালরা । সাফ জানিয়ে দিলেন, খেলোয়াড়দের পায়ের ইনস্যুরেন্স করা রয়েছে । এই কাদা-প্যাচপ্যাচে মাঠে কিছুতেই বিদেশি প্লেয়ারদের নামতে দেওয়া যাবে না। কলকাতার কর্মকর্তাদের মাথায় হাত। তাহলে কি ফুটবল সম্রাটকে চোখের সামনে দেখার স্বপ্ন পূরণ হবে না?
শেষ অবধি অবশ্য কল্লোলিনী তিলোত্তমার মন ভাঙেনি। মাঠে নেমেছিলেন পেলে। তবে 'জোগা বনিতো'-র স্বাদ পায়নি দর্শক। পেলে গোল করতে পারেননি। তাঁকে কড়া মার্কিংয়ে রেখেছিলেন সুব্রত ভট্টাচার্য, গৌতম সরকাররা। এক সময় মোহনবাগান ২-১ ব্যবধানে ম্যাচ জিতছিল, কিন্তু কসমস দলকে বিতর্কিত পেনাল্টি দেওয়া হয়। ম্যাচ শেষমেশ ২-২ গোলে ড্র হয়। কসমসের হয়ে গোল করেছিলেন কার্লোস আলবার্তো ও চাঙ্গালিয়া (পেনাল্টি)। মোহনবাগানের দুই গোলদাতা ছিলেন শ্যাম থাপা ও আকবর। আসলে খারাপ মাঠে খানিক সাবধানী হয়েই খেলেছিলেন পেলে সহ কসমসের সকলেই। তাছাড়া পেলে তখন পেশাদার ফুটবল প্রায় ছেড়ে দেবার মুখে। বয়স প্রায় ৩৮। আম-বাঙালির অবশ্য অত খতেনে কাজ নেই। পেলের জাদু দেখতে না পেয়ে হতাশ হয়ে তারা নতুন রগড় খুঁজে নিয়েছিল। একেকটা মন্তব্য এমনই অমর হয়ে যায়। কার মাথা থেকে বেরিয়েছিল, সেটা আর জরুরি থাকে না। তাতে গোটা জাতের অধিকার জন্মে যায়। বাঙালির রসিকতা সেদিন বাংলার এক অনন্য নট-কে জুড়ে দিয়েছিল ফুটবলের সর্বকালের সেরা তারকার সঙ্গে। কারণ শান্তিগোপালের পক্ষে সব সম্ভব। বাঙালি জানত, এমন কোনও চরিত্র পৃথিবীতে থাকা সম্ভবই নয় যা শান্তিগোপাল বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্গে তুলে ধরতে পারবেন না।
গ্রুপ থিয়েটারের বীরেন্দ্রনারায়ণ পাল যাত্রার দুনিয়ায় এসে পরিচিত হয়েছিলেন শান্তিগোপাল নামে। এমন দাপুটে অভিনেতা বাংলা যাত্রাজগৎ বেশি পায়নি। শান্তিগোপাল কী হননি! বিবেকানন্দ, নেতাজি, মার্কস, হিটলার, নেপোলিয়ন, হো চি মিন। 'লেনিন' অভিনয়ের জন্য আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন সোভিয়েত রাশিয়া থেকে। কেউ কেউ বলেন, একটি পালায় শান্তিগোপাল নাকি রানি লক্ষ্মীবাইয়ের ঘোড়াও সেজেছিলেন। তাহলে তাঁর পক্ষে পেলে সাজা এমন কী হাতিঘোড়া ব্যাপার!
ফলে পেলের কথা উঠলে শান্তিগোপালের অনুষঙ্গ মনে পড়বে না, চল্লিশ-পেরোনো বাঙালিদের মধ্যে এমন মানুষ কমই পাওয়া যাবে। শান্তিগোপালের সঙ্গে পেলের কোনোদিন দেখা হয়নি। দেখা হবার কথাও না। ধারে-ভারে-পরিচিতিতে তুলনার তো প্রশ্নই আসে না। রসিকতা ছাড়া আর কী-ই বা পারে তাঁদের জুড়তে! সেই ঐতিহাসিক ম্যাচ কি দেখেছিলেন শান্তিগোপাল? জানা যায় না। ১৯৭৭-এর পর ২০১৫ সালের অক্টোবরে পেলে আরও একবার ভারত সফর করেন। শান্তিগোপাল তার তিন বছর আগে বিদায় নিয়েছেন। ২০১২ সালের নভেম্বর মাসে। দশ বছর বাদে আর এক শীতের রাতে পেলেও চলে গেলেন। নামের পাশে ১২৮৩ গোল। তিনটে বিশ্বকাপ। সবার উপরে তিনি। সবার ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাঁকে দেখার জন্য নাইজেরিয়ার চলমান গৃহযুদ্ধে ৪৮ ঘণ্টার যুদ্ধবিরতি ঘোষিত হয়। তিনি নিজেই বলে দেন, "আপনি এই ভূ-গোলকের যে প্রান্তেই যান না কেন, তিনটে নামের সঙ্গে সবাই পরিচিত। যীশুখ্রিস্ট, কোকাকোলা আর পেলে।" সেই পেলে আজ চলে গেলেন। ফুটবলের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞাপন চলে গেলেন। বিশ্ব ফুটবলের মানচিত্রে আমরা নেই। ১৯৫০ সালে একবার বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পেয়েছিলাম, তা-ও শেষমেশ খেলা হয়ে ওঠেনি। সেই ঘি শুঁকেই আমাদের দিন কাটে। আমাদের কাছে তো ওই '৭৭-এর ম্যাচই ফুটবল-সম্রাটকে সর্বোচ্চ পাওয়া। বাঙালির খুব প্রিয় একটা স্মৃতি আজ পাকাপাকিভাবে চলে গেল সেপিয়া টোনের জিম্মায়। বাঙালির একটা বিশ্বমানের পিজে আজ পুরোপুরি অনাথ হল।
..................
কৃতজ্ঞতা : অর্পণ দাস
#pele #পেলে #স্মরণ