নিবন্ধ

সমকাল ও জগদীশচন্দ্র প্রসঙ্গ রবীন্দ্রনাথ (চতুর্থ পর্ব)

অর্পণ পাল Jan 13, 2021 at 10:18 am নিবন্ধ

........................................................

[শিলাইদহ ও অন্য জগদীশচন্দ্র]

................................................... 

১৮৯৯-এর শুরুর দিকে রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে রেশম গুটি পোকা চাষ নিয়ে মেতে ওঠেন। লাভজনক এবং খরচ কম— এই দুই কারণে এলাকার প্রজাদের উপকার হবে ভেবে রবীন্দ্রনাথ ব্যাপারটায় উৎসাহ দেখিয়েছিলেন। সাহিত্য-রচনা বা কবিসুলভ উদাসীনতার বাইরে রবীন্দ্রনাথ আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে মেতে থাকতেন, যে সব ব্যাপারে তিনি বন্ধুদেরকেও জুড়ে নিতেন যথাসাধ্য উপায়ে। রেশম গুটির চাষের ব্যাপারেও তিনি সবচেয়ে বড় সহায় হিসেবে পেয়েছিলেন রাজশাহীর বন্ধু অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়কে। মূলত তাঁরই উৎসাহে ও উদ্যোগে শুরু হয় রেশম-কীট পালন। বাংলার বুকে কী করে রেশম চাষ করে ব্যাপারটাকে লাভজনক করে তোলা যায়, তাই নিয়ে তখন চিন্তিত তাঁরা। শিলাইদহের কাছের এক জনপদ কুমারখালি বেশ কয়েক বছর আগে কিঞ্চিৎ পরিচিত ছিল রেশমচাষের এক প্রধান কেন্দ্র হিসেবে, এই ব্যাপারটাও তাঁদের এই বিশেষ কীট পালনের উৎসাহে হয়তো একটু ইন্ধন জুগিয়েছিল। আর রবীন্দ্রনাথের মধ্যেও তখন জেগে উঠেছে গ্রামীণ কৃষি-শিল্পের প্রতি উৎসাহ। রাজশাহীর সদর শহর রামপুর-বোয়ালিয়ায় অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় কর্তৃক স্থাপিত হওয়া ‘রামপুর শিল্প বিদ্যালয়’-এ তৈরি রেশম নির্মিত পোশাক তিনি নিজে পরতে শুরু করেছেন, বন্ধুদেরও উপহার দিচ্ছেন। 

এখানেই থেমে না থেকে তিনি তাঁর ছেলেমেয়েদের গৃহশিক্ষক লরেন্সের সঙ্গে হাত মিলিয়ে মেতে উঠলেন শিলাইদহে রেশম-কীট প্রতিপালন করতে। লরেন্সকে আগেই হাত করেছিলেন অক্ষয়কুমার। তিনি ‘শিলাইদহে এসে লরেন্স সাহেবকে তাঁর চেলা বানিয়ে নিলেন। এর পূর্বে লরেন্সের ছিল মাছ ধরার বাতিক। সে সব ভুলে গিয়ে তিনি গুটিপোকা নিয়ে পড়লেন। তাঁর ঘর ভরে গেল গুটিপোকায়। রবিবার দিন কবির পুত্র-কন্যারা উঁকি মেরে দেখতেন— সাহেব খবরের কাগজ জড়িয়ে গুটিপোকার মধ্যে শুয়ে আছেন আর পোকারা তাঁর সর্বাঙ্গে চলে ফিরে বেড়াচ্ছে। নিঃসন্তান সাহেবের এরাই যেন সন্তান-সন্ততি।’ (কবির সংসার, পার্থসারথি চট্টোপাধ্যায়, ৩৭ পাতা)

কবিবন্ধুর এই উৎসাহ দেখেই জগদীশচন্দ্রও তাঁর সার্কুলার রোডের বাড়িতে শুরু করেন রেশম কীটের চাষ। তবে সেই কর্মকাণ্ডে ঠিক কোন সময়কাল থেকে তিনি জড়িত হয়ে পড়েন, সেটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে এই চাষে রবীন্দ্রনাথ আর জগদীশচন্দ্র তাঁদের অগ্রগতির কথা নিয়মিত লিখে জানাতেন একে অপরকে। যেমন ১৮৯৯-এর জুন মাসের ২৪ তারিখ, শনিবারে লেখা চিঠিতে জগদীশচন্দ্রকে রবীন্দ্রনাথ জানান— ‘শ্রীযুক্ত অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় মহাশয় কুক্ষণে কুড়িটি রেশমের গুটি আমার ঘরে ফেলিয়া গিয়াছিলেন। আজ দুই লক্ষ ক্ষুধিত কীটকে দিবারাত্রি আহার এবং আশ্রয় দিতে আমি ব্যতিব্যস্ত হইয়া উঠিয়াছি— দশ-বারো জন অহর্নিশি তাহাদের ডালা সাফ করা ও গ্রাম-গ্রামান্তর হইতে পাতা আনার কার্য্যে নিযুক্ত রহিয়াছে— লরেন্স্‌ স্নান-আহার-নিদ্রা পরিত্যাগ করিয়া কীট-সেবায় নিযুক্ত। আমাকে সে-দিনের মধ্যে দশ বার করিয়া টানাটানি করে— প্রায় পাগল করিয়া তুলিল। ইংরেজ জাতি কেন যে সকল বিষয়ে কৃতকার্য্য হয় তাহার প্রত্যক্ষ কারণ দেখিতেছি। উহাদের শক্তি চালনা করিবার জন্য বিধাতা ঊনপঞ্চাশ বায়ু নিযুক্ত করিয়াছেন, অথচ উহাদের মধ্যে বোঝাই এত আছে যে কাৎ করিতে পারে না। এখন যদি আমাদের কীটশালায় একবার আসিতে পারিতেন তবে একটা দৃশ্য দেখিতে পাইতেন। বৃহৎ ব্যাপার হইয়া উঠিয়াছে। কোন এক সময় ছুটী পাইলে এদিককার কথা স্মরণ করিবেন।’ 

এই চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ আরও জানিয়েছিলেন তাঁর অন্য নানা ধরনের চাষবাস নিয়ে উদ্যোগের কথা। এই রেশমচাষের প্রসঙ্গ রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘আশ্রমের রূপ ও বিকাশ’ প্রবন্ধটিতেও আলোচনায় এনেছিলেন। 

মোটামুটি সংক্ষেপে এই হল জগদীশচন্দ্রের রেশম গুটি প্রতিপালনে উৎসাহের কারণ। শিলাইদহে কবির আতিথ্য গ্রহণ করবার কালেই এই ব্যাপারটায় তাঁর উৎসাহ জেগে ওঠে। সেখান থেকে কিছু গুটি নিয়ে ফিরে আসেন এবং রেশম চাষে প্রবৃত্ত হন। কিন্তু এই ব্যাপারে অন্তত তিনি বিশেষ সফল হননি। রবীন্দ্রনাথকে ১৮৯৯-এর ১৩ এপ্রিল লেখা এক চিঠিতে তিনি জানাচ্ছেন— ‘প্রজাপতিগুলি এখনও জন্মগ্রহণ করে নাই। গত শনিবার হইতে গুটিগুলিকে প্রত্যহ নাড়িয়া দেখিতেছি, ভিতরে যেন পূর্ণতর হইয়া আসিতেছে। আশঙ্কা হয় এত ঘন ঘন কম্পনে কীটের প্রাণবায়ু হয়ত বাহির হইয়া গিয়াছে। তাহা হইলেও একরূপ নিশ্চিন্ত হইতাম, কারণ যে এরণ্ড বৃক্ষের কথা বলিয়াছিলাম তাহার পাতাগুলি একেবারে নিঃশেষিত হইয়া গিয়াছে। সুতরাং এই দুর্ভিক্ষের সময় সহসা প্রজাবৃদ্ধি মনে করিয়া ভীত আছি। বিশেষত লরেন্স সাহেবের নিকট আমি কি করিয়া মুখ দেখাইব জানি না।’ 

‘অনুষ্টুপ’ থেকে প্রকাশিত ‘ব্যক্ত অব্যক্ত’ বইটিতে এই চিঠির তারিখ ১৩ এপ্রিল ১৮৯৯ চিহ্নিত থাকলেও শেষে টীকায় জানানো হয়েছে বসু বিজ্ঞান মন্দির থেকে প্রকাশিত পত্রাবলীতে এই চিঠির তারিখ ১৯০০ সালের মার্চ মাস হিসেবে চিহ্নিত করা আছে। দিনক্ষণ যাই হোক, জগদীশচন্দ্র যে রেশম গুটি চাষ নিয়ে সত্যি সত্যিই মেতে উঠেছিলেন, তা এই চিঠির বক্তব্য থেকেই পরিষ্কার হয়। 

আরও পড়ুন : সমকাল ও জগদীশচন্দ্র : ত্রিপুরা রাজপরিবার ও জগদীশচন্দ্র / অর্পণ পাল

এই বিষয় আরও একবার উত্থাপিত হতে দেখি এর পরের ২৫ এপ্রিলের চিঠিতেই– ‘রেশমের কীটের শোচনীয় পরিণাম শুনিয়া দুঃখিত হইবেন। কয়দিন হইল একটি প্রজাপতি সুস্থ শরীরে জন্মগ্রহণ করিয়াছিল। তাহার পর ২/৩টি অর্দ্ধমৃত অবস্থায় জন্মিয়াছে, আর কয়টি অর্দ্ধেক বাহির হইয়া রহিয়াছে। এরূপ অবস্থায় কি করিতে হইবে জানি না। যে একটি সুস্থ শরীরে বাহির হইয়াছিল, তাহাকে কি আহার দিতে হইবে জানি না। অনেক পুষ্প সংগ্রহ করিয়া দিয়াছি, কিন্তু মধু সঞ্চিত করিতে তাহার কোন আগ্রহ নাই। কোন বন্ধু আমের চাটনী দিতে বলিয়াছেন।’ (মঙ্গলবার ২৫ এপ্রিল, ১৮৯৯ লেখা চিঠি) 

ব্যর্থ হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ আর লরেন্স সাহেবও। প্রচুর গুটি জন্মেছিল বটে, কিন্তু পরে বাজারে যাচাই করে জানা যায় যে এই গুটি ভালো জাতের নয়, তাই কাটতি নেই। দামও সামান্য। ফলে বিপুল রেশমগুটি জলের দরে বেচে দিতে হয়। ঠাকুরবাড়ির ধনীর দুলালদের ব্যবসায়ে উৎসাহের কথা আলোচনা করতে বসলে আমাদের অবশ্যই মনে পড়ে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের কথা, একইরকম হঠকারী সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বভাব থাকার জন্য তিনিও নানাবিধ ব্যবসায় ব্যর্থতার সম্মুখীন হয়েছিলেন বারবার। 


২/ 

১৮৯৯- এর ২৫ এপ্রিলের ওই চিঠিতেই জগদীশচন্দ্র উত্থাপন করেছিলেন আরও একটি প্রসঙ্গ, যেটা নিয়ে দুটো কথা বলে নেওয়া যেতে পারে। 

বিয়ের পর থেকে জগদীশচন্দ্র প্রায় সব কাজেই আক্ষরিক অর্থে পাশে পেতেন স্ত্রী অবলা বসুকে। যিনি আর একটু হলে কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের বদলে পেয়ে যেতে পারতেন প্রথম মহিলা ডাক্তারের শিরোপা। তাঁর ব্রাহ্ম আলোকপ্রাপ্ত বাবা দুর্গামোহন দাশ তাঁর বেথুন স্কুলের পড়া শেষ হলে তাঁকে পড়তে পাঠিয়েছিলেন মাদ্রাজে, ডাক্তারি পড়তে। কিন্তু দুটো বছর পড়বার পর সব ছেড়েছুড়ে অবলা দেবী ফিরে আসেন কলকাতায়, এরপরেই তাঁর বিয়ে হয়ে যায়। অথচ এই চিঠিতে জগদীশচন্দ্র তাঁকেই নির্দেশ করছেন ‘একান্ত সেকালের’ বলে। পুরো বাক্যটা এরকম— ‘Mrs.— কথাটা বাঙ্গলাতে অতি বীভৎসাজনক। আপনি একটি নূতন কথা বাহির করিবেন। আপাতত “গৃহলক্ষ্মী” বলিতে পারেন, কারণ আমার সহধর্ম্মিণী একান্ত সে কালের। আধুনিকা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধিমণ্ডিতা হইলে ‘গৃহসরস্বতী’ লিখিতে বলিতাম।’ 

প্রশান্তকুমার পালের রবিজীবনী চতুর্থ খণ্ড থেকে জানা যাচ্ছে, ‘রবীন্দ্রনাথ ‘Mrs.’ কথাটির পরিভাষা করেছিলেন ‘আর্যা’— তাঁর কয়েকটি চিঠিতে শব্দটির প্রয়োগ আছে— কিন্তু বর্তমান পত্রের উত্তরটি পাওয়া যায়নি।’ (রবিজীবনী ৪, ২৩৬ পৃ)

অবলা দেবী নিজের চরিত্র গুণে এবং প্রবল ব্যক্তিত্বের বলে পরবর্তীকালে হয়ে উঠেছিলেন ভারতের প্রথম সারির শিক্ষাবিদদের একজন। জগদীশচন্দ্রের মৃত্যুর পরেও তিনি আরও এগারো বছর বেঁচেছিলেন এবং বহু কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকতেন জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছেও। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং তাঁর প্রিয় বন্ধুজায়া অবলা দেবীর মধ্যেকার সম্পর্ক মোটেই একরৈখিক বলা চলে না। তা নানা সময়ে নানা অপ্রত্যাশিত পথে বাঁক নিয়েছে। বিতর্কমূলক সেই প্রসঙ্গে আমরা যাব পরের পর্বে। 

(ক্রমশ) 

..........................................

[পোস্টার - অর্পণ দাস] 


#জগদীশ্চন্দ্র বসু #রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর #শিলাইদহ #অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় #সিরিজ #ব্যক্তিত্ব #অর্পণ পাল #সিলি পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

24

Unique Visitors

214986