ব্যক্তিত্ব

সঙ্গীতপ্রিয় সত্যেন্দ্রনাথ

অর্পণ পাল Dec 31, 2021 at 8:38 pm ব্যক্তিত্ব

আদতে নদিয়ার বড় জাগুলিয়ার বাসিন্দা সুরেন্দ্রনাথ বসু কলকাতায় বসবাস শুরু করেন বাবা অম্বিকাচরণের আকস্মিক মৃত্যুর পর। উত্তর কলকাতার গোয়াবাগানে তাঁদের পৈত্রিক বাড়ি, যদিও ভাড়াটেদের দাপটে সে বাড়ি অগম্য। পরে অবশ্য বাড়িটি তাঁদের করায়ত্ত হয়। রেলের উচ্চপদস্থ কর্মচারী হিসেবে পরবর্তীকালে প্রতিষ্ঠিত এই সুরেন্দ্রনাথেরই বড় ছেলে সত্যেন। যিনি পরবর্তীকালে বিখ্যাত হবেন বিজ্ঞানী এস এন বোস হিসেবে। নোবেল পুরস্কার অধরা থাকলেও তাঁরই নামে বিশ্বের যাবতীয় মৌলকণার দুটি ভাগের একটি ভাগের নাম হবে ‘বোসন’।

এ হেন বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথের স্বভাব-বৈচিত্র, আড্ডাপ্রিয়তা বা সাহিত্য-অনুরাগ নিয়ে একালেও নানা স্তরে জারি রয়েছে চর্চা। এসবেরই পাশাপাশি তাঁর আবাল্য আরও একটি আগ্রহের জায়গা ছিল সঙ্গীত। যার প্রতি তাঁর আগ্রহ দেখা যাবে জীবনভর। 

সঙ্গীতের ঘরোয়া আসরে সত্যেন্দ্রনাথকে আমরা দেখি হিন্দু স্কুলে পড়াকালীনই। তাঁদের বাড়ির কাছেই থাকতেন বন্ধু ও সহপাঠী গিরিজাপতি ভট্টাচার্য, যিনি পরবর্তীকালে বিজ্ঞান গবেষক ও সাহিত্যিক হিসেবে বিশেষ সুনাম অর্জন করেছিলেন। স্কুলপড়ুয়া সত্যেন্দ্রনাথের বেশিরভাগ দিন সন্ধেবেলা কাটত এই বন্ধুর বাড়িতেই। সঙ্গী হিসেবে থাকতেন গিরিজাপতির দাদা পশুপতি। ইনিও পরবর্তীকালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন চিকিৎসক হিসেবে। এঁর গানের গলা ছিল দারুণ। পশুপতিই মূলত গাইতেন, সত্যেন্দ্রনাথ শুনতেন আপন মনে। এখানে হাজিরা দিতে দিতেই কি সঙ্গীতের প্রতি অনুরাগ জন্মায় সত্যেন্দ্রনাথের, নাকি সাঙ্গীতিক টানেই এখানে আসতেন তিনি? বলা কঠিন হলেও এটা নিশ্চিত যে এই সময় থেকেই গানবাজনা ভালবাসতে শুরু করেন সত্যেন্দ্রনাথ। যা তিনি বহন করে চলবেন আজীবন। 

যদিও বাবা সুরেন্দ্রনাথের মোটেই পছন্দ না গান-বাজনা। তবে তিনি ছেলের শখ-আহ্লাদ পূরণে বিশেষ হস্তক্ষেপ করতেন না। আর নিখাদ বাঙালি পরিবারের বড় ছেলে স্কুল পেরিয়ে কলেজে প্রবেশ করে আরও বেশি করে জড়িয়ে ধরলেন বন্ধুদের, আড্ডা-আসরে জড়িয়ে ধরলেন গানকেও। পদার্থবিদ্যা আর গণিতচর্চার পাশাপাশি শিখলেন এস্রাজ বাজানো, শিখলেন বেহালাও। 

কলেজে পড়বার সময় সত্যেন্দ্রনাথ সহপাঠী হিসেবে পেলেন পরবর্তীকালের একজন বিখ্যাত গায়ক দিলীপকুমার রায়কে। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতশিল্পী দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্রের নাতি এবং সুসাহিত্যিক দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের পুত্র তিনি, সঙ্গীত তাঁর রক্তে। ততদিনে দিলীপকুমার নিজেও গায়ক হিসেবে সামান্য পরিচিতি পেতে শুরু করেছেন, তাঁর গাওয়া দেশাত্মবোধক গানের রেকর্ড শোভা পাচ্ছে দোকানে। তাঁদের আজীবন বন্ধুত্বেও মূল অনুঘটক ছিল সেই সঙ্গীতই। 

কলেজ জীবন থেকেই সত্যেন্দ্রনাথ সঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলেন আরও একজন সঙ্গীতসম্পৃক্ত ব্যক্তিকে, তিনি হারীতকৃষ্ণ দেব। যদিও দু-জনের কলেজ ছিল আলাদা, সত্যেন্দ্রনাথের প্রেসিডেন্সি, আর হারীতকৃষ্ণ দেবের স্কটিশ চার্চ। তবু তাঁদের মধ্যে আলাপ হয় এবং সে আলাপ পরিণত হয় জীবনভর বন্ধুত্বে। গণিতের সমস্যা সমাধান করতে গিয়ে গাঢ় হয় যে বন্ধুত্ব, তাতে আর একটি অনুঘটক ছিল গান। শোভাবাজার রাজবাড়ির এই সদস্যটিও সুন্দর গান করতেন, হারীতকৃষ্ণ দেবের পৈত্রিক প্রাসাদে মাঝেমধ্যেই বসত উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের আসর। বন্ধুর সুবাদে সে সব আসরে প্রবেশাধিকার জুটে যায় সত্যেন্দ্রনাথেরও। সুতরাং সঙ্গীতবোধ যে তখন থেকেই তাঁর রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করবার সুযোগ মিলছে নানা পথে, সন্দেহ নেই এতে। 

বিধান সরণির ওপরেই, বেথুন স্কুলের উলটো দিকে হেদুয়া পার্ক। এই পার্কটিকেই নিজেদের আড্ডার একটি কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথেরা। কলেজফেরত বন্ধুরা মিলিত হতেন, গান গাইতেন হারীতকৃষ্ণ বা দিলীপকুমার। অনেক পরে সত্যেন্দ্রনাথ যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, তখন সেখানে তাঁর কাছে মাঝেমধ্যেই যেতেন বন্ধু দিলীপকুমার। আর অবধারিতভাবেই তখন বসত গানের আসর। সেই আসরেও সত্যেন্দ্রনাথ বাজাতেন এস্রাজ। প্রিয় বন্ধু ‘মন্টু’ লিখেছিলেন বন্ধু সম্বন্ধে, ‘গানের সে একজন খাঁটি সমজদার, ভালো গান শুনবামাত্র এক আঁচড়েই ভালো বলে চিনে নিতে পারত।’ 


 প্রিয় বন্ধু ‘মন্টু’ দিলীপকুমার রায়ের সঙ্গে সত্যেন্দ্রনাথ  


ঢাকায় হোক বা কলকাতা, গানের জলসায় বন্ধু-সঙ্গযোগ থাকলে অবধারিত থাকত সত্যেন্দ্রনাথের উজ্জ্বল উপস্থিতি। দিলীপকুমার রায়ের দাদামশাই প্রতাপচন্দ্র মজুমদারের বাড়িতে সে আমলে প্রতি বছর এক বিরাট জলসা হত, ভারতের নানা প্রান্তের বিখ্যাত সব গাইয়েরা আসতেন সেই জলসায়। সেখানে সত্যেন্দ্রনাথ উপস্থিত থাকতেন প্রায় প্রতিবারই, বন্ধুর সঙ্গে। নির্মলকুমারী মহলানবিশের স্মৃতিচারণ থেকে, ‘সব সময়েই দেখেছি সত্যেন্দ্রনাথ হাজির আছেন— ঘণ্টার পর ঘণ্টা জলসা চলছে আর এই স্বনামধন্য বৈজ্ঞানিক মশগুল হয়ে বসে আছেন। তখন ওঁকে দেখলে কে না বলবে যে, সঙ্গীত সাধনা ছাড়া আর ওঁর কোন পেশা আছে।’ [সূত্র ২, ১৬৭ পৃ]

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনাকালে সেখানকার সংস্কৃতিমানচিত্রের নানা রঙে নিজেকে রাঙিয়ে নিয়েছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ। ওপার বাংলার আরও একজন গুণী মানুষ এবং সত্যেন্দ্রনাথের সহ-অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেনের স্মৃতিচারণেও রয়েছে সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গীতপ্রীতির উজ্জ্বল চিত্র— ‘সরস্বতী পূজা ও অন্যান্য উৎসবে তিনি অনেক সময় আমাকেও সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন কেন্দ্রে যেতেন ওস্তাদী সঙ্গীতের আসরে ও রাজ-রাজড়াদের বাড়ীতে। ভগবান সেতারীর সেতার, প্রসন্ন বণিকের তবলা, এমদাদ ওস্তাদের ধ্রুপদ, হাকীম মহম্মদ হোসেনের খেয়াল, টপ্পা; পচা ওস্তাদের ঠুংরী প্রভৃতি তাঁর প্রিয় ছিল। তাঁর বাড়ীতেও আসতেন দিলীপ রায়, রাণু সোম [পরবর্তীকালে বুদ্ধদেব বসুর স্ত্রী, প্রতিভা বসু], কবি নজরুল ইসলাম এবং আরও অনেকে।’ [সূত্র ২, ১৯৫ পৃ]  



এস্রাজ বাদনরত সত্যেন্দ্রনাথ। এই এস্রাজটি বর্তমানে রাখা রয়েছে গোয়াবাগানের বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ-এর সংগ্রহশালায় 


অন্যদের গান যিনি তন্ময় হয়ে শুনতেন, নিজের সাঙ্গীতিক বোধ নিয়ে কী ধারণা ছিল সেই বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথের?

“গানের ব্যাপারে আমার নিজের কোন বর্ণপরিচয় ছিল না। একটা ছোট এস্রাজ কিনে নিজে নিজে বাজাবার চেষ্টা করা হলো। অবশ্য স্বরলিপি দেখে বাজাবার অভ্যাস করতে হয়েছিল। তাছাড়া বিজ্ঞানী লোক হিসেবে ইংরেজীতে যাকে বলে harmonics সে সবগুলো অনুসন্ধান করে তার দ্বারা কী করে এ বাজানো যায় এইসব নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা নানান রকমের করা যেত; এইভাবে এসরাজের সঙ্গে পরিচয়। তারপর, সে হবে অনেকদিনের কথা। আরম্ভ হয়েছিলো বোধ হয় বয়স কুড়ি-একুশ হবে। কিছুদিন ছোট এস্রাজ বাজাবার পর ঢাকায় যেতে হল। সেখানে আমার এক ছাত্র ঢাকায় তৈরি বর্তমানের এস্রাজটি সংগ্রহ করে দিলেন। তারপর থেকে মাঝে মাঝে বাজাই। ঢাকায় তখন গান-বাজনার খুব রেওয়াজ ছিল। রাসের সময়ে বৈষ্ণবদের বাড়ীতে খুব গান-বাজনা হতো। আলাউদ্দিন খানের দাদা, ভগবান সেতারী, শ্যাম সেতারী এঁরা সকলে ওখানে প্রায় বাজাতেন। আমার নিজের কথা বলতে গেলে ধারাবাহিকভাবে কিছু করা হয়নি। তবে বলতে গেলে অনেক বছরই বাজানো হচ্ছে। ওতে যেটুকু হাত এসেছে ওই আর কি।” [সূত্র ১, ৪৩৭ পৃ]

আত্মভোলা, বিজ্ঞান-চিন্তায় নিমগ্ন গুরু আইনস্টাইনের মতোই সঙ্গীতের গহীন সাগরে ডুব দিলে সত্যেন্দ্রনাথ খুঁজে পেতেন পরম শান্তি, আর মানসিক পরিশ্রমের অনেকখানি রসদ।   

...........................

সূত্র :

১। সত্যেন্দ্রনাথ বসু রচনা সংকলন। বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ। 

২। আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু/ জীবন ও কৃতি। সম্পাদনা তপনমোহন চক্রবর্তী, বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ। জানুয়ারি ২০১৯। 

৩। সত্যেন্দ্রনাথ বসু/ একটি জীবনকথা। মানস প্রতিম দাস। রক্তকরবী। ২০১৮। 


#সত্যেন্দ্রনাথ বোস #Satyendra Nath Bose #Indian physicist # Bose–Einstein condensate #বিজ্ঞানী #অর্পণ পাল #silly পয়েন্ট #ওয়েবজিন #web portal

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

18

Unique Visitors

216323