শেক্ষপীরের বাড়ি
বন্ধু বলে দিয়েছিলেন যুক্তরাজ্যের নর্থ মিডল্যান্ডে এসে স্ট্র্যাটফোর্ড আপন অ্যাভন না গেলে সরস্বতীর অভিশাপ বয়ে বেড়াতে হবে বাকি জীবন - "অবশ্যই ঘুরে এসো, কারণ সেটাই সারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের একমাত্র এক্সপোর্ট আইটেম, বাকি সবই হাতানো।"
বার্মিংহ্যামে আসার সময় মনে হচ্ছিল জীবনে যে একবারও আশা বা আশঙ্কায়, দুঃখে বা হতাশায়, প্রেমে বা প্রত্যাখ্যানে মনে মনেও বলে উঠতে চেয়েছে ‘টু বি অর নট টু বি’ তার তো মনে হবেই সে যাওয়াটা পর্যন্ত হয়ে উঠবে তো ? বার্মিংহ্যাম হল নর্থ মিডল্যান্ডসের প্রধান শহর এবং এখান থেকে যে কোন দিকেই যাবার সহজ ব্যবস্থা আছে কিন্তু শেক্সপীয়রের আঁতুড়ঘর যে মাত্র কুড়ি পঁচিশ মিনিটের ড্রাইভেই পৌঁছে যাওয়া যাবে তা আশা করিনি। বাঙালি হলে শেক্ষপীরের বাড়ি যাবার সময় আপনার মাথায় আসবেই শান্তিনিকেতনের কথা। এখনকার শান্তিনিকেতনকে যেমন পাঁচিল আর কাঁটাতারে একটা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পরিণত করার চেষ্টা করা হচ্ছে এখানে তেমনটা হবার কোন সুযোগই নেই কারণ শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী আছে, শ্রীনিকেতন আছে, আছে কলা-কৃষ্টি-সঙ্গীত-উত্তরায়ণ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের অধুনা অনুজ্জ্বল কিন্তু অতিপরিচিত স্বাক্ষর। স্ট্রাটফোর্ড আপন অ্যাভনে সেরকম কিছুই নেই । সেখানে বাণিজ্যই প্রধান ফলে শেষ পর্যন্ত বঙ্গসন্তান একটু হতাশ হয়ে থাকলেও সেটাকে মধুর ভাবাই ভালো। এই এক জায়গায় অন্তত আমাদের কবির কোন আইডেন্টিটি ক্রাইসিস নেই। শেক্সপীয়রের অবশ্য দেশ-কালভিত্তিক স্থানিক আইডেন্টিটি দরকারই হয় নি, তিনি সারা বিশ্বের ফলে বছরভর প্রতিদিন নানা দেশের মানুষ ভিড় জমাচ্ছে সেখানে। ফলে এই জায়গার আন্তর্জাতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশই নেই। অবশ্য সেখানে ভ্রমণে যায় লোকে যতটা ভ্রমণের তাগিদে ততটা শেক্সপীয়রের তাগিদে নয়।
শহরের বাইরে গাড়ি রেখে ঢুকতে হয় এবং পায়ে পায়েই মুখ্য দ্রষ্টব্যগুলি ঘুরে নেওয়াই সঙ্গত। প্রধান আকর্ষণ অবশ্যই শেক্সপীয়র পরিবারের ভিটেবাড়ি। এমনিতেই ইংল্যান্ডে প্রাচীনের প্রতি একটা মমত্ব আছে সুর্যাস্তের পরে গোধুলিবেলার যেমন থাকে। ত্রয়োদশ চতুর্দশ শতাব্দীর বাড়িগুলো সে দক্ষিণের কেন্টের মত শহরেই হোক বা এখানে, একটা পারিপাট্যহীন যত্নে সুরক্ষিত। এই ‘ফ্যামিলি হোম’ টিও তাই। এর লাগোয়া শেক্সপীয়র সেন্টারটি ঘুরে তারপরে সে বাড়িতে চলুন। কিন্তু এখানেই কি জন্মেছিলেন উইলিয়াম শেক্সপীয়র?
সেন্টারে অন্তত দু’খানা নথি রয়েছে যা দিয়ে প্রমাণ করা যায় এ সম্পত্তি ছিল উইলিয়ামের বাবা জন শেক্সপীয়রের। এর একটি হল এই সম্পত্তি আইনানুগ ক্রয়ের প্রামাণ্য দলিল এবং দ্বিতীয়টি হল কাউন্সিল থেকে জরিমানার নোটিশ যা বাড়ির মালিক জন শেক্সপীয়ররের নামে প্রেরিত হয়েছিল বাড়ির বাইরে আবর্জনা ফেলে রাখার জন্য। উইলিয়ামের জন্মের কোন রেকর্ড পাওয়া যায় নি, তবে ২৬ এপ্রিল, ১৫৬৪ তে এখানকার হোলি ট্রিনিটি চার্চে তাঁর ব্যাপ্টিজমের নথি প্রদর্শিত আছে। সেন্টারে তাঁর বেশির ভাগ কাজের প্রথম প্রকাশিত কপি আছে, আছে বিশ্বের নানা জায়গায় শেক্সপীয়র চর্চার নিদর্শন যেখানে ‘শেক্সপীয়র ইন সাবকন্টিনেন্ট’ বিভাগও আছে। সেন্টার পেরিয়ে বাগান এবং সেই বাগানে একটু দূরে অপেক্ষাকৃত কোলাহলমুক্ত জায়গায় সে গৃহের প্রবেশদ্বারের দিকে তাকিয়ে আছেন আবক্ষ রবীন্দ্রনাথও । বাড়িটিতে ঢুকতে যে রোমাঞ্চ হয় তার অনেকটাই ফিকে হয়ে যায় যখন শুনি প্রদর্শিত সব কিছুই প্রায় তখনকার অনুকরণে তৈরি, সত্যিকারের ব্যবহৃত আসবাব বা সামগ্রী এসব নয়। শেক্সপীয়রের কলম আর শেক্সপীয়রের ব্যবহৃত কলমের মত কলমে যা তফাৎ সেটা মাথা থেকে বার করে দিতে পারলে এ বাড়িটি আপনাকে নির্ভুল নিয়ে যাবে ষোড়শ শতাব্দীর মিডল্যান্ডসে। বাড়ির গঠন, সিঁড়ি, ছাদের সিলিং থেকে শুরু করে আঁতুড় ঘর, শোবার ঘর, খাবার ঘর ,আসবাব সব কিছুতে ধরা আছে সে সময়। জন ছিলেন ব্যবসায়ী তবে ব্যবসা কিসের জানেন? রোমশ কাঠবেড়ালী মেরে দস্তানা বানিয়ে বিক্রি করত এই পরিবার বংশানুক্রমিকভাবে। রাখা আছে সে কাজের ওয়ার্কশপ এবং ফিনিশড প্রোডাক্টের নমুনা। একটা গভীর স্বস্তির নিশ্বাস আপনা থেকেই বেরিয়ে আসে যখন ভাবা যায় ভাগ্যিস উইলিয়াম পারিবারিক ব্যবসায় ঢুকে পড়েন নি। যতদূর জানি এ ব্যবসা এখনও নিষিদ্ধ নয় কাঠবেড়ালির চামড়ার দস্তানা ভালো প্রিমিয়ামে তখনও বিক্রি হত, এখনও হয়। এ বাড়িতে উইলিয়াম চিরকাল থাকেন নি, যৌবনেই খ্যাতি অর্জনের পর অদূরেই তিনি ১০৭ একর জমির এক বিশাল সম্পত্তি কিনে ফেলেন আর সেই সম্পত্তিকে ঘিরেই মোটামুটিভাবে গড়ে উঠেছে আজকের স্ট্র্যাটফোর্ড আপন আভন’এর হাই স্ট্রিট। কেবল গেটটিই অবশিষ্ট আছে সে জমির, বাকি কেবল দোকান আর দোকান। জন্মভিটের কথা বলছিলাম কিন্তু শুধু সেখানেই সময় কাটালে চলবে না আমরা উইলিয়ামের শ্বশুরবাড়িও যাবো এবং সেটা বেশ দূর, যেতে হবে পদব্রজে। জন্মভিটেতেই আছে একটি মুক্তমঞ্চ এবং রয়্যাল শেক্সপীয়র কোম্পানির ট্রেনিরা পিরিয়ড কসটিউমে সেখানে টুকরো টুকরো দৃশ্য পরিবেশণ করছে। কখনও ওফেলিয়ার সঙ্গে হ্যামলেট, কখনও ভেনিসের বণিকটির সঙ্গে ইয়ারো। এর মধ্যে আপনি ঢুকে পড়তে পারেন যদি দু চারটে ডায়লগ কোনকালে মকশো করেছিলেন এবং এখনও মনে থেকে থাকে- আমি অবশ্য সে সাহস পাই নি।
শেক্সপীয়র পরিবারের আরও অনেক চিহ্নই আছে এই শহরের আশে পাশে । স্টেশন রোডে আছে উইলিয়ামের মামাবাড়ি । তাঁর মায়ের নাম ছিল মেরি আর্ডেন- বাড়িটাকে মেরি আর্ডেন’স ফার্ম বলেই চেনে সবাই। এটা বেশ খারাপ অবস্থায় আছে এবং খোলা নাও পাওয়া যেতে পারে। আছে তাঁর প্রথমা সন্তান সুসানার বাড়ি। স্থানীয় ডাক্তার জন হলের সঙ্গে বিয়ের পরে সুসানা এই বাড়িতেই থাকতেন এবং এটিও দর্শনীয়ের তালিকায় আছে। হাই স্ট্রিট ছাড়িয়ে এবার চলুন অ্যানের বাড়ি। অ্যান হ্যাথওয়ে, উইলিয়ামের পত্নী । পথে পড়বে গিল্ডহল গ্রামার স্কুল- শেক্সপীয়রের স্কুল। ঢুকেও দেখে আসতে পারেন কিছুটা। এদিকে আসবার আর লোক নেই বিশেষ, ফলে ইংল্যান্ডের গ্রামের অপরূপ মোহময়তার আবেশ গায়ে মাখতে মাখতে এসে যাওয়া গেল শেক্ষপীরের শ্বশুরালয়। অ্যান ছিলেন উইলিয়ামের থেকে ছ’বছরের বড় তবে আঠারো বছর বয়সেই বিয়েতে বসতে বাধ্য করা হয় উইলিয়ামকে কেন না অ্যান তখন ছ’মাসের গর্ভবতী। এ বাড়িতেই জন্মায় সুসানা এবং তাদের যমজ দুই সন্তান – কন্যা জুডিথ ও পুত্র হ্যামনেট। দেখা যেতে পারে আরও অনেক কিছুর মধ্যে শোবার ঘর, লেখার টেবিল এবং ফায়ার প্লেসের ধারে রাখা একটা নিরিবিলি সোফাসেট যেটাতে বসে উইলিয়াম ও অ্যানা নাকি অনেক মধুর সন্ধ্যা কাটিয়েছেন। শুনলে অবাক হবেন, এই সোফায় বসে খানিক সময় কাটাবার জন্য হ্যাথওয়ে পরিবার ১৭০০ সালে ৬ পেনি করে দক্ষিণা নিত। ব্যবসা এদের রক্তে আছে সন্দেহ নেই।
সন্ধ্যার আগে চলে এলাম আভন নদীর ধারে। নদীতীরে ১১০০ আসনের বিশাল থিয়েটার। রয়্যাল শেক্সপীয়র কোম্পানি সারা বছর সেখানে কেবল শেক্সপীয়রের নাটকই অভিনয় করে। সেটার জন্য অপেক্ষা করবার অবকাশ আমার ছিল না। বরং আভন নদের পাড়ে গিয়ে বসি। ইংল্যান্ডের নদ-নদী কোন কোনটিকে দেখে মনে হবে নিকাশী নালা ছাড়া কিছু নয়। আভন সে তুলনায় কিঞ্চিৎ সমীহ উৎপাদনকারী। আপনি দেখতে থাকুন সে নদের বুকে ভাসছে অ্যান্টনি ও ক্লিওপেট্রা। কুড়ি পাউন্ড খরচ করলে আপনিও একটা ইয়াচ নিয়ে তাদের পিছু নিতে পারেন।
.......................................
[ কভার ছবি : আভন নদ ]
** [সমস্ত ছবির কপিরাইট লেখকের] **