ফিচার

শিকারিরাই এখন রক্ষক : আমুর ফ্যালকন সংরক্ষণে পথ দেখাচ্ছেন ফটোগ্রাফার

মন্দিরা চৌধুরী Feb 11, 2022 at 8:05 am ফিচার

রক্ষকের ভক্ষক হয়ে ওঠার ঘটনা কারও কাছেই খুব অপরিচিত নয়। অনেকেই সামনাসামনি প্রত্যক্ষ করেছেন সেই পরিস্থিতি। কিন্তু ব্যাপারটি যদি হয় শিকারির সংরক্ষক হয়ে ওঠা, তবে তা বিচিত্র ঘটনা হয় বৈকী! এমন ঘটনাই ঘটেছে নাগাল্যান্ডে। ভারতবর্ষে যেসব জায়গা পরিযায়ী পাখিদের শীতকালীন আস্তানার জন্য বিখ্যাত তার মধ্যে নাগাল্যান্ড অন্যতম। প্রতি বছর শীতে হাজার হাজার আমুর বাজপাখি নাগাল্যান্ডের ডোয়াং উপত্যকায় আসে, দক্ষিণ আফ্রিকা যাওয়ার পথে কয়েক সপ্তাহ এখানে বসবাস করে। এই পাখিরা তাদের ২২,০০০ কিলোমিটার দীর্ঘ আন্তঃমহাদেশীয় যাত্রা আবার শুরু করার আগে কয়েক সপ্তাহ ভারতীয় উপমহাদেশে অতিবাহিত করে।

ভারতীয় বন্যপ্রাণ আইন অনুসারে বিপন্ন প্রজাতির তালিকায় স্থান পেয়েছে এই আমুর বাজপাখি বা Majestic Amur Falcon। পরিযানকালে নাগাল্যান্ডে বসবাসের সময়েস্থানীয় লোকজন, বিশেষ করে স্থানীয় জেলেরা ব্যাপক হারে আমুর বাজপাখি শিকার করতেন। খতিয়ান অনুযায়ী, ২০১২ সালে, শুধু এক বছরেই প্রায় ১,৪০,০০০ আমুর বাজপাখি শিকার করা হয়েছিল ডোয়াং উপত্যকায়। এর পরিসংখ্যান প্রকাশ্যে আসার পরেই এই প্রজাতি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। মূল উদ্যোক্তা ছিলেন ব্যাঙ্গালোর নিবাসী রামকি শ্রীনিবাসন। পেশায় ওয়াইল্ড-লাইফ ফোটোগ্রাফার রামকি শ্রীনিবাসন এই কাজে সঙ্গে পেয়েছিলেন নাগাল্যান্ডের পরিবেশকর্মী বানো হারালু, রোকো কুওতসু এবং মুম্বইয়ের জীববিজ্ঞানী শশাঙ্ক ডালভিকে। এনাদের প্রচেষ্টার ফলে বর্তমানে পাখি শিকার কমে প্রায় শূন্যে এসে ঠেকেছে।

রামকি শ্রীনিবাসন ছোটো থেকেই বন্যপ্রাণীর প্রতি অনুরক্ত ছিলেন, পরবর্তীকালে এই ঝোঁক থেকেই তিনি বন্য প্রাণী সংরক্ষণে উদ্যোগী হন। বিশেষত পাখি পর্যবেক্ষণ এবং সংরক্ষণের ক্ষেত্রে তিনি বেশি আগ্রহী। পেশাগত জীবনের শুরুতে তিনি একজন সফল চাকুরিজীবী ছিলেন। ২০০৮ সালে রামকি চাকরি ছেড়ে দিয়ে বন্ধু শশাঙ্ক ডালভির সঙ্গে ব্যাঙ্গালোরে ওয়াইল্ড-লাইফ ফোটোগ্রাফারদের নিয়ে একটি হাব তৈরি করেন। এই হাবের বিবিধ কার্যকলাপ পরিচালনা করার সময়েই পাখি শিকার সংক্রান্ত বেশ কিছু বিষয় তাঁর  নজরে আসে; তিনি লক্ষ্য করেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পাখ শিকারের উদ্দেশ্য হচ্ছে পাখিটির চামড়া ও মাংস, বেশ কিছু ক্ষেত্রে যা বেশ অর্থকরীও বটে। ২০১০ সালে পাখি শিকারের ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা এবং পাখি শিকার বিরোধী আইন প্রণয়নের পরেও নির্বিচারে পাখি শিকার চলছে। এই চোরাশিকার প্রতিরোধ করার জন্য রামকি 'কনজারভেশন ইন্ডিয়া' নামক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য ছিল চোরাশিকার বিরোধী পদক্ষেপ নেওয়া, এই বিষয়ে খোঁজখবর রাখা এবং সচেতনতা প্রসার করা। রামকির প্রতিষ্ঠিত 'কনজারভেশন ইন্ডিয়া' এখন দেশের বৃহত্তম সংরক্ষণ পোর্টাল।

আরও পড়ুন : দু বছরে সাতশো কেজি প্লাস্টিক অপসারণ : নজির কলেজপড়ুয়ার

নাগাল্যান্ডে আমুর বাজপাখি শিকার বন্ধ করতে গিয়ে রামকি দেখেন যে ডোয়াং উপত্যকার অধিবাসী প্রায় সমস্ত পরিবারই কোনো না কোনো ভাবে এই চোরাশিকারের সঙ্গে যুক্ত। এতে অল্প শ্রমে বেশি রোজগার হয়, তাই স্থানীয় দরিদ্র মানুষেরা চোরাশিকারে আগ্রহী হয়েছেন। তাছাড়াও বাস্তুতন্ত্র বা পরিবেশের ভারসাম্য সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান না থাকায় তাঁরা এই চোরাশিকারের অপকারিতা সম্বন্ধেও জানতেন না। রামকি তাঁর  দল নিয়ে নাগাল্যান্ডে যান এবং এই চোরাশিকার এবং শিকারিদের ছবি তোলেন। রামকির এই পদক্ষেপের ফলে আন্তর্জাতিক স্তরে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয় এবং স্থানীয় প্রশাসনেরও টনক নড়ে। অল্প সময়ের মধ্যেই স্থানীয় প্রশাসন এবং বন দফতর আমুর বাজ শিকারের বিরুদ্ধে নতুন নির্দেশিকা প্রকাশ করেন এবং শিকার প্রতিরোধের উদ্যোগ নেন। 

আরও পড়ুন : নতুন গাছের নামে জুড়লেন ডিক্যাপ্রিও : পরিবেশ সংরক্ষণের প্রচেষ্টাকে অভিনব কুর্নিশ

তবে রামকি বুঝেছিলেন যে শুধু আইন প্রয়োগ বা প্রশাসনিক পদক্ষেপে এই চোরাশিকার বন্ধ হবে না, এর জন্য সবচেয়ে জরুরি স্থানীয় মানুষের সচেতনতা। সেই সচেতনতা প্রসারের উদ্দেশ্যেই তিনি ডোয়াং উপত্যকার বিভিন্ন জায়গায় কর্মশালা শুরু করেন, সেখানে মানুষদের বোঝাতে থাকেন পাখিদের পরিযান সম্পর্কে, বাস্তুতন্ত্র ও পরিবেশের ভারসাম্য সম্পর্কে। রামকির এই দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ ফলপ্রসূ হয়, স্থানীয় মানুষরা বুঝতে পারেন আমুর বাজ শিকার অবৈধ এবং এতে পরিবেশের বিপুল ক্ষতি হচ্ছে। এরপর আরও কিছুদিন সময় লাগলেও আস্তে আস্তে মানুষ সচেতন হয়ে ওঠে আর শিকার বন্ধ করে, বরং তারাই এরপর আমুর বাজ সংরক্ষণে উদ্যোগী হয়। তারা নজরদারি শুরু করে যাতে কেউ আমুর বাজপাখি শিকার করতে না পারে। এছাড়াও জেলেদের পরিত্যক্ত জালে আটকে পরা বাজগুলিকে উদ্ধার করেন তাঁরা। এইভাবেই শিকারি থেকে সংরক্ষক হয়ে উঠেছেন নাগাল্যান্ডের ডোয়াং উপত্যকার মানুষেরা।

.............................


#Amur falcon #Preservation #Bird #Environment #পরিবেশ ও প্রাণচক্র #মন্দিরা চৌধুরী #সিলি পয়েন্ট #ওয়েবজিন #Web Portal

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

37

Unique Visitors

219180