লকডাউনের দিনলিপি : আহত সময়ের মরমী দলিল
বই : লকডাউনের দিনলিপি (বাংলার মেয়েদের লড়াই ও সংগ্রাম) লেখক : জিনাত রেহেনা ইসলাম প্রচ্ছদ : দেবাশীষ সাহা প্রকাশক : সৃষ্টিসুখ প্রথম প্রকাশ : অক্টোবর, ২০২১ মুদ্রিত মূল্য : ২৪৯ টাকা
৮ টার মেদিনীপুর লোকালে প্রশান্তদার চা আমাদের বাঁধা রুটিন ছিল রোজ। লকডাউনের পরে আর দেখতে পাইনি। ফোনেও পাইনি কখনও। ফেরত পেয়েছি ঝালমুড়িওয়ালা বিশুদাকে, চালভাজা বিক্রেতা শান্তিদিকে। পাইনি গামছার ব্যাপারি সেই ভদ্রলোককে, যার মুখের সঙ্গে স্তালিনের মুখাবয়বের মিল পেতাম। পুরনো প্রাত্যহিকের চেনা চেনা হাসিমুখগুলো কিছু আছে, কিছু জাস্ট রবার দিয়ে মুছে দিয়েছে কেউ।
গত বছরের অপরিকল্পিত অপরিণামদর্শী লকডাউন খেটে খাওয়া মানুষের সামান্য রুজিরোজগারে যে ভয়ংকর থাবা মেরেছিল, তার ঘা এখনও দগদগে। এখন চাকা ঘুরছে। দুনিয়া অনেকাংশেই সচল হয়েছে। যারা বেঁচে গেছেন, আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়াচ্ছেন তাঁরা। কিন্তু কত মানুষকে ময়দানই ছেড়ে দিতে হয়েছে সে হিসেব কি কোনও সরকার রেখেছেন? রাখার প্রয়োজন বোধ করেছেন?
হিসেব রাখার চেষ্টা করেন কেউ কেউ। শুধু শুকনো হিসেব রাখা নয়, পাশে দাঁড়িয়ে সাহস দেওয়া, লড়াইয়ের পথে এগিয়ে দেওয়া একটু। গোটা লকডাউনকালে গ্রামবাংলার খেটে খাওয়া মহিলাদের জন্য এই জরুরি কাজটিই করেছেন জিনাত রেহেনা ইসলাম। আর তার কাহিনি লিপিবদ্ধ করেছেন সদ্যপ্রকাশিত এই বইটিতে। বইটি তাঁর পরিশ্রমী ফিল্ডওয়ার্কের ফসল। ইন্টারনেট বা কাগজপত্র ঘেঁটে নয়, মাঠে-ময়দানে ঘুরে ঘুরে খেটেখুটে জোগাড় করা তথ্য। বাংলার মানচিত্র জুড়ে ছড়িয়ে থাকা আঞ্জিরা, সামিলা, লাইলি, পুষ্পরানি, ললিতা, মমিনা বিবিদের আশা, আশঙ্কা, ঘাম, চোখের জল, হেরে যাওয়া, ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা, দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই - সবটাই জিনাতের নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করা। এঁদের কেউ বিড়ি-শ্রমিক, কেউ গৃহসহায়ক, কেউ রেশম চাষ করেন, কেউ টায়ার বানানোর কাজ করেন, কেউ দিনমজুর, কেউ লোকসঙ্গীত শিল্পী, কারও কাঁথার ব্যবসা, কারও বা ক্যাটারিং ব্যবসা। অবশ্য প্রেজেন্ট টেন্স ব্যবহার করা ভুল হল। অভিশপ্ত লকডাউন এঁদের সবাইকে এক ধাক্কায় বেরোজগার করে দিয়েছে। এঁদের সঙ্গে কথোপকথনের ভিত্তিতে তৈরি হয়েছে এই বইয়ের প্রথম অংশের নিবন্ধগুলি। মোটামুটি তিনটি আয়স্তরের মহিলাদের চিত্র উঠে এসেছে এখানে। এক, আগে থেকেই দারিদ্র্যের চরমসীমায় যারা ছিলেন, লকডাউন যাঁদের কাছে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা। দুই, স্বচ্ছল না হলেও যাঁদের মোটামুটি খাওয়া-পরার সংস্থান হয়ে যেত, কিন্তু লকডাউন আচমকা অসহায় করে দিয়েছে। তিন, যারা মোটামুটি স্বচ্ছল, ছোটমাপের উদ্যোক্তা। বেশ কিছু মানুষের, বিশেষত মহিলাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করেছিলেন। লকডাউন অথৈ জলে ফেলে দিয়েছে। এক-একজন মহিলাকে নিয়ে, তাঁদের পরিবার, পেশা, লকডাউনের ফলে তৈরি হওয়া তীব্র সংকট ইত্যাদি নিয়ে এক-একটি আলাদা কেস-স্টাডিমূলক লেখা। এই অংশটিই এই বইয়ের সম্পদ। বইয়ের দ্বিতীয় অংশে রয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে রচিত নারীভাবনাকেন্দ্রিক কিছু নিবন্ধ। আমাদের পিতৃতান্ত্রিক সমাজে মহিলাদের স্বাবলম্বী হওয়া বা হতে চাওয়া বিষয়টা নিজেই একটা অত্যন্ত জরুরি স্টেটমেন্ট। জিনাত সেই বিষয়েই ফোকাস করতে চেয়েছেন, কারণ এ বই তিনি উৎসর্গ করেছেন "বিশ্বে সমস্ত লড়াকু মহিলাদের, যাঁরা বিশ্বাস করেন, প্রতিদিনের ভাতের থালাটা নিজেদের উপার্জনের অর্থে প্রস্তুত হোক।"
অনেকদিন আগে একটি প্রাচীন চিনা অভিশাপের বয়ান শুনেছিলাম - "May You Live in Interesting Times"। এটা কেন অভিশাপ, বুঝিনি তখন, কারণ 'Interesting' শব্দের অর্থ ধরতে পারিনি। অতিমারি এসে সেই অভিশাপের নিহিত অর্থ বুঝিয়েছে। আমাদের সদ্য পেরিয়ে আসা সেই 'আকর্ষণীয়' সময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও মরমী ডকুমেন্টেশন হয়ে থাকল জিনাত রেহেনা ইসলামের এই বইটি। সাম্প্রতিক অতীতে এ-ই তো বাংলার আসল মুখ। দেখতে সাহায্য করার জন্য লেখককে ধন্যবাদ। কোভিডকাল নিয়ে আগ্রহী সমাজবিদ্যা বা অর্থনীতির হবু গবেষকদের কাছে এটি একটি নির্ভরযোগ্য আকরগ্রন্থ হবে।
#বই #জিনাত রেহেনা ইসলাম #সৃষ্টিসুখ #সিলি পয়েন্ট