ফিল্ম/ওয়েব সিরিজ রিভিউ

রোমাঞ্চ আর রসবোধের ককটেলে একটুকরো অহং

সুচরিতা বসু June 16, 2021 at 10:28 am ফিল্ম/ওয়েব সিরিজ রিভিউ

সিরিজঃ ফ্যামিলি ম্যান
মরসুমঃ ২
পরিচালকঃ সুপর্ণ ভার্মা
নির্মাতাঃ রাজ নিদিমোরু, কৃষ্ণা ডি.কে.
মাধ্যমঃ অ্যামাজন প্রাইম

একটা সফল স্পাই-সিরিজকে ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য মোটামুটি যা-যা করার ছিল, নির্মাতা-জুটি রাজ ও ডি.কে. ‘ফ্যামিলি ম্যান’-এর দ্বিতীয় মরসুমে সেই সবকিছুই নিপুণভাবে করেছেন। প্রথম মরসুমের গল্প যেখানে শেষ হয়, ভারতীয় ওয়েব-দর্শকদের কাছে সেই ক্লিফ-হ্যাঙ্গার নেহাত সুখের নয়। জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার সিক্রেট এজেন্ট শ্রীকান্ত তিওয়ারির সংসার আর সংকল্প দুইয়ের উপরেই ঝুলছিল প্রশ্নচিহ্ন। নতুন পর্ব বেরনোর আগে অবধি দর্শকের কাছে কোনও উত্তরই স্পষ্ট ছিল না। 

এবারের গল্পে সব প্রশ্নকে একে একে ছুঁয়ে গেছে টানটান চিত্রনাট্য। ট্রেলার দেখে বোঝার উপায় ছিল না যে শ্রীকান্তের চাকরি বদলের কারণ সাংসারিক টানাপোড়েন, নাকি নৈতিক দংশন! জঙ্গিহানায় সহকর্মীদের হারানো, সংস্থার মুখ বাঁচাতে সেই হামলাকে যান্ত্রিক দুর্ঘটনা বলে চালানো, কাশ্মীরি ছাত্রের গায়ে জঙ্গি তকমা বসানো – সবকিছুই শ্রীকান্তকে বাধ্য করে তাঁর বিবেকের মুখোমুখি হতে। কিন্তু কাজ ছাড়লেও কাজের নেশা তাঁকে ছাড়ে না! অফিসের শুকনো রিপোর্টের বদলে প্রাক্তন সহকর্মীর থেকে শোনা তদন্তের বিবরণ তাঁকে অ্যাড্রেন্যালিন জুগিয়ে চলে। তবে তারপরেও সংসারের সেরোটোনিন-মাত্রা রয়ে যায় কমতির দিকেই। চাপা অস্বস্তি কুরে কুরে খেতে থাকে সুচিত্রাকে; দাম্পত্যের সমীকরণ জটিল হতে থাকে আর তার দমকায় এলোমেলো হতে থাকে সন্তানদের জীবন। সিরিজের এই ভাগে ধৃতির বয়ঃসন্ধির মেজাজ, বাবা-মায়ের ঝগড়ার মাঝে অন্য কারো প্রতি নির্ভরতার আকাঙ্ক্ষা – টুকরো টুকরো ছবিতে সবকিছু সুন্দর করে বুনে রাখা আছে।  

শ্রীলঙ্কার মুক্তিকামী তামিলদের সন্ত্রাসবাদী ছক ঘিরেই এগিয়েছে এই মরসুম। সে কাহিনি বিস্তারিত বলা মানে দর্শককে থ্রিলারের মেজাজ থেকে বঞ্চিত করা, বরং এটুকু বলা যায়, ভারতীয় ওয়েব-মাধ্যমে এত ঝকঝকে, নিটোল, অ্যাকশন-সমৃদ্ধ কাজ বিশেষ নেই। প্রতিটি অ্যাকশন দৃশ্যে ক্যামেরার কাজ তারিয়ে তারিয়ে দেখার মতো; ভীরারান্যাম শহরতলির থানা ঘেরাও করে মূল সন্ত্রাসবাদী রাজিকে ছাড়ানোর দৃশ্যগ্রহণ, মুসাকে ঘিরে হাসপাতালের সেই খণ্ডযুদ্ধের উত্তেজনাকেও ছাপিয়ে যায়। গোটা দৃশ্যে ক্যামেরার টানা শট দেখলে মনে হয় ফার্স্ট পার্সন শ্যুটিং গেমের মধ্যে বসে আছি! সিরিজ জুড়ে জায়গায় জায়গায় গেরিলা কায়দায় ফ্রেম এঁকে গেছেন চিত্রগ্রাহক এরিক ব্রাইসন। রাজি’র চরিত্রে সামান্থা আক্কিনেনি তো এই মুহূর্তে দেশ জুড়ে জনপ্রিয়। তাঁর চাউনি, শরীরী ভাষা, ক্ষিপ্রতা – সবটুকু দিয়ে রাজিকে তিনি জ্যান্ত করে তুলেছেন। ব্ল্যাকফেস বিতর্ক সরিয়ে রেখে নিঃসংশয়ে বলা যায় এই চরিত্রের কাস্টিং প্রশ্নাতীত। দলনেতার নির্দেশ আসার আগে ও পরে, শিকারের খোলস ছেড়ে শিকারির বেরিয়ে আসার পরিবর্তনকে ধাপে ধাপে নিজের অভিব্যক্তিতে গেঁথে নিয়েছেন সামান্থা। মুখোমুখি জেরার সময় শ্রীকান্তের কর্তৃত্বকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ ঠুকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবেও সমীহ আদায় করে নেন তিনি। এই সিরিজের অন্যতম প্রাপ্তি, সাদা-কালোর নিরন্তর দ্বন্দ্বের ফাঁকে ধূসরের ইঙ্গিতটুকু সরাসরি বজায় রাখা। তাই রাজি’র মতো যোদ্ধাকেও জঙ্গি না ভেবে পথভ্রষ্ট বিপ্লবী ভাবতে অসুবিধা হয় না, ভাস্করনের লড়াইকে সমর্থন না করেও তাঁর ক্ষোভকে সম্মান জানানো যায়। তবে সাজিদ বা মেজর সমীরের কর্মকান্ডকে অমানুষিক বলেই দাগিয়ে দেওয়া চলে। রাজি’র লড়াকু ব্যক্তিত্বের প্রতি সাজিদের সম্মান কোথাও গিয়ে হয়তো তাঁকে কাঠিন্যের বর্ম আলগা করতে বাধ্য করে; সে বর্ম আবার এঁটে যায় সাজিদের মৃত্যুসংবাদ শুনে রাজি’র তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে উঠে যাওয়ার দৃশ্যে। এরকম বহু ছোট ছোট দৃশ্য জুড়ে বিভিন্ন চরিত্রকে কাটাছেঁড়া করতে করতে চিত্রনাট্য এগিয়েছে। শুধু গল্পকে পোক্ত করাই নয়, তাকে মানবিক করে তুলতেও এর গুরুত্ব অনেক। 

কথাটা সব দৃশ্য বা চরিত্রের জন্য অবশ্য সত্যি নয়। স্পেশ্যাল ফোর্সের দপ্তরে গানের পছন্দকে ঘিরে আমরা-ওরা বা ইডলি-সম্বরের বহু চর্চিত রসিকতা শুধু একঘেয়ে নয়, অপ্রয়োজনীয়। প্রধানমন্ত্রীর সচিবের চরিত্রে বিপিন শর্মা’র মতো বলিষ্ঠ অভিনেতার কিছুই করার ছিল না, তাঁর ম্যানারিজমের দৃশ্য না থাকলেও সিরিজের বিন্দুমাত্র ক্ষতি হতো না। প্রধানমন্ত্রীর চরিত্রে সীমা বিশ্বাস এবং ধৃতির প্রেমিকরূপী অভয় ভার্মা দুজনেই যথাযথ। তবে কিশোর-জুটির প্রেমকাহিনির অমন ভয়াবহ পরিণতি আগামী গল্পে জটিলতার আভাস দিয়ে রাখে। ইন্সপেক্টর উমায়ার্ল ও মুথু’র চরিত্রে দেবদর্শিনী ও রবীন্দ্র বিজয় গোটা গল্প জুড়ে শ্রীকান্ত-জেকে’র জুটিকে যোগ্য সংগত করে গেছেন। অন্যদিকে শারিব হাশমি নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন জেকে তালপাড়ে চরিত্রে, শ্রীকান্তরূপী মনোজ বাজপেয়ীর সঙ্গে তাঁর বোঝাপড়া অতুলনীয়। বস্তুত শারিব না থাকলে মনোজের রসবোধের তারাবাতি এত রোশনাই দেখাতে পারত কিনা সন্দেহ। একই কথা শ্রীকান্তের ছেলের চরিত্রে বেদান্ত সিন্‌হার জন্যও খানিক প্রযোজ্য। তার সাবলীল অভিনয়, মিষ্টি ভালোলাগা ও কমিক টাইমিং-এর পরিসর তৈরি করে। মনোজের কথা আলাদা করা বলাটাও বাতুলতা; প্রথম মরসুমে উইট আর উইল পাওয়ারের যে মিশ্রণ তিনি নিয়ে এসেছিলেন, এই মরসুমে তাকে আরও ধারালো করেছেন। গোপন অভিযানের অংশ হতে চেয়ে খাঁচাবন্দি বাঘের মতো শ্রীকান্তের পায়চারি, অ্যাকশন কিংবা ব্যক্তিগত যন্ত্রণা, কোনও দৃশ্যেই মনোজ কিছুমাত্র খামতি রাখেন না। তবে হিউমরে তিনি এবং চিত্রনাট্য একে অন্যের পরিপূরক। বিশেষ উল্লেখের দাবিদার আরও একটি মানুষ – প্রাক্তন ইন্টেলিজেন্স অফিসার চেল্লাম। খিটখিটে, প্যারানয়েড এবং প্রায়-অবাস্তব এই চরিত্রটি শ্রীকান্তের সিধুজ্যাঠা। চিত্রনাট্যের এই অংশটি কিঞ্চিৎ দুর্বলও বটে। ইনি না থাকলে কীভাবে শ্রীকান্ত-জেকে বিভিন্ন সময়ে জঙ্গিদের হদিস পেত, তা বোঝা দায়! 

দুর্বলতা এক নয়, একাধিক। জঙ্গিদের দুই ঘাঁটি, চেন্নাইয়ের ফ্লাইং ক্লাব আর ভীরারান্যামের মধ্যে গাড়িতে ৭-৮ ঘন্টার দূরত্ব (অন্তত গুগল ম্যাপ তাই বলে)। গুলিতে আহত রাজি এতটা রাস্তা এসে, রক্তক্ষরণের পরেও কোনোরকম ব্লাড ট্রান্সফিউশন ছাড়াই সুস্থ হয়ে যায়? চেন্নাই থেকে মুম্বইয়ের ২২ ঘন্টার রাস্তা একবেলাতেই সাজিদ গাড়ি চালিয়ে অতিক্রম করে ফেলে? আরও আশ্চর্যের বিষয়, থানার সর্বেসর্বা অফিসার ফর্ম্যালিনের গন্ধ চেনেন না? থানার মতোই মর্গও তো তাদের ঘর-বাড়ি! তবে গোড়ায় এটুকু গলদ মেনে নিলেও সিরিজের রসাস্বাদনে কোনও সমস্যা হয় না। মুখ তেতো হয় অন্যত্র। 

ভারতীয় চলচ্চিত্র কারিগরি বা কাহিনির দিক থেকে অগ্রসর হলেও কিছু স্টিরিওটাইপ ছেড়ে যে বেরোতে পারেনি, এই সিরিজ তার নিরুচ্চার নিদর্শন। সমাজে যেখানে মানসিক সমস্যা এমনিতেই একটা ট্যাবু, সেখানে শ্রীকান্তের গোঁড়ামি জাস্টিফাই করতে সুচিত্রার কাউন্সিলরের চরিত্রকে লঘু রসিকতায় দেখানোটা শুধুমাত্র নিম্নরুচির পরিচয়। দুনিয়ার কোন কাউন্সিলর তার ক্লায়েন্টকে সম্পর্ক ধরে রাখার জন্য মিথ্যের উপর ভরসা করতে বলেন, একা নির্দেশকই জানেন! গল্পের খাতিরে কিছু জায়গায় যে মহিলাদের আর্থিক ও সামাজিক স্বাধীনতার ধারণাই প্রশ্নের মুখে পড়ছে, সেকথাও হয়তো কেউ ভাবেননি। মেয়েদের স্বাধীন সিদ্ধান্ত আসলে তাদের জন্যই ক্ষতিকর – সুচিত্রা আর ধৃতির পরিণতি যেন সেদিকেই ইঙ্গিত করে; নিজের মতামত সোজাসুজি ব্যক্ত করার জন্য ‘ফেমিনাৎজি’ বিশেষণই জোটে মেয়েদের কপালে। আগামী মরসুমে ভারতের অন্যপ্রান্তে দুষ্টচক্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামবেন শ্রীকান্ত, কলকাতা ছুঁয়ে যাবে তাঁর বিজয়রথ। স্বাধীনচেতা মেয়েদের বুক দিয়ে আগলে রাখে এই শহর – নির্মাতারা খেয়াল রাখবেন তো? 



[ কভার : আলোচ্য ওয়েব সিরিজথেকে নেওয়া একটি স্থিরচিত্র] 

#বাংলা #রিভিউ #ওয়েব সিরিজ #ফ্যামিলি ম্যান #সুচরিতা বসু

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

28

Unique Visitors

219142