রবীন্দ্রনাথের কথায় কবি হবার উৎসাহ হারিয়েছিলেন শিবরাম?
কবি হতে চেয়েছিলেন শিবরাম চক্রবর্তী। অন্তত প্রথম জীবনে। পরবর্তীকালে, যে কারণেই হোক, সে ইচ্ছা থেকে তিনি সরে এসেছিলেন। আমরা পেয়েছি রসসাহিত্যের রাজাধিরাজকে। কিন্তু বাংলা সাহিত্য যে কবি শিবরাম চক্রবর্তীকে সেভাবে বিকশিত হতে দেখল না, তার পিছনে কি পরোক্ষ কোনও ভূমিকা ছিল কবিগুরুর?
শিবরাম সাহিত্যজীবন শুরু করেছিলেন কবিতা দিয়ে। সে সময়ে ভারতী, বিজলী, ভারতবর্ষ, আত্মশক্তি, কালিকলম, দেশ, উত্তরা, ধূপছায়ার মতো নামী পত্রিকায় নিয়মিত তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। ১৯২৯ সালে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর দুটি কাব্যগ্রন্থ - 'চুম্বন' আর 'মানুষ'। এই দুটি বই রবীন্দ্রনাথ পড়েছিলেন। প্রতিক্রিয়া হিসেবে ১৯২৯ সালের ১০ নভেম্বর তারিখে শিবরামকে একটি চিঠিতে তিনি লেখেন -
"তোমার কাব্যদুটি পড়েছি। ভাষা ও ছন্দের উপর তোমার অধিকার আছে সে আমি পূর্বেই দেখেছি। কেবল আমার এই মনে হয়, অন্তরঙ্গ যেসব অভিজ্ঞতা কাব্যে গভীর ভিত্তির উপর বিচিত্রভাবে দৃঢ়ভাবে ধ্রুবকীর্তির প্রতিষ্ঠা করে, তোমার লেখায় এখনো তার প্রকাশ হয়নি। কাব্যের দাবি চিরদিনের পরে - সেই দাবি স্বীকৃত হয় যে মূল্য দিলে, সে মূল্য কেবল বাহিরের নৈপুণ্যে নয়, অন্তরের টানে। তোমার কাছ থেকে সেই দানের অপেক্ষা রইল।"
গবেষক, প্রবন্ধকার অমিতাভ চৌধুরী এ বিষয়ে মন্তব্য করেছেন, "আমার অনুমান, রবীন্দ্রনাথের ওই চিঠি পেয়ে শিবরাম আর কাব্যরচনায় তেমন উৎসাহ দেখাননি।"
আর কবি হবার বাসনা পরিত্যাগ করার কারণ হিসেবে শিবরাম নিজে উল্লেখ করেছেন বুদ্ধদেব বসুর কথা। বুদ্ধদেবের বড় মেয়ের বিয়েতে নিজের লেখা বই উপহার দিয়ে ভিতরের পাতায় একটি ছড়া লিখে দিয়েছিলেন তিনি। বুদ্ধদেব সেই ছড়ার ভূয়সী প্রশংসা করেন। তা থেকেই শিবরামের ধারণা হয়, কবিতা তাঁর দ্বারা হবে না। 'ভালবাসা পৃথিবী ঈশ্বর' বইয়ে এই ঘটনার উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন - "বুদ্ধদেবকে আমার, গদ্য কি পদ্য কোনো লেখার প্রশংসা করতে শুনিনি কখনো, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে হয়ে যাওয়া ওই চার ছত্রের সাধুবাদে সেদিন তাঁকে মুক্তকণ্ঠ হতে দেখলাম। আর, তাই থেকেই আমার ধারণা হল, আমার কোনো লেখাই কিছু হয় না, কবিতা তো নয়ই। আর তাই থেকেই, বলতে কি, কবিতা রচনা আমি প্রায় ছেড়েই দিয়েছি।"
আরও পড়ুন : এক সন্ন্যাসী প্রেমিকের গল্প : সুরমা ঘটককে পাঠানো ঋত্বিকের চিঠিপত্র / অর্পণ দাস
তবে একজন মহৎ সাহিত্যিকের জীবনের একটি বড় সিদ্ধান্তগ্রহণের কারণ খুঁজতে গিয়ে এত সরলীকরণের শিকার হওয়া উচিত নয়। সে তিনি নিজে যা-ই বলুন না কেন। কবিগুরুর বক্তব্যে নিশ্চয়ই সারবত্তা খুঁজে পেয়েছিলেন শিবরাম। নিজের মধ্যে কবি হিসেবে অমর হবার উপাদান তিনি নিজেও নিশ্চয়ই দেখতে পাচ্ছিলেন না। সে কারণেই বুদ্ধদেবের প্রশংসার পিছনেও খুঁজে পেয়েছিলেন নিজের ধারণারই ছায়া। সাধ আর সাধ্যের তফাৎ সম্ভবত নিজেই টের পেয়েছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ বা বুদ্ধদেব বসুর প্রতিক্রিয়া তাঁর নিজের মনোভাবকেই দৃঢ় ভিত্তি দিয়েছিল। বুদ্ধদেবের ঘটনার অনতিপরেই শিবরাম যা লিখেছেন, তাতে সেই আভাসই পাওয়া যায়। তিনি লিখছেন -
"কবিতা আমার হয় না। আসেই না।
আমি কবি নই।
কারণ ওই একটাই। কবিতা আমার আসে না।
কবিতার ওই এক দোষ। হলেই হয়। নাহলে কিছুতেই হয় না। হওয়ানো যায় না একদম।
হনুমানের লেজের মতই প্রায়। আপনার থেকেই হবার। টেনে বার করার নয়। কবিতা করা যায় না কিছুতেই।
কবিতা তাজমহলের মত গড়ে তোলার বস্তু নয়, ফুলের মতন হয়ে ওঠার।
আমার অজস্র ছন্দাকারের ভেতর অমনি আপনার থেকে যদি কখনো কিছু কিছু হয়ে গিয়ে থাকে তো সেগুলিই শুধু কবিতা হয়েছে। সেগুলি যে কোনগুলি তা আমি জানি না। বলতে পারি না। সেই হেতুই আমার সব কবিতা পত্রপত্রিকার গর্ভেই বাজেয়াপ্ত রয়েছে, বই হয়ে বেরয়নি এখনও। প্রকাশের আমার উৎসাহই হয়নি আদপে।"
আরও পড়ুন : অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ হয় : মুজতবা আলীর আফগানিস্তান ও এখন / মামুন রশীদ
সব মিলিয়ে, ওই দুটি কাব্যগ্রন্থ ছাড়া আর শিবরামের আর কোনও কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ পায়নি। কবি হিসেবে শিবরামকে মনে রাখি না আমরা। বাঙালি পাঠকের অতি প্রিয় ব্রামবাবু প্রকৃত নিজেকে খুঁজে পেয়েছিলেন হাস্যরসাত্মক সাহিত্যে। কিন্তু কবিতার পাশাপাশি মনে রাখা দরকার তাঁর প্রবন্ধ ও নাটক রচনার প্রয়াসকেও। 'মস্কো বনাম পণ্ডিচেরি' বা 'আজ এবং আগামীকাল'-এর মতো প্রবন্ধগ্রন্থগুলিকে শিবরাম নিজে তরুণ বয়সের সহজাত স্পর্ধা বলে মনে করলেও প্রকৃত প্রস্তাবে এদের উপেক্ষা করা কঠিন। চাকার নীচে, যখন তারা কথা বলবে, লাল ফিতের ফাঁস ইত্যাদি অসাধারণ একাঙ্ক নাটকও তিনি লিখেছেন। আর কে-ই বা ভুলতে পারে তাঁর আত্মজৈবনিক রচনা 'ঈশ্বর পৃথিবী ভালোবাসা' আর 'ভালোবাসা পৃথিবী ঈশ্বর' -এর কথা!
বাকি সমস্ত সম্ভাবনা সরিয়ে রেখে বিদূষকের ভূমিকা বেছে নিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু নিছক 'কিশোর সাহিত্যিক' বলে ব্রামবাবুকে চিহ্নিত করার জো আছে কি?
….………….
ঋণ : ১) ভালবাসা পৃথিবী ঈশ্বর, শিবরাম চক্রবর্তী, নবপত্র প্রকাশন।
২) রবীন্দ্রনাথ ও শিবরাম, অমিতাভ চৌধুরী, কোরক সাহিত্য পত্রিকা, বইমেলা সংখ্যা ১৯৯০।