অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ হয় : মুজতবা আলীর আফগানিস্তান ও এখন
আফগানিস্তানকে বাদ রেখে ভারতবর্ষের ইতিহাস পূর্ণ হয় না। কাবুল, কান্দাহার, খাইবার গিরিপাস-এই ভৌগলিক পথ ধরে ভারতবর্ষে এসেছেন- আর্যরা, এসেছেন বাদশা সিকান্দার, সুলতান মাহমুদ, বাবর, পাঠান, মুঘলরা। এসেছেন বখতিয়ার খিলজি, এসেছেন হিউয়েন সাঙের মতো পর্যটক। সেই অর্থে (অতীশ দীপঙ্করকে স্মরণে রেখেই)বাঙালির ভারতবর্ষের বাইরে যাবার খুব বেশি অভিজ্ঞতা নেই, নেই গুরুত্বপূর্ণ অভিযানও। এদিক থেকে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম সৈয়দ মুজতবা আলী। তিনি নরম পলিমাটির গণ্ডি পেরিয়ে, খাইবার গিরিপাস দিয়ে পৌঁছেছিলেন রুক্ষ ভূমির দেশ আফগানিস্তানের কাবুলে।
১৩ সেপ্টেম্বর ১৯০৪ সিলেটে জন্ম নিয়েছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলী। উদার ও পরিপূর্ণ এক মানুষ ছিলেন তিনি। ছিলেন শান্তিনিকেতনের প্রথম মুসলিম আশ্রমিক, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের প্রিয় ও কৃতি ছাত্র। জন্ম শতবর্ষ উদযাপনের দ্বারপ্রান্তে আমরা। তিনি ১৯২৭-১৯২৯ পর্যন্ত কাজ করেছেন আফগানিস্থানের শিক্ষা বিভাগে। এসময়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখেন ভ্রমণ কাহিনী ‘দেশে বিদেশে’। এই ভ্রমণ গদ্যে তিনি বাঙালির সঙ্গে আফগানদের নতুন সম্পর্ক স্থাপন করেন। এই ভ্রমণ গদ্যের মধ্য দিয়ে সৈয়দ মুজতবা আলী আফগানিস্তানের রাজনীতি, ইতিহাস এবং দেশটির ভূত-ভবিষ্যত সম্পর্কে ধারণাও আগামীর হাতে তুলে দেন।
ভ্রমণকাহিনির শুরু হাওড়া স্টেশন থেকে পেশওয়ারের দিকে ট্রেনযাত্রার মাধ্যমে। আর শেষ হবার আগের অধ্যায়ে রয়েছে, কাবুল বিমানবন্দরে প্লেনে বসে বাইরের দৃশ্যের বর্ণনা। তিনি লিখেছেন, ‘তাকিয়ে দেখি দিকদিগন্ত বিস্তৃত শুভ্র বরফ। আর অ্যারফিল্ডের মাঝখানে, আবদুর রহমানই হবে, তার পাগড়ির ন্যাজ মাথার উপর তুলে দুলিয়ে দুলিয়ে আমাকে বিদায় জানাচ্ছে। বহুদিন ধরে সাবান ছিল না বলে আবদুর রহমানের পাগড়ি ময়লা। কিন্তু আমার মনে হল চতুর্দিকের বরফের চেয়ে শুভ্রতর আবদুর রহমানের পাগড়ি আর শুভ্রতম আবদুর রহমানের হৃদয়।’
শুভ্রতম হৃদয়ের আবদুর রহমানের মধ্য দিয়ে আফগানদের যে পরিচয়, তাদের সরলতার যে দৃষ্টান্ত এবং তাদের সেই সরলতাকে কাজে লাগিয়ে পুরো দেশকে বিপদের মুখে ঠেলে দেবার যে উদাহরণ সৈয়দ মুজতবা আলী দেখিয়েছিলেন, সেই সংকট থেকে এই একশ বছরেও দেশটি বেরিয়ে আসতে পারেনি। তখন আফগানিস্তানের শাসক আমান উল্লাহ, শুরু করেছিলেন নানামুখী সংস্কার, যার অধিকাংশই ছিল খামখেয়ালিপনায় ভরা। তার সেই খামখেয়ালিপনাকে আফগানরা সুনজরে নেয়নি। ফলে, বিপুল সেনা থাকার পরও, ডাকাত সর্দার বাচ্চায়ে সকাওয়ের (হবীর উল্লা) ভয়ে তাকে বড় ভাই ইনায়েত উল্লার হাতে ক্ষমতা দিয়ে পালাতে হয়। অল্প সময়ের মধ্যেই এনায়েত উল্লাহও পালিয়ে বাঁচেন। বাদশাহী আসে ডাকাত সর্দার বাচ্চায়ে সকাওয়ের হাতে। তিনি ফরমান জারি করেন, ‘আমান উল্লাহ কাফির। কারণ সে ছেলেদের এলজেব্রা শেখাত, ভুগোল পড়াতো, বলত পৃথিবী গোল।’তার এই ফরমানের প্রতিবাদ করার মানুষও কিন্তু সেদিন সৈয়দ মুজতবা আলী পেয়েছিলেন। মীর আসলম। যার সম্বন্ধে তিনি লেখেন, ‘যতদিন আফগানিস্তানে মীর আসলমের মতো একটি লোকও বেঁচে থাকবেন ততদিন এ দেশের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে নিরাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই।’
আজ হয়তো মীর আসলমের মতো কেউ নেই, তাই ভর করেছে নিরাশা। যে নিরাশা ভর করেছিল নব্বইয়ের দশকেও। সেদিনও বাচ্চা সকাওয়ের মতো করেই, আফগানিস্তানের ক্ষমতায় এসেছিল উগ্র তালেবান গোষ্ঠী। সেবার ক্ষমতায় এসেই তারা গুড়িয়ে দেয় আফগানিস্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বৌদ্ধমূর্তি, ইতিহাসের অক্ষয় সব উপাদান। সম্রাট অশোকের পাঠানো শ্রমণের হাত ধরে আফগানিস্তানে প্রচার হয়েছিল বৌদ্ধধর্ম। যার নিদর্শন ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল মাটির তলা থেকে বেরিয়ে আসা বৌদ্ধমূর্তিতে। পাহাড়ের গায়ে, বামিয়ানের সবচেয়ে বড় বৌদ্ধমূর্তিতে। যার সবই গুড়িয়ে, মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়।
মাঝে আবারও হয় ক্ষমতার পালাবদল। কিন্তু নানা ঘাত-প্রতিঘাতেও আফগানিস্তানে শান্তি আসেনি। রুক্ষ মাটি যেখানে, তেল, সোনা, সম্পদ কিছুই নেই-তবু লোভী হাত বারবার আবদুর রহমানদের দিকে উদ্দত সঙ্গীন হাতে দাঁড়ায়। সেই পথ বেয়েই চলতি বছরের ১৫ আগস্ট অকল্পনীয় দ্রততায় আবারও কাবুল দখল করে তালেবানরা। এবারও দৃশ্যায়ন হয়েছে সেই একশ বছর আগের ঘটনার। শাসকের পলায়ন। প্রগতিপন্থী মানুষের আফগানিস্তান ছাড়ার আকুলতা। কাবুল দখলের প্রায় তিন সপ্তাহ পর গত ৭ সেপ্টেম্বর ২০২১ মধ্যবর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে নাম ঘোষণা হয়েছে তালেবান নেতা হাসান আখুন্দের। যিনি নব্বইয়ের দশকে প্রথম তালেবান সরকারেও মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন।
তবে সরকার গঠনের মাধ্যমে যখন সবকিছু প্রায় নিয়ন্ত্রণে, তখনো কিন্তু সংঘাত থামেনি পানসিরে। সেই পানসির, যেখানে আবদুর রহমানের বাড়ি। যার সঙ্গে বাঙালির আত্মার সম্পর্ক গড়ে দিয়েছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলী। যেখানের বরফ ও হাওয়ায় ভেজাল নেই, যেখানের বরফে নেই বাবুয়ানী। যা সত্যিকারের খাঁটি বরফ।
থিয়েটার করতেন চারু মজুমদার / অর্পণ দাস
সুলেখক সৈয়দ মুজতবা আলী আমাদের নতুন করে চিনিয়েছিলেন আফগানিস্তানকে। সেই আফগানিস্তানে বারবার ভাতৃঘাতী দ্বন্দ্ব, প্রগতির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো বর্তমান পৃথিবীর জন্যও শঙ্কার। আফগানিস্তানে প্রগতিপরিপন্থীদের আজকের এই উত্থান, বর্তমান অবস্থা কি আমাদের জন্যও কোন বার্তা বহন করে আনে না? এই মনীষির জন্ম শতবর্ষের প্রাক্কালে, আমরা কি ক্ষুদ্র স্বার্থের বৃত্তে আটকে ভুলে থাকবো যে, ‘আফগানিস্তানের ইতিহাস না লিখে ভারত ইতিহাস লেখবার জো নেই। আফগান রাজনীতি না জেনে ভারতের সীমান্ত প্রদেশ ঠাণ্ডা রাখবার কোনো মধ্যমনারায়ন নেই।’
..............................