ফিচার

যুদ্ধে গোপন তথ্য পাচার করেছিলেন সুবোধ ঘোষ?

শৌভিক মুখোপাধ্যায় Mar 11, 2022 at 8:51 am ফিচার

শিরে সংক্রান্তি। আনন্দবাজারের তদানীন্তন স্বত্বাধিকারী সুরেশবাবুর কথা শুনে একথাই কি মনে হয়েছিল সুবোধ ঘোষের? সে কথা আজ আর জানার উপায় নেই। তবে দেশজোড়া বিক্ষুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে আইসিএস মিঃ রাওয়ের সঙ্গে দেখা করার কথা শুনে একটু হলেও থমকে গেছিলেন। আর দেখা করার পর আরই চমক। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে, তিনি যুদ্ধপরিস্থিতিতে শত্রুপক্ষের কাছে সরকার বিরোধী গোপন তথ্য প্রেরণ করেছেন।

 

অগস্ট আন্দোলনের কিছু পরের কথা। তখন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অশান্ত। দেশের বাইরেও। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যুযুধান দুই শিবির। বেকায়দায় ঔপনিবেশিক শক্তি। তর্জন গর্জন ছেড়ে আপাত 'শান্তিকল্যাণ'-এর দিকেই তারা বেশি আগ্রহী। ভারতে স্বরাজ আসুক আপত্তি নেই কিন্তু আগে যুদ্ধটা তো মিটুক। কদিন পরই না হয় দেওয়া যাবে স্বায়ত্ব শাসনের অধিকার। আপাতত আবেদন আন্দোলন ছেড়ে ভারতবাসীরা যুদ্ধে তাদের সাহায্য করুক শাসকের এটাই আর্জি। কংগ্রেসী নেতাদের মধ্যে অনেকেই জেলে। জনগণ বিভ্রান্ত। এমন সময় সাগরময় ঘোষের কাছে এসে সুবোধ ঘোষ বললেন, 'সাগরবাবু, আমি দেশ পত্রিকায় একটি উপন্যাস লিখতে চাই, আপনি ছাপবেন?'

সাগরময় ঘোষ আপত্তি করলেন না। দেশ-এর পাতায় প্রকাশিত হতে শুরু করল ‘তিলাঞ্জলি’। লেখকের প্রথম উপন্যাস। ততদিনে ছোটগল্পকার হিসেবে সুবোধ ঘোষ যথেষ্ট পরিচিত নাম। অনামী সংঘের আড্ডা থেকে বাংলা সাহিত্যের যে ছোটগল্পকারের জন্ম হয়েছিল, তিনি ততদিনে পেরিয়ে এসেছেন তাঁর যৌবনকাল। যদিও লেখক হিসেবে কৈশোর বেলার সূত্রপাত আরও আগে। ছোটবেলা থেকেই আর পাঁচজনের থেকে তার দেখার চোখ আলাদা। স্মৃতিশক্তিও। মনে রাখার আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল তাঁর। তাই মাঝে মাঝেই মনে পড়ে যায়, পিতামহের বন্ধু জিওলজিক্যাল সার্ভের প্রথম ভারতীয় ডিরেক্টর  নৃতত্ত্ববিদ পার্বতীনাথ দত্তের কথা, যার কাছে শোনা গল্পে কথায় উঠে এসেছিল নদী, পাহাড়, সমুদ্র, পাথর, নানা প্রাণীর ফসিলের কথা। অথবা দার্শনিক মহেশচন্দ্র ঘোষের লাইব্রেরি থেকে নিয়ে পড়া একের পর এক বই। কোনো নির্দিষ্ট রুটিন মেনে নয়, মনের আনন্দে আপনা থেকেই যাদের পাতা উল্টে ছোঁয়া আশ্চর্য জগৎ। যে পড়া সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি পরে বলেছেন 'ইচ্ছানুচালিত শিক্ষা'। ধর্মশালার সেই দারোয়ানটির কথা মনে পড়ে। দুপুরের খাওয়ার সম্বল মাত্র দুটি বাজরার রুটির দুটিই এগিয়ে দিয়ে বলেছিল, 'আপনি আজ এখনও কিছু খাননি বলে মনে হচ্ছে, তাই আমিও খেতে পারছি না। রুটিটা এখনই খেয়ে নিন।' এই মনে রাখা সময়ই তার গল্পের চালিকাশক্তি। নাম-না জানা মানুষদের পাশেই থেকেছেন চিরকাল। চাকরি সূত্রেও। রবিবাসরীয়র সাহিত্যবিভাগে পাঠানো গল্পের ফাইল ঘাঁটতে ঘাঁটতে নতুন লেখকদের গল্পে সামান্য অদলবদল করে দিতেন। কখনও আস্ত অনুচ্ছেদ যোগ হত, জুড়ে যেত নতুন পংক্তি। ভালো থেকে আরও ভালো হয়ে উঠত লেখাটি। সুচারু সম্পাদনার প্রতি কুর্নিশ জানিয়ে সম্পাদকের দপ্তরে লেখকের মুগ্ধতা এসে পৌঁছত। কখনও বা পরিতৃপ্ত পাঠক পত্র মারফত জানাত তার ভালো লাগা। তখন কী মনে হয়নি, এবার নিজে একটা গল্প লিখলেই হয়। তবু সেই ইচ্ছেকে ততটাও পাত্তা দেননি। পরে যখন কেজো লেখার বাইরে অন্য লেখার দিকে মন দিয়েছেন, তখন এইসব মুহূর্তরা এসে ভিড় করেছে কলমের মুখে। অভিজ্ঞতা চরিত্র হয়েছে, স্মৃতি হয়েছে পটভূমি। সময়ের ভিতর মানুষ কীভাবে বেঁচে আছে সেই সত্যিটুকু তুলে ধরতে চেয়েছিলেন তিনি। তার মাশুলও দিতে হয়েছে। ফসিল ও অন্যান্য গল্প নিয়ে বই প্রকাশে এগিয়ে আসেননি কোনো নামী প্ৰকাশক। আর প্রথম উপন্যাস প্রকাশের পর জুটেছিল শত্রুপক্ষের গুপ্তচরের তকমা।

অবশ্য এই ঘটনা স্বাভাবিকই ছিল। উপন্যাসের বিষয়বস্তুই তার কারণ। লেখক নিজেও একথা জানতেন, ‘উপন্যাসে ব্রিটিশরাজ ও কম্যুনিষ্ট পার্টির কথা কাজ ও নীতির প্রতিবাদ আছে। জাতির স্বাধীনতার দাবি ও সংগ্রামের সমর্থন ও প্রশস্তি আছে। সুতরাং কম্যুনিষ্ট পার্টির মানুষ এবং যাঁরা পার্টির অনুগতজন তাঁরা তিলাঞ্জলির প্রতি বিদ্বিষ্ট হবেন, এটা স্বাভাবিক।’ পাশাপাশি এও তিনি জানতেন অন্যান্য মহলেও তাঁকে নিয়ে নিত্য আলোচনা চলে। ‘বইবাজারের ধুলো’ তাঁকে মাখতে হয়নি। চিরকাল ভিড়ের থেকে দূরে নিজেকে আগলে রেখেছেন। জড়িয়ে পড়েননি। এই নিরাসক্তির জন্য লোকের কাছে দাম্ভিক বদনাম কুড়িয়েছিলেন। সমালোচনার ঝড় উঠেছে। রচিত সাহিত্যের গুণাগুণ নিয়ে ততটা নয়, যতটা বড় বেশী লিখছেন এই অভিযোগ। এমনকি যখন কয়েক বছর লেখালেখির জগত থেকে বিশ্রাম নিয়েছেন তখনও এই অভিযোগ বর্ষিত হয়েছে। এইসবেরই মিলিত ফলশ্রুতিতে হয়ত গুপ্তচরের অপবাদের জন্ম। 

নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছলেন মি.রাও-এর বাড়ি। মি.রাও বললেন, ‘আপনার সম্পর্কে সরকারের কাছে অভিযোগ এসেছে আপনি আসামে গিয়ে শত্রুপক্ষ জাপানের সামরিক গোয়েন্দাদের সাহায্য করেছেন।’ এদিকে তিনি কস্মিনকালেও আসামে যাননি। সেকথা জানাবার পরেই আর বেশি কথা হলো না। দু-চার কথার পরেই মি.রাও খসখস করে লিখে দিলেন, ‘সম্পূর্ণ মিথ্যে অভিযোগ।’ অফিসারের স্ত্রী ছিলেন বাংলা সাহিত্যের ভক্ত। লেখকের লেখার সঙ্গে তাঁর পূর্ব পরিচয় ছিল। স্ত্রীর থেকে লেখক সম্পর্কে যেটুকু শুনেছিলেন তাতে মি.রাওয়ের ও মনে হয়নি সুবোধ ঘোষ এমন কোনও কাজের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারেন। সাক্ষাতে চক্ষু-কর্ণের বিবাদভঞ্জন। ফাঁড়া কাটল।

কিন্তু খচখচানি টুকু রয়ে গেল। সেটুকু মুছতে আরও কিছুদিন। অবশেষে ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট। আর কোনও গ্লানি রইল না।



গ্রন্থঋণ :  ঝিনুক কুড়িয়ে মুক্তো/ সুবোধ ঘোষ

কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ সৌমেন্দ্র পর্বত

আরও পড়ুন: যুগসন্ধির দ্বিধাকে ধারণ করে সময়ের প্রতিফলক হয়ে উঠেছিলেন ‘গুপ্তকবি’

#সুবোধ ঘোষ #সাহিত্যিক #ফিচার #সিলি পয়েন্ট #শৌভিক মুখোপাধ্যায়

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

11

Unique Visitors

219608