ব্যক্তিত্ব

মেয়েদের পোশাক নিয়ে মন্তব্যের কারণে কমিউনিস্টদের আক্রমণ করেছিলেন উৎপল দত্ত

তোড়ি সেন Aug 18, 2021 at 9:46 am ব্যক্তিত্ব

“যে জিনিস মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে আমি তাকে মানি না। রিলিজিয়ন এটা করে। আর অর্গানাইজড রিলিজিয়ন তো বটেই।”

সদ্য একটা দেশ ধ্বস্ত হয়ে গেল এই ধর্মের মোহে। সারা পৃথিবীকে এক ধর্মের আওতায় এনে ফেলার লক্ষ্য নিয়েই কাজ করে তালিবান কিংবা আইসিসের মতো জেহাদি গোষ্ঠীগুলি। আর সেই ধর্মরাজ্যে মনুষ্যত্বের যে কী হাল হয়, এতগুলো বছর ধরে পৃথিবী তা দেখে আসছে। তাই আফগানভূমে তালিবানি দাপট দেখতে দেখতে বারবার মনে পড়ে যায় মনমোহন মিত্রকে। আর অনিবার্যভাবেই মনে পড়ে, ১৯শে আগস্ট উৎপল দত্তের মৃত্যুদিন।

হ্যাঁ, সত্যজিৎ রায়ের পরিচালিত ‘আগন্তুক’ সিনেমায় মনমোহন মিত্রের চরিত্রে যে অভিনয় করেছিলেন উৎপল দত্ত, এ তো সহজ জিকে। ওরকম অনেক চরিত্রই অনেকে করেন, আর মুখের রং মোছার সঙ্গে সঙ্গেই চরিত্রকেও মুছে ফেলেন। উৎপল দত্ত-ও সেই জাতীয় মানুষ হলে তাঁকে নিয়ে নতুন করে আলোচনার দরকার পড়ত না। সে দরকার এজন্যই পড়ে, কারণ যে উৎপল দত্ত সিনেমার অর্থকরী মাধ্যমে মনমোহন মিত্রের চরিত্রে অভিনয় করেন, তিনি গ্রুপ থিয়েটারের মঞ্চেও কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের অধিকারের পক্ষে সওয়াল করেন। ‘মানুষের অধিকার’ নাটকের লিবভিৎজ-কেও নাহয় ছেড়ে দেওয়া গেল। কিন্তু ‘তিতুমীর’, ‘তীর’, ‘ব্যারিকেড’, ‘অঙ্গার’, ‘কল্লোল’, এমনকি অনেক পরে ‘টিনের তলোয়ার’ মঞ্চস্থ করার কোনও যুক্তিই জোটে না, যদি না মনমোহন মিত্র, কিংবা প্রিয়নাথ, কিংবা লিবভিৎজ-রা উৎপল দত্তের মাথায় বাসা বেঁধে না থাকেন। ‘দুঃস্বপ্নের নগরী’ মঞ্চস্থ করার দরুন আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি, বা পিএলটি-র নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটতই না, যদি উৎপল দত্ত নিছক সুবিধে-বুঝে-নেওয়া মানুষের দলেই থেকে যেতেন। 

অথচ, প্রথম থেকেই তাঁর মধ্যে এই বোধ গড়ে ওঠার সুযোগ ছিল না। জন্ম বরিশালে, ছোটবেলা কেটেছে শিলং শহরে। দশ বছর বয়সে কলকাতায় এসে সেন্ট লরেন্স, তারপর সেন্ট জেভিয়ার্স। স্কুলে পড়ার সময়ে আস্তে আস্তে নাটকের সঙ্গে সম্পর্ক নির্মাণ। জেভিয়ার্সের বিশাল লাইব্রেরিতে শেক্সপিয়ার থেকে স্তানিস্লাভস্কি, পাশাপাশি মার্ক্স-হেগেল-কান্ট গোগ্রাসে আত্মস্থ করতে করতে উৎপল দত্ত তৈরি করে নিচ্ছিলেন জীবন ও নাটক সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব বোধ। ১৯৪৭ সালে আত্মপ্রকাশ উৎপল ও তাঁর বন্ধুদের নিজস্ব নাট্যদল- ‘দ্য অ্যামেচার শেক্সপিয়ারিয়ানস’-এর। আর এই বছরেই ‘শেক্সপিয়ারিয়ানা’ নাট্যদল নিয়ে ভারত সফরে এলেন বিখ্যাত পরিচালক-অভিনেতা জেফ্রি কেন্ডাল। তাঁর ডাকে এই দলে যোগ দিলেন উৎপল।

স্পষ্টতই, এই সাহেবি নাট্যচর্চায় জীবনবোধ নিশ্চয়ই ছিল, কিন্তু সেখানে ‘অঙ্গার’-এর খনিশ্রমিকদের বা ‘টিনের তলোয়ার’-এর থিয়েটারওয়ালাদের মতো শ্রেণিচ্যুত মানুষের স্থান হতে পারত না। কিন্তু নিখাদ শেক্সপিয়ারিয়ান উৎপল দত্তের গতিপথ বদলে গেল পঞ্চাশের দশকে এসে। সদ্যস্বাধীন দেশের অন্তর্বর্তী প্রতিবন্ধকতাগুলোকে চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন তিনি— ‘poverty, hunger, illiteracy, superstition’। এই পরিস্থিতিতে কমিউনিজমের ধারণাকেই সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়েছিল তাঁর। কিন্তু অনতিকাল পরেই বেআইনি ঘোষণা করা হল কমিউনিস্ট পার্টিকে। সরকারি দমননীতির দুঃসহ প্রতিবেশে নিশ্চিন্ত নাট্যসাধনাকে ‘হাস্যকর, অকিঞ্চিৎকর এক ভণ্ডামি’ মনে হচ্ছিল উৎপলের। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক থিয়েটার আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্কটা জোরালো হয়ে উঠেছে ততদিনে। তাই ১৯৪৯ সালে উৎপল দত্ত প্রতিষ্ঠা করলেন ‘লিটল থিয়েটার গ্রুপ’। ১৯৪৯-এই ইতালির ফ্যাসিস্ত উর্দিতে ‘জুলিয়াস সিজার’ মঞ্চস্থ করলেন, বললেন— “শেক্সপিয়ারের একটি অক্ষর পরিবর্তন না করেও একটি অত্যাধুনিক রাজনৈতিক নাটক হয়ে উঠেছিল সিজার।” 

আসলে তখন থেকেই উৎপল দত্ত স্থির করে ফেলেছিলেন তিনি কোন পথে চলবেন। নাম থেকে অতি‘রঞ্জন’টুকু ছেঁটে ফেলার মতোই, তাঁর কাজকেও তিনি দাঁড় করাতে চাইলেন প্রয়োজনের ভিত্তির ওপর। তাই নিছক নান্দনিক আনন্দ দেয় যে শিল্প, তাকে নাকচ করে তাঁর গন্তব্য হয়ে উঠল রাজনৈতিক নাটক। ১৯৫১ সালে তিনি গণনাট্য সংঘে যোগ দেন, যা তাঁকে নিয়ে গেল ‘জনতার মুখরিত সখ্যে’। চার দেওয়ালে ঘেরা মঞ্চ ছেড়ে তিনি নেমে এলেন পথনাটকের আঙিনায়।

তিনি বিশ্বাস করতেন সাধারণ মানুষের জন্যই নাটক লেখা, নাটক করা। সুতরাং তাদের মোহ ভাঙতে হলে পৌঁছোতে হবে তাদের চেতনার স্তরে। তাই ভাষা ও সংস্কৃতির শিকড়ের প্রতি টান ছিল তাঁর নাট্যবোধের অন্যতম দিক। আসলে ঘোষিত ‘প্রোপাগান্ডিস্ট’ উৎপল দত্ত জানতেন, কথাগুলো পৌঁছে দেওয়াই সবচেয়ে জরুরি, তা সে যেভাবেই হোক। বারবার গ্রেফতারি, প্রশাসনিক অত্যাচার, ব্যক্তিগত আক্রমণ সত্ত্বেও মানুষকে প্রতিবাদ করতে হয়, হাতে ‘রাইফেল’, ‘তীর’ কিংবা ‘টিনের তলোয়ার’ যা-ই থাকুক না কেন!

সহপাঠী এন. বিশ্বনাথনের কথায়— “সমাজ পালটাচ্ছে, পৃথিবীর আবহাওয়া পালটাচ্ছে, পুরনো সব ধ্যানধারণা পালটে যাচ্ছে দেখেও আমরা নিজেদের পালটাতে চাই না। উনি সেখানে আঘাত করতেন।” সেই প্রয়োজনে আঘাত করার প্রণোদনা থেকেই ‘জপেনদা’-র জন্ম। যেন নাট্যভাষা দিয়ে সবকিছু বলে ওঠা যাচ্ছিল না। আরও স্পষ্ট, চাঁছাছোলা ভাষায় আক্রমণ শানালেন উৎপল। সে আক্রমণ থেকে বাদ পড়লেন না কমিউনিস্টরাও। জপেনদার বেপরোয়া জবানিতে উৎপল দত্ত লিখলেন, “লেনিন ক্লারা জেটকিনকে বলেছিলেন, অনেক কমিউনিস্টকে নারীজাতি সম্পর্কে প্রশ্ন করলেই বেরিয়ে পড়ে এক একটি দানব। তোরাও তাই। রোজ দু-চারটে করে নিদর্শন পাই নারী প্রশ্নে তোদের মালিকানার মনোভাবের। ভেতরে ভেতরে তোরা অনেকেই নারীকে মনে করিস সম্পত্তি। নইলে হঠাৎ হঠাৎ আজকের মেয়েদের বেশভূষা নিয়ে দুমদাম অমন মন্তব্য লিখে ফেলিস কেন?” অনুমান করাও দুষ্কর, আজকের মেয়েদের ওপর হাফপ্যান্ট পরা নিয়ে ফতোয়া নেমে আসতে দেখলে ঠিক কী বলতেন উৎপল দত্ত!

আরও পড়ুন: ঢাকায় নারীমুক্তির অগ্রদূত : বিস্মৃতপ্রায় স্বাধীনতা সংগ্রামী লীলা রায়/ মন্দিরা চৌধুরী


#উৎপল দত্ত #ব্যক্তিত্ব #কমিউনিস্ট #আগন্তুক #তোড়ি সেন

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

25

Unique Visitors

219139