ভ্রমণ

মেঘ-পাইনের কোলে : তিনচুলে

অর্ক দত্ত Dec 18, 2020 at 4:22 am ভ্রমণ

রবিবারের সকাল বেলা। আরাম করে ঘুমাচ্ছি, হঠাৎ মোবাইলে গান শুরু। অনেক কষ্টে চোখ খুলে দেখি আমার বন্ধু নিবেদিতা। বুঝলাম, আজকের মত ঘুম গেল। এখনই ঝড়ের বেগে একটার পর একটা বাছাই করা শব্দব্রহ্ম তেড়ে এল বলে।

"এই অলম্বুষ, এবার উঠে পড়, আর পড়ে পড়ে ঘুমোতে হবেনা! তোর সাথে দরকারি কথা আছে..."

"কী বলার আছে, চটপট বলে ফ্যাল।"

"শোন, নভেম্বরের শেষের দিকে, মা-বাবাকে নিয়ে 'তিনচুলে' যাবো ভাবছি, ওটাকে 'বেস' করে টুকটাক ঘুরবো, যাওয়া-আসা বাদে ওই তিন-চার দিন ধরে নে। তুইতো ওই দিকে অনেকবার গেছিস, একটা প্ল্যান বানিয়ে দে, এক্ষুনি।"

"আরে, ম্যাজিক নাকি, একটু ভেবে নিয়ে কালকে বলছি।"

"না, না, অত সময় তোকে দেওয়া যাবেনা, আর মোটে আড়াই মাস বাকি, ট্রেনের টিকিট বুক করতে হবে। এখন তাও আর.এ.সি. আছে, আশা করছি পরে কনফার্ম হয়ে যাবে। তোর ঘুমের জন্য ওটা অপেক্ষা করে থাকবে না। তবে ফেরাটা ফ্লাইটে করবো, নাহলে ওঁদের কষ্ট হবে। তোকে এক ঘণ্টা টাইম দিলাম, সব ঠিক করে ডিটেলস বলবি। কোথায় যাব, কোথায় থাকব, আশেপাশে কী দেখব, সব।"

"আর কিছু? তোর ভাষণ শেষ হয়ে গেছে? এবার ফোনটা রাখ।"

"সে রাখছি। তোর সময় কিন্তু শুরু হয়ে গেছে। ঠিক ৫৮ মিনিট ৪৫ সেকেন্ড পরে তোকে আবার ফোন করছি।"

কী আর করি। কাঁচা ঘুম ফেলে রেখে প্যাড, পেন আর মোবাইল নিয়ে বসতেই হল। তবে শুধু নিবেদিতা কেন, আপনারাও  শুনে নিন, বলা যায় না, কোনওদিন কাজে লেগে যেতেও পারে।


কুমায়ুন হিমালয়ের 'পঞ্চচুল্লি' শৃঙ্গের নাম অনেকেই শুনেছেন। পঞ্চপাণ্ডবদের স্বর্গারোহণ যাত্রার সময় বানানো পাঁচটি 'চুলা' বা 'চুল্লি' থেকেই এইরকম নাম। 'তিনচুলে' নামের উৎপত্তিও কিন্তু কিছুটা ওইভাবেই। দার্জিলিং জেলার অন্তর্গত, ৫৮০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এই পাহাড়ি 'হ্যামলেট' চুলা আকৃতির তিনটি পাহাড়-চূড়া দিয়ে ঘেরা। পেশক আর তাকদার মাঝখানে এর অবস্থান। নির্জনতা-বিলাসী প্রকৃতি-প্রেমিকদের একান্তই প্রিয় 'ডেস্টিনেশন'। ট্রেনে করে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন বা ফ্লাইটে করে বাগডোগরা পৌঁছে গাড়ি নিয়ে ঘন্টা তিনেকের রাস্তা। তবে শেয়ার গাড়িতে গেলে সময় একটু বেশি লাগতে পারে। শিলিগুড়ি শহর ছাড়িয়ে সেবক রোড ধরে এগিয়ে কালিঝোরা, লোহাপুল, তিস্তা বাজার পেরিয়ে পেশক চা বাগানের মধ্যে দিয়ে ধীরে ধীরে পৌঁছে যান 'ইকো-আরবান ভিলেজ' তিনচুলের রহস্য-সন্ধানে। আপনি চাইলে তাকদা হয়েও এখানে আসতে পারেন।

পাহাড়ি বাঁকের সম্মোহন, পাইন বনের আলো-আঁধারি, মুখচোরা মেঘবালিকাদের কৌতূহল-মাখা উঁকি-ঝুঁকি, ঝর্ণার ছন্দোবদ্ধ কাব্য, ঝরে পড়া শিশিরের টুপটাপ শব্দ, কুয়াশার চাদরে মোড়া জবুথুবু সকাল, হিমেল হাওয়ার শিরশিরানি, পাখিদের কলতান, নিঝুম শান্ত মনাস্ট্রির টুং-টাং ঘণ্টা ধ্বনি, ধ্যান-মগ্ন কাঞ্চনজঙ্ঘা, তারা-ভরা রাতের আকাশ, মানুষজনের স্নিগ্ধ আতিথেয়তা - এই সবকিছু নিয়েই তিনচুলে। আরও অনেকের মতোই তিনচুলে আমারও খুব প্রিয়। যত বারই যাই, প্রতিবারই নতুন রূপে নতুন আঙ্গিকে ধরা দেয়। আমার বয়স বাড়ে, আমাদের বাহ্যিক সৌন্দর্যের পরিবর্তন ঘটে, কিন্তু তিনচুলে সুনীল গাঙ্গুলীর 'নীরা'-র মতো - যার যৌবন কখনও ফুরোবার নয়, যার মাদকতার কোনো শেষ নেই, যার আকর্ষণে আপনাকে বারবার ফিরে আসতেই হবে। সুনীলকে ধার করে বলতে পারি, তিনচুলে "আমার একটি অতি ব্যক্তিগত কবিতার প্রতিটি শব্দের আত্মা।" 


এখানকার সবথেকে বিখ্যাত আর পুরোনো থাকার জায়গা হল 'গুরুং গেস্ট হাউস', যাদেরকে এই অঞ্চলে 'হোম স্টে' ধারণার পথপ্রদর্শকও বলা যায়। এছাড়াও এখানে আরও অনেকগুলি ভালো ও মাঝারি মানের হোটেল ও হোম স্টে রয়েছে। 

এবার আসি বেড়ানোর কথায়। তিনচুলে এবং তার আশেপাশে কী দেখবেন, কোথায় যাবেন? আগেই বলেছি এখানের প্রতিটি দৃশ্যই দেখার, ভাবার, অনুভব করার, আচ্ছন্ন হবার। আকাশ পারে মেঘের খেলা দেখুন, অর্কিডের জেল্লা দেখুন, ছায়াময় রাস্তায় রোদের আলপনা দেখুন, রাতপরীদের সাথে বৃষ্টির প্রেম দেখুন, এক কথায় যা মন চায় তাই-ই দেখুন। 

আর যেখানে যেতেই হবে...

সান-রাইজ পয়েন্ট ও মনাস্ট্রি : 

গুরুং গেস্ট হাউস পেরিয়ে তাকদার দিকে ২-৩ মিনিট হাঁটলেই দেখতে পাবেন একটা ঘাসে ঢাকা নুড়িপথ গাছ-গাছালির ফাঁক দিয়ে বাঁদিকে ঢুকে গিয়েছে। ওই রাস্তায় একটু গেলেই তিনচুলের একমাত্র মনাস্ট্রি। কাকভোরে বেরিয়ে ওর পাশ দিয়ে সোজা চলে গেলেই 'ওয়াচ টাওয়ার'। রাস্তার দুই দিক মন্ত্র-পতাকা দিয়ে সাজানো। সূর্যদেবের অলৌকিক কারিকুরির সাথে সাথে দেখে নিন হিমালয়ের বৈচিত্র্য, তিস্তা ভ্যালি, কালিম্পং এবং পূর্ব ও দক্ষিণ সিকিমের কিছু অংশ। সান-রাইজ দেখে ফেরার সময় অবশ্যই একবার মনাস্ট্রির ভিতরে ঢুকুন। জনশ্রুতি রয়েছে, পবিত্র এই গুম্ফায় একজন বৌদ্ধ সন্নাসী একটানা ১৭ বছর ধ্যানমগ্ন ছিলেন। কিছুটা সময় কাটিয়ে যান, অনাবিল প্রশান্তি সঙ্গে নিয়ে দিন শুরু করুন।


গুম্ফাদারা রক এবং গুম্বাদারা ভিউ পয়েন্ট :

পেশক চা বাগানের দিকে এর অবস্থান। এই পাহাড়ের সাথে ২০০ বছরের পুরোনো ইতিহাস জড়িয়ে আছে। শোনা যায় এর তলায় অনেকগুলি গুহার অবস্থান, যার বেশিরভাগ এখন অগম্য। স্থানীয় মানুষের বিশ্বাস এক কালে ওই গুহায় বৌদ্ধ লামাদের যাতায়াত ছিলো। অনেকে বলেন ব্রিটিশ সৈন্যরা নাকি এই পাহাড়ে প্রশিক্ষণ নিতে আসত। ট্রেক করে যদি ওপরের দিকে যান, পাইনের জঙ্গল, নয়নাভিরাম কাঞ্চনজঙ্ঘা, পেশক চা বাগান এবং চারিদিকের অনবদ্য দৃশ্যাবলী আপনাকে স্বাগত জানাবে। 


পাইন বন :

গুরুং গেস্ট হাউস থেকে গুম্বাদারা ভিউ পয়েন্ট যাবার পথে বাঁদিকে একটি রাস্তা পাইন বনের দিকে চলে গিয়েছে। দিনের যে কোনও সময় এখানে ঘুরে বেড়াতে পারেন। 'পাইন ট্রেল' কোনোভাবেই মিস্ করবেন না, নয়তো তিনচুলে ভ্রমণ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। 'বার্ড ওয়াচিং'-এর জন্য আদর্শ স্থান। ভাগ্য ভালো থাকলে একটা-দু'টো হরিণের সাথে দেখা হয়ে যেতে পারে, তবে আলো কমে গেলে এই অঞ্চলে একেবারেই থাকবেন না। কারণটা বুঝতেই পারছেন। 


তাকদা অর্কিড সেন্টার ও মনাস্ট্রি :

তিনচুলে থেকে মাত্র চার কিলোমিটার দূরে কুয়াশা-ঘেরা তাকদা। ব্রিটিশ আমলের ক্যান্টনমেন্ট হিসেবে বিখ্যাত তাকদাও ছুটি কাটাবার জন্য আদর্শ একটি জায়গা। অর্কিড সেন্টারটি বাজার ছাড়িয়ে এগিয়ে মূল রাস্তা থেকে একটু নিচের দিকে বিরাট অঞ্চল জুড়ে অবস্থিত, হিমালয়ের বহু দুষ্প্রাপ্য অর্কিড এখানে সংরক্ষণ করা হয়। এছাড়া বেশ কিছু ভেষজ উদ্ভিদেরও দেখা মিলবে। অর্কিড সেন্টারের পাশে দৃষ্টিনন্দন ফরেস্ট বাংলোটি ঘুরে দেখতে পারেন, এখানেও থাকার ব্যবস্থা আছে। পাহাড়ের একটু ওপরের দিকে উঠে দেখে নিন পবিত্র 'দেছেন পেমা শোইলিং মনাস্ট্রি'। মনাস্ট্রি-সংলগ্ন চত্বর থেকে বিভিন্ন চা বাগানের খুব সুন্দর ভিউ পাবেন।


ত্রিবেণী :

'পেশক ভিউ পয়েন্ট' (অনেকে লাভার্স ভিউ পয়েন্টও বলেন) থেকে দেখে নিন উত্তর সিকিমের 'চোলামু লেক' থেকে নেমে আসা তিস্তা আর ‘মাউন্ট কাবরু’ থেকে উৎপন্ন রঙ্গিত নদীর সঙ্গম। পাশাপাশি বয়ে চলা দু'টি ভিন্ন রঙের জলধারা আপনাকে বিস্মিত করবে। আপনি যদি প্রথম দিন শিলিগুড়ি থেকে তিস্তা বাজার হয়ে তিনচুলে আসেন, তাহলে সেই দিনই এটি দেখে নিতে পারেন।


রংলি রংরিয়ট চা বাগান :

তাকদা সন্নিহিত অঞ্চলে অনেকগুলি চা বাগান রয়েছে, এদের মধ্যে সেরা হলো ২ কিমি দূরের 'রংলি রংরিয়ট' চা বাগান। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে চোখ ধাঁধানো সবুজের সমারোহ সত্যিই অপূর্ব। এর কাছাকাছি অবস্থিত ডানকান কোম্পানির 'টি ফ্যাক্টরি', ঘুরে দেখতে ভালোই লাগবে। 


দুরপিন ভিউ পয়েন্ট :

তাকদা থেকে ১০ কিমি দূরের এই ভিউ পয়েন্ট থেকে তিস্তা এবং কাঞ্চনজঙ্ঘার মন মাতানো যুগলবন্দি পর্যবেক্ষণ করা যায়।


ঝুলন্ত সেতু, পূবং :

তাকদার চা বাগানগুলি ছাড়িয়ে একটু এগিয়ে দেখে আসুন ১০০ বছরের বেশি পুরোনো ঝুলন্ত সেতু। দোদুল্যমান সেতুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে উপভোগ করুন দুই দিকের পাহাড়ের অতুলনীয় রূপ। 


লামাহাটা ইকো পার্ক :

তিনচুলে থেকে লামাহাটার দূরত্ব মাত্রই ৭ কিলোমিটার। এই অঞ্চলে প্রায় নতুন গড়ে ওঠা একটি ট্যুরিস্ট স্পট। রাস্তা থেকে একটু ওপরের দিকে সুন্দর সাজানো পার্ক, যার পিছনে পাইন আর ধূপি (ক্রিপটোমেরিয়া) গাছের জঙ্গল। আকাশ পরিষ্কার থাকলে কাঞ্চনজঙ্ঘার দর্শনও পাবেন। পার্কের ঠিক পাশ দিয়ে জঙ্গল পথে ১ কিলোমিটার মত হেঁটে ছোট্ট সুন্দর সবুজাভ লেকটিও ঘুরে আসতে পারেন। লামাহাটাতেও অনেক হোম-স্টে আছে। এখানেও একটা দিন কাটাতে মন্দ লাগবেনা।


কমলালেবুর বাগান : 

ডিসেম্বর মাসে তিনচুলে বেড়াতে গেলে বড়া মাংগোয়া ও ছোটা মাংগোয়া গিয়ে কমলালেবুর বাগান দেখতে ভুলবেন না।  চাইলে ওখানেও একটা দিন থেকে যেতে পারেন।


প্রয়োজনীয় তথ্য :

১। বর্ষাকাল বাদ দিয়ে সারা বছরের যেকোনো সময়ই আপনি তিনচুলে যেতে পারেন। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি ঠান্ডা বেশি থাকে।

২। তিনচুলে ও সংলগ্ন অঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ভালোভাবে আত্মস্থ করতে হলে কমপক্ষে তিন থেকে চার দিন লাগবে।

৩। এখান থেকে আপনি ঘুম হয়ে লেপচাজগৎ বা দার্জিলিংও ঘুরে আসতে পারেন।

৪। তিনচুলেতে কোনো ওষুধ দোকান, লিকার শপ, এ.টি.এম. ইত্যাদি পাবেন না। তার জন্য আপনাকে তাকদা যেতে হবে। হোম-স্টে’গুলো যদিও যথেষ্ট পরিমাণে খাবার সার্ভ করে, তবে টুকটাক মুখ চালাবার জন্য আপনি কেক-বিস্কিট জাতীয় শুকনো খাবার সঙ্গে রাখতে পারেন।

৫। বেশিরভাগ হোম-স্টেতে ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ড দিয়ে পেমেন্ট করা যায় না, তাই যথেষ্ট পরিমাণে ক্যাশ টাকা সঙ্গে রাখুন।

পথ নির্দেশ : 

এন.জে.পি. স্টেশন বা বাগডোগরা-সেবক রোড-কালিঝোরা-লোহাপুল-তিস্তা বাজার-পেশক রোড-তিনচুলে। 


আনুমানিক দূরত্ব : 

১. এন.জে.পি. স্টেশন থেকে তিনচুলে: ৭৩ কিমি

২. বাগডোগরা থেকে তিনচুলে: ৭৭ কিমি

৩. তিনচুলে থেকে তাকদা : ০৪ কিমি

৪. তিনচুলে থেকে লামাহাটা: ০৭ কিমি

৫. তিনচুলে থেকে ছোটা মাংগোয়া: ০৮ কিমি

৬. তিনচুলে থেকে দার্জিলিং: ৩২ কিমি


গাড়ি ভাড়া :

১. এন.জে.পি. স্টেশন থেকে তিনচুলে: ২৫০০-৩০০০ 

২. বাগডোগরা থেকে তিনচুলে: ২৫০০-৩০০০ 

৩. পুরো দিন সাইটসিইং: ২৫০০ 

৪. দার্জিলিং ডে ট্যুর: ৩০০০


যোগাযোগ :

১. গুরুং গেস্ট হাউস: ৯৯৩৩০৩৬৩৩৬

২. রাই রিসোর্ট: ৯৭৩৩২৪২৮৭৬

৩. অভিরাজ হোম স্টে: ৯৭৪৯৩৭০৯৬৫

৪. তিনচুলে গেস্ট হাউস: ৯৪৩৪৩৮০৯৭৪

.....................................................................................................

[ছবি : লেখক ও ইন্টারনেট] 



#তিনচুলে #দার্জিলিং #উত্তরবঙ্গ #ভ্রমণ #ভ্রমণ-পরিকল্পনা #Tour #Tour Plan #Tinchuley #তাকদা #Takdah #কাঞ্চনজঙ্ঘা #kanchanjangha #অর্ক দত্ত #সিলি পয়েন্ট

  • Samiparna Chakraborty
    Dec 18, 2020 at 7:44 pm

    very informative write up..helpful to the people who really look forward for a beautiful place to visit

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

12

Unique Visitors

225508