গল্প

মাংস

শ্রুতিসৌরভ বন্দ‍্যোপাধ‍্যায় Sep 6, 2020 at 3:51 am গল্প

---একদম টাটকা আসল মাংস মশাই, জ‍্যান্ত লাফাচ্ছিল। এই উদো, বাবুকে দেখা না পাঁঠাটার কোতল-ভিডিওটা। আর হ‍্যাঁ, ওতে স্বাক্ষর করাও আছে, পাঁঠার নিজের খুরের, যে, সে সজ্ঞানে, স্ব-ইচ্ছেয় আপনাকে তার গায়ের মাংস খেতে দিচ্ছে!

---তাই! আপনি বললেই বিশ্বেস করে নেব যে এটা জলজ‍্যান্ত পাঁঠা ছিল কিছুক্ষণ আগে? বটে? তবে, প‍্যাকেটের গায়ে ডেট দেননি যে!

---আহা, এসব জিনিস কি খোলা বাজারে বেচা যায়? আপনিই বলুন না! আজ প্রায় সত্তর বছর হতে চলল, সে আমাদের জন্মের বহু আগে, দেশের তখনকার সরকার জীবহত‍্যা নিষিদ্ধ করিছিল। আজ‌ও সে আইন বহাল। ওই ল‍্যাবে তৈরি নকল মাংস ছাড়া বাজারে আর আছেটা কী বলুন তো মশাই!

---উঁহুঁ, নকল মাংস নয়, নকল মাংস নয়, বলুন কৃত্রিম মাংস। সে মাংসে অবশ‍্য আসল মাংসের মতো রক্তের স্বাদ পাওয়া যায় না। যতই তারা হিসেব করে ওতে রক্তের প্রোটিন আর পেশির ফাইবার ঢোকাক না কেন!


---আরে কী যে বলেন! সে মাংস আর এ মাংস! আকাশে আর পাতালে যা তফাত তা কি কখনো মেটে নাকি! এই দেখুন, মেটের কথা মনে পড়তেই আমার ঠাকুর্দার কথা মনে পড়ে গেল। তার কাছে শুনিছি, সে এক সময় ছিল মশাই! ব্ল‍্যাক বেঙ্গল গোটের সে নরম তুলতুলে মাংস ছাড়া রোববারের দুপুর জমত না! উফ্! এ লাইনে আসার পর সে সোয়াদ পেইছি! থ্রিলিং মশাই! ওই আলু দিয়ে লাল লাল ঝোল… সুড়ুৎ!


---থাক! নাল ফেলবেন না এখানে। সোফার কভারটা নতুন লাগিয়েছি। তা ছাড়া আমার কাজের রোবটটার এই দিন দুই হল মাজার স্ক্রুটা ঢিলে হয়ে গেছে। সে নীচু হয়ে মেঝে পরিষ্কার করতে পারবে না। আপনি বরং দামটা বলুন, কাজের কথায় আসুন!


---হেঁঃ, হেঁঃ, আপনার কাছ থেকে কি আর বেশি নিতে পারি মশাই, ওই এক করে দেবেন! কি রে উদো, এক করে যাচ্ছে তো?


---বলেন কী! কেজির দাম এক লাখ? মারবেন নাকি?


---আজ্ঞে, আপনাকে মশাই কম‌ই বলিছি! ভাইফোঁটার পরে দেখুন গে বাজারে, দেড়ের কমে নেই, হ‍্যাঁ! দামে না পোষায় তো ডাকেন কেন বলুন তো? সবাইকে দিয়ে থুয়ে আমাদের কাছে আর কী থাকে বলুন দিকি?


---বেশ বেশ! পাঁচশো দিন। বছরে একবার‌ই, মেয়েটার জন্মদিন বলে কথা! আটচল্লিশে হবে না?


---আপনি বেশ লোক মশাই! চোরাই মালে আবার দরদাম করতিছেন! নিন, নিন! উদো, মেপেছিস? দে, দিয়ে দে। হ‍্যাঁ, টাকাটা দিন, এই যে কানটা!


আরও পড়ুন


লকডাউন রিভিজিটেড


খগেনবাবু চাকলাদারের কানটা স্ক‍্যান করে নিলেন। মাংসের প‍্যাকেটে ডাঁশমাছি যখন বসে পড়েছে, তখন এ মাংস আসল না হয়ে যায় না! মনটা ফুরফুরে লাগছে। কতদিনের ইচ্ছে কচিপাঁঠার ঝোল খাওয়ার। কিন্তু বাজারে খালি ওই এক কৃত্রিম মাংস। খেয়ে খেয়ে জিভে চড়া পড়ে গেছে! এর মধ‍্যে মেয়ের বায়না, জন্মদিনের উপহার। সাতপাঁচ ভেবে সেদিন অফিসে বসের থেকে চাকলাদারের সুলুকসন্ধান চেয়েই বসলেন। লোকটা নাকি আসল জ‍্যান্ত পাঁঠার টাটকা মাংস দেয়, একেবারে প্রমাণসমেত। বস তো প্রথমে দিতেই চাইছিলেন না, লুকোছাপার ব‍্যাপার তো! যেসব জিনিস রাজারাজড়ারা লুকিয়ে চুরিয়ে কেনে, সেসব জিনিস খগেনবাবুর মতো কেরানি কিনবে, এ আবার কী অনাসৃষ্টি! শেষে মেয়ের জন্মদিনে নেমন্তন্ন করার লোভ দেখিয়ে চাকলাদারের নাম্বারটা জোগাড় করেছেন খগেনবাবু।


অ্যাকাউন্টে পয়সা ঢোকার শব্দটা পেয়েই চাকলাদার উঠে পড়ল। মাংসের এমন শাঁসালো খদ্দের চট করে পাওয়া যায় না। খগেনবাবুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে সে উদোকে সোজা দোকানে চলে যেতে বলল। সকাল আটটা থেকে মাংসের অর্ডার আসতে থাকে। খগেনবাবুকে মাংস গছাতে গিয়ে অলরেডি সাড়ে আটটা বেজে গেছে। এসব লুকোনো কেসে ভোরে বা রাতে সোজা খদ্দেরের বাড়ি গিয়ে মাংস দিয়ে আসতে হয় কিনা! এবার সে নিজে বাড়ি গিয়ে টিফিন সেরে দোকান আসবে। নিশ্চিন্ত।


নেবুতলার বাজারে চাকলাদারের ছোটোখাটো মাংসের দোকান। তবে চালু দোকান। ইউরোপের সেই যুগান্তকারী গবেষণা যেটা সারা দুনিয়া জুড়ে মাংস-ব‍্যবসায়ীদের ভোল পাল্টে দিয়েছিল, সেটা এখন ইস্কুলে নাইনে পড়ানো হয়। চাকলাদার মেয়ের ট‍্যাবলেটে দেখেছে। যার দৌলতে সে করেকম্মে খাচ্ছে, সেই সায়েবের একটা ছবি বাঁধিয়ে দোকানে রেখেছে। সকাল-সন্ধে ধূপধুনো দেয়। মেয়ে তাকে আরো জানিয়েছে, নেদারল্যান্ডস দেশের ম‍্যাস্ট্রিক্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ‍্যাপক ড. মার্ক পোস্ট একশো বছর আগে লন্ডনে একটা কৃত্রিম মাংসের বার্গার-পার্টি আয়োজন করে তাক লাগিয়ে দেন। দেশে দেশান্তরে আর ল‍্যাবে ল‍্যাবান্তরে, কৃত্রিম মাংসের জনপ্রিয়তা আর উৎপাদনের প্রতিযোগিতা সেই শুরু। তারপর নানা প‍্যাঁচপয়জার খাটিয়ে অনেক দেশ‌ই খাবার দরকারে জীবহত‍্যা নিষেধ করে দেয়। কড়া আইন চালু হয়। প্রতিবাদ প্রতিরোধ যে হয়নি, তা নয়। ইতিহাসে লেখা নেই বটে, কিন্তু চাকলাদার কল্পনা করেছে যে কৃত্রিম মাংস খেয়ে মানুষের প্রতিক্রিয়া কীরকম ছিল! অনেকেই নিশ্চয় বমিটমি করেছিল। তবে মাংসাশী তো, কদিন আর না খেয়ে থাকবে! সেই শুরু কৃত্রিম মাংসের বাজার। চাকলাদারের মতো অনেক লোক এই কৃত্রিম মাংস বেচেই বড়োলোক হয়ে গেছে। কীসের না কৃত্রিম মাংস আছে এইসব দোকানে! মেনু দেখে অনলাইনে অর্ডার দিলেই হল! কোনো প্রাণীহত‍্যা ছাড়াই শুধু প্রাণীকোশকে পেট্রিডিশে চাষ করে বানানো এইসব মাংসের মধ‍্যে পরিমাণমতো রক্তের প্রোটিন, পেশির প্রোটিন, হরমোন, এইসব ঢেলে সমৃদ্ধ করে তোলা হয়। চাকলাদার অবশ‍্য ব্র‍্যান্ডেড জিনিস ছাড়া বেচে না। লোকাল মাংস পাওয়া যায় বটে, দামে সস্তা, কিন্তু উপাদানের ভারসাম্য বজায় রাখাটাই চাপের।


এর সাথে মাথাচাড়া দিয়েছে আরো সব সাইড-বিজনেস। প্রাচীন পৃথিবীর লোকঠকানো যত কারবার। তার মধ‍্যে মেয়াদ-পেরোনো মাংসের প‍্যাকেটে চলতি মাংসের স্ট‍্যাম্প মেরে দেওয়া যেমন আছে, তেমনি আছে বাঘের মাংস বলে বাঘরোলের মাংস চালিয়ে দেওয়া। আবার চালানি মাছের পাশে জ‍্যান্ত লোকাল মাছের মতো জ‍্যান্ত খাসি, পাঁঠা, মুরগি, এদের মাংসের চাহিদা বেড়েছে। যদিও বেআইনি, কিন্তু সভ‍্যতা যতই এগোক, বাঙালির রোববারের মেনুতে কচি পাঁঠা বা খাসির মাংসের লাল ঝোল না হলে চলে না। তেমন তেমন বড়োলোক বাঙালি হলে চোরাপথে জ‍্যান্ত পাঁঠার টাটকা মাংস কিনতে গাদাখানেক পয়সা খরচ করতে পিছপা হয় না। এই খগেনবাবু যেমন। আজ ভালো দাঁও মারা গেছে। 


সেয়ানা চাকলাদার ম‍্যানেজমেন্ট আর বায়োকেমিস্ট্রি নিয়ে বিস্তর পড়াশোনা করে তবে কৃত্রিম মাংসের দোকান দিয়েছে। বাইরের বড়ো ল‍্যাবে কাজ করে হাত পাকিয়ে এসেছে। কেউ জানে না। ঝকঝকে কর্পোরেট ভাষা আর ছাপোষা বাঙালি ভাষা ঠিক জায়গামতো আর সময়মতো বলে খদ্দের বাগানো তার কাছে কোনো ব‍্যাপার নয়। আর পুলিশের ঝামেলা পোয়ানো সে মোটেই পছন্দ করে না। গত কয়েক বছরে চেষ্টাচরিত্র চালিয়ে সে যে জিনিসটা কৃত্রিম মাংসে জুড়তে পেরেছে, সেটা হল টাটকা মাংসের আঁশটে গন্ধ। এমন সফল সে এ কাজে যে ডাঁশমাছি পর্যন্ত ভুল করে সে মাংসের গায়ে বসছে। আজ সকালে যেটা দেখে খগেনবাবু নিশ্চিত হলেন।


বাড়িতে ফিরেই প্রথমে মাটির নীচে নিজের গোপন-ল‍্যাবে চলে যায় চাকলাদার। আজকের সাফল‍্যের অন‍্যতম দাবিদার পটলকে আদর না করলে হয়! পটল হচ্ছে চাকলাদারের পোষা পাঁঠা। ওর কান থেকে কোষ নিয়ে সে মাংস বানায়। একটুখানি ক্ষত চুলের মতো লেগে আছে। এক হপ্তায় জুড়ে যাবে। থ্রিডি টেকনিকের আশ্চর্য কেরামতিতে পটলার গলাকাটার ডিজিটাল ভিডিওগ্রাফিটা বানিয়ে দিয়েছে উদো। যোগ‍্য কেমিস্টের যোগ‍্য অ্যাসিস্টেন্ট আর কি! এই নিয়ে গোটা কুড়ি খদ্দের পেয়েছে চাকলাদার। মাঝে মাঝে ভিডিওটা এডিট করতে হয় বটে! পটলকে আদর করতে করতে চাকলাদার নিজের মনে বলে ওঠে, 'ব্ল‍্যাক বেঙ্গল গোট খাওয়ার অভিজ্ঞতা নেই, আবার আসল মাংস কিনতে যায়, তাই না রে পটল?' আদর খেতে খেতে পটল উত্তরে শুধু জানায়, 'ব‍্যাঃ!'


*******

[অলংকরণ : সোমদত্তা চক্রবর্তী] 


#story #sunday story #গল্প #শ্রুতিসৌরভ বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

48

Unique Visitors

219193