বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

মহাবিশ্বের প্রথম যৌগ এবং মহাজাগতিক রসায়ন

অনিন্দ্য পাল Feb 9, 2021 at 11:11 am বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

রসায়নের জন্ম কবে? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া খুব কঠিন। কিন্তু যদি প্রশ্ন করা হয়, এই মহাবিশ্বের প্রথম রাসায়নিক যৌগ কী, তার একটা যুক্তিগ্রাহ্য উত্তর দেওয়া যাবে। এখনও পর্যন্ত মানুষের গবেষণা যা বলছে তাতে দেখা যাচ্ছে মহাবিস্ফোরণ বা Big Bang-এর প্রায় পরপরই তৈরী হয়েছিল এক রাসায়নিক যৌগ। মহাবিস্ফোরণ হয়েছিল মোটামুটি ১৩৮০ কোটি সৌরবছর আগে, আর প্রথম যৌগিক পদার্থ জন্মেছিল তার ১০০,০০০ বছর পর। বিগ ব্যাং-এর পরে প্রথম যে মৌলগুলি তৈরী হয়েছিল তারা হাইড্রোজেন এবং হিলিয়াম। মোটামুটি ভাবে বলা যায়, মহাবিস্ফোরণের পর থেকে প্রথম ১০০,০০০ বছরের মধ্যেই তৈরী হয়েছিল এই দুটো মৌল। তবে কোনও কোনও বিজ্ঞানীর মতে এদের সঙ্গে সবচেয়ে হাল্কা গ্যাসীয় ধাতু লিথিয়ামের নিউক্লিয়াসও তৈরী হয়েছিল। এই সময় মহাবিশ্বের উষ্ণতা নেমে এসেছিল প্রায় ৪০০০ কেলভিনে। যাই হোক, এই সময়ের মধ্যে কোনও যৌগ যে তৈরী হয়নি সে বিষয়ে বিজ্ঞানীরা একমত। তৈরী হল, যখন উষ্ণতা কমার সঙ্গে সঙ্গে হাইড্রোজেন আয়নগুলো বা বলা ভালো হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াস, যা কিনা আবার প্রকৃত অর্থে একটা প্রোটন, সেটাই হিলিয়াম পরমাণুর সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেল আর বানিয়ে ফেলল মহাবিস্ফোরণের পর মহাবিশ্বের প্রথম যৌগ হিলিয়াম হাইড্রাইড। অর্থাৎ এই হিলিয়াম হাইড্রাইড এই মহাবিশ্বের প্রথম এবং আদিমতম যৌগ। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত নেওয়া বিজ্ঞানীদের পক্ষে খুব একটা সুখকর হয়নি। প্রথমত মহাবিশ্বে মহাকাশে হিলিয়াম হাইড্রাইড খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন এবং পাওয়াও যায়নি এতদিন। আর আদৌ এই যৌগটা তৈরী হয় কিনা বা এই রকম কোনও যৌগের অস্তিত্ব আদৌ আছে কিনা তা নিয়ে কোনও সঠিক মত বহুদিন ছিল না। তবে ১৯২৫ সালে জে. আর. হগনেস এবং ই. জি. লান খানিকটা পরোক্ষভাবেই দেখালেন যে এই যৌগটার অস্তিত্ব থাকা অসম্ভব নয়। তাদের পরীক্ষা থেকে দেখা গেল, এই হিলিয়াম হাইড্রাইড যৌগটা একটা বাস্তব রাসায়নিক পদার্থ। কিন্তু পৃথিবীর পরীক্ষাগারে এই যৌগের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া আর ব্রহ্মাণ্ডের বুকে হিলিয়াম হাইড্রাইড অণুর অস্তিত্ব প্রমাণ করা এক কথা নয়। মহাকাশে এই যৌগের অস্তিত্ব প্রমাণ করা এক কথায় একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ১৯৭০-এর কাছাকাছি সময় থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা উঠে পড়ে লাগলেন নক্ষত্রমণ্ডলে এই হিলিয়াম হাইড্রাইড খুঁজে পেতে। তাঁরা মূলত নজর রাখতে শুরু করলেন প্ল্যানেটরি নেবুলা বা গ্রহ-নীহারিকাগুলোর উপর। সূর্যের ১.৪ গুণ ভরের চেয়ে কম ভরের কোনও নক্ষত্রের জ্বালানি ফুরিয়ে এলে শ্বেতবামন অবস্থায় বহুবছর বেঁচে থাকতে পারে। কিন্তু এই অবস্থায় আসার ঠিক আগে ওই নক্ষত্রটা একটা লাল দানব হয়ে ওঠে। এই সময় তার চারপাশে থাকে গরম গ্যাসের একটা স্তর। এই স্তরটাকেই কোনও এক পর্যায়ে মহাশূন্যে ছুঁড়ে ফেলে দেয় এই লাল দানব আর তারপর হয়ে ওঠে প্রচন্ড উজ্জ্বল শ্বেত বামন। মহাকাশে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া ওই গ্যাসের স্তূপকেই বলা হয় গ্রহ-নীহারিকা। এদের পর্যবেক্ষণ করার পিছনে যে গুরুত্বপূর্ণ কারণ তা হল এই গ্রহ-নীহারিকাগুলো ইন্টারস্টেলার মিডিয়া বা আন্তর্নাক্ষত্রিক মাধ্যমে বেশ কিছু রাসায়নিক পদার্থ নিক্ষেপ করে। এই রাসায়নিক প্রাচুর্যের জন্যই বিজ্ঞানীরা গ্রহ-নীহারিকাগুলোকে লক্ষ্য করতে শুরু করলেন। অন্তঃস্থলে থাকা শ্বেতবামনটি প্রায় ১০০,০০০ ডিগ্রি উষ্ণতায় উত্তপ্ত অবস্থায় যে অতিবেগুনী রশ্মি নির্গত করে, সেটাই নীহারিকাগুলোকে আয়নিত এবং উদ্দীপিত করে ফোটন নিঃসরণ করে এবং নীহারিকা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এই সময়ই তৈরী হয় হিলিয়াম হাইড্রাইড ।

তবে ওই নীহারিকায় হিলিয়াম হাইড্রাইড যৌগটিকে খুঁজে পাওয়া খুবই কঠিন কাজ। কারণ এই  যৌগটি যে তরঙ্গের বিকিরণ ঘটায় সেটা মাত্র ০.১৪৯ মিমি তরঙ্গদৈর্ঘ্যের। মূল সমস্যাটি হল পৃথিবীর উপরে যে বায়ুমন্ডল রয়েছে সেই বায়ুমন্ডল ওই হিলিয়াম হাইড্রাইডের বিকিরণ শোষণ করে নেয়, বা বলা যায় পৃথিবী আর গ্রহ-নীহারিকাতে থাকা (যদি থাকে) হিলিয়াম হাইড্রাইড যৌগের মাঝে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল একটা অস্বচ্ছ পর্দা, আর পৃথিবীতে বসে টেলিস্কোপের সাহায্যে বা বর্ণালী পর্যবেক্ষণ করে মহাজাগতিক হিলিয়াম হাইড্রাইড যৌগ খুঁজে পাওয়া খুবই দুরূহ ব্যাপার। 

অনেক প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও, বিজ্ঞানীদের নিরলস প্রচেষ্টায় ২০১৯  সালের এপ্রিল মাসে সেই মহাজাগতিক প্রথম যৌগিক পদার্থের খোঁজ পাওয়া গেছে। তবে তার জন্য ভরসা করতে হয়েছে সোফিয়ার (SOFIA) উপর। SOFIA আসলে একটা মহাকাশ পর্যবেক্ষক, স্ট্র‍্যাটোস্ফিয়ারে উড়তে উড়তে মহাজাগতিক ঘটনার খোঁজখবর নেওয়া এর কাজ। এটা উড়ন্ত অবস্থায় গ্রহ-নেবুলা বা নীহারিকাগুলোকে পর্যবেক্ষণ করে যে তথ্য দিয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে পৃথিবী থেকে প্রায় ৩০০০ আলোকবর্ষ দূরের NGC7027 নামে একটা গ্রহ-নীহারিকাতে এই হিলিয়াম হাইড্রাইডের অস্তিত্ব রয়েছে।

এই গ্রহ-নীহারিকাটি খুবই তরুণ, মাত্র ৬০০ বছর আগে সূর্যের মতো কোনও একটা নক্ষত্র থেকে এর সৃষ্টি। আকার আকৃতিতেও বেশ ছোট, আবার পৃথিবী থেকে পর্যবেক্ষণ করার জন্যও বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। এই নীহারিকাটি সিগনাস নক্ষত্রপুঞ্জের একটা খুব ছোট গ্রহ-নীহারিকা। গ্রহ-নীহারিকা সাধারণত আকারে ১ আলোকবর্ষ মাপের হয়, কিন্তু এই নীহারিকাটি মাত্র ০.২-০.১ আলোকবর্ষ মাপের, এর আকৃতিটাও বেশ অন্যরকম। এই নীহারিকার মধ্যে কার্বন এবং ন্যানোডায়মন্ড বা অতিক্ষুদ্র হীরকখন্ডও রয়েছে। ১৮২৮ সালে এডোয়ার্ড স্টিফান মারসেলি মহাকাশ পর্যবেক্ষণকেন্দ্রে গবেষণার সময় এই গ্রহ-নীহারিকাটি আবিষ্কার করেন। এই নীহারিকাতেই চোখ রেখে জার্মানির ম্যাক্স প্লাঙ্ক ইনস্টিটিউটের রল্ফ গিস্টেন এবং তাঁর সহকর্মীরা খুঁজে পেয়েছেন হিলিয়াম হাইড্রাইডের অস্তিত্ব, এবং এই প্রাপ্তি মহাজাগতিক রসায়ন সম্পর্কে এতদিনের বৈজ্ঞানিক ভবিষ্যৎবাণী সত্যি প্রমাণ করল।




কভার ছবি : অন্তর্জাল
#বাংলা #নিবন্ধ #বিজ্ঞান #অনিন্দ্য পাল #মহাবিশ্ব #বিগ ব্যাং #আকাশগঙ্গা #হিলিয়াম হাইড্রাইড #প্লানেটরি নেবুলা #SOFIA #NGC7027 #এডোয়ার্ড স্টিফেন মারসেলি #ম্যাক্সপ্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট #রল্ফ গিস্টেন

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

18

Unique Visitors

215882