ভোজনবিলাস ও রবীন্দ্রনাথ
রসিয়ে কষিয়ে: চতুর্থ পর্ব ‘ছেলেবেলা’-য় লিখেছেন, নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবীর খাওয়ানোর শখ মিটত তাঁকে দিয়েই। স্কুল থেকে ফিরে এলে যেদিন চিংড়ির চচ্চড়ির সঙ্গে মেখে দিতেন পান্তা ভাত অল্প লংকার আভাস দিয়ে, সেদিন আর কথা ছিল না। সমবয়সি ভাগনি ইরাবতীর প্রসঙ্গে দিয়েছেন কাঁচা আম আর শুলপো শাক খাওয়ার লোভনীয় বর্ণনা। তরুণ বয়সে ‘খামখেয়ালি সভা’-র ভোজের কথা তো বলাই বাহুল্য। ‘নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান’-এর কথা লিখলেও নানারকম খাদ্যাভ্যাস যে মানুষকে বিপাকেও ফেলতে পারে, সে কথা লেখেননি রবি ঠাকুর। চিন ভ্রমণকালে তাঁর সম্মানে যে ভোজের আয়োজন হয়েছিল, তার মেনুতে নাকি ছিল হাজার বছরের পুরোনো ডিম। অত বছরের পুরোনো না হলেও বিশেষ পদ্ধতিতে একশো দিন সংরক্ষণ করা হত ডিমগুলোকে, যতক্ষণ না ডিমের সাদা অংশ কালচে বেগুনি হয়ে যায়। এতদিন রেখে দেওয়ায় ডিমের প্রোটিনের একটা অংশ অ্যামোনিয়ায় পরিণত হয়, ফলে অনেকের এমনও ধারণা ছিল যে এই ডিম তিন মাস মূত্রের জালায় ডুবিয়ে রাখা হয়। থাইল্যান্ডে তো এর নামই থাই ইউ মা, মানে ঘোড়ার মূত্রে ডোবানো ডিম। সেই চৈনিক ডিম খেয়ে নন্দলাল বসু আর ক্ষিতিমোহন সেন-এর অবস্থা বেগতিক! গুরুদেবের কিন্তু কোনও বিচলন নেই। পরে জানা গেল ডিমগুলো নাকি মুখের বদলে দাড়ির আড়াল দিয়ে আশ্রয় পেয়েছিল সরাসরি জোব্বার পকেটে! গন্ধবিচারের পালা পড়েছিল কলম্বোতেও। শুঁটকি মাছ সেখানে খাদ্যতালিকায় অপরিহার্য, এমনকি রান্নার মশলাতেও। হয়তো এই গন্ধ এড়াতেই গুরুদেবের জন্য বরাদ্দ হয়েছিল বিলিতি খাবার। অবশ্য খাওয়া নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করতে কখনোই পিছপা হতেন না তিনি। একঘেয়েমির প্রতি তাঁর বরাবরের বিরাগ। রানী চন্দ জানিয়েছেন, সাধারণত তাঁর জন্য দুপুরে হত দিশি ধরনের রান্না, আর রাতে থাকত বিলিতি খাবার। একবার এক পণ্ডিত অতিথি কথায় কথায় শাস্ত্র পুরাণের অনুষঙ্গ টেনে বললেন, আমাদের দেশে হবিষ্যান্নই একমাত্র উপযুক্ত আহার। অমনি লোক ছুটল হাটে, কুমোরের ঘর থেকে এল সদ্য-পোড়া লাল মাটির মালসা। এবেলা ওবেলা নতুন মালসায় রান্না হবিষ্যান্ন খেয়ে গুরুদেব খুব খুশি হয়ে বললেন, এই এতদিনে ঠিকটি হল। কিছুদিন পর এক বিদেশি বন্ধু জানালেন, ডিমে আছে সবরকমের খাদ্যগুণ। পরদিন থেকে চাল কাঁচকলা সরে গেল, গুরুদেব কাঁচা কাঁচা ডিম ভেঙে পেয়ালায় ঢালেন, নুন গোলমরিচ মিশিয়ে চুমুক দেন তাতে। আবার কবে এলেন আর-একজন, আয়ুর্বেদ চর্চা করেন তিনি, আর তাঁর সঙ্গেই এল নিমপাতার রস। রানী চন্দের কথায়, “সে কি একটু আধটু? বড়ো একটা কাঁচের গ্লাসভর্তি রস, সবুজ রঙের থকথকে রস দেখে আর নিমপাতার তেতো গন্ধে আমাদের গা গুলিয়ে উঠত। গুরুদেব তা হাতে নিয়ে চুমুক দিতেন, যেন পেস্তাবাটা শরবত খাচ্ছেন।”
সেবাগ্রাম থেকে একজন এসে জানালেন, গান্ধিজি রোজ রসুন খান, বৃদ্ধদের পক্ষে তা খুবই উপকারী। সুতরাং বাটা রসুনের ডেলা ডেলা বড়ি দুবেলাই খাওয়া শুরু করে দিলেন রবীন্দ্রনাথও। এক বিদেশি ডাক্তার জানালেন, আগুনের তাতে খাবারের সব গুণ নষ্ট হয়ে যায়। অতএব আবার বদলের পালা এল। গুরুদেব নিজেই তালিকা করে দিলেন কী কী সবজি চাই। সেই সব সবজি কুচিয়ে দেওয়া হল তাঁকে, এমনকি আলু পর্যন্ত। নুন লেবুর রস মিশিয়ে খানিকটা তিনি নিজে খেলেন, আর কিছুটা যথারীতি ভাগ করে দিলেন প্রিয়জনদের মধ্যে। খেতে ভালোবাসতেন, খাওয়াতেও। মিতাহারী হলেও, কম করে খাবার দিলে ভারী অসন্তুষ্ট হতেন। পাশে যাঁরা থাকতেন, তাঁদের ফেলে কি তিনি খেতে পারেন? কিন্তু এক গুজরাটি অতিথির কথা শুনে যখন ক্যাস্টর অয়েলের পরোটা খাওয়া ধরলেন গুরুদেব, তখন আর খাওয়ার সময়ে ধারেকাছে বিশেষ কাউকে পেতেন না তিনি। রবীন্দ্রনাথের খাওয়া ও খাওয়ানো দুয়েরই বর্ণনা দিয়েছেন বনফুল, তাঁর ‘রবীন্দ্রস্মৃতি’ বইয়ে। প্রথমবার শান্তিনিকেতনে দুজনের দেখা হওয়ার দিনেই বনফুলকে বিকেলে চা খাওয়ার নিমন্ত্রণ করছেন রবীন্দ্রনাথ, “তোমার লেখা পড়ে মনে হয় তুমি ঝাল খেতে ভালোবাস। বিকেলে বড়ো বড়ো কাবলে মটরের ঘুগনি করলে কেমন হয়? ঘুগনির মাঝখানে একটা লাল লঙ্কা গোঁজা থাকবে।” আর-একবার খুব ভোরে শান্তিনিকেতনে পৌঁছেছেন বনফুল। অন্ধকার কাটেনি তখনও, ঠান্ডাও খুব। অথচ অনতিবিলম্বে স্নান করে ব্রেকফাস্টের টেবিলে হাজির রবীন্দ্রনাথ। আটাত্তর বছর বয়সি রবীন্দ্রনাথের প্রাতরাশের একটি ছবির মতো বর্ণনা দিয়েছেন বনফুল— “নীলমণি খাবার নিয়ে প্রবেশ করল। দেখলাম প্রকাণ্ড একটি কাঁসার থালার মাঝখানে রুপোর বাটি দিয়ে কী যেন ঢাকা রয়েছে। আর তার চারপাশে তরকারির মতো কী যেন সাজানো রয়েছে সব। কোনওটাই পরিমাণে বেশি নয়, কিন্তু মনে হল সংখ্যায় অনেকগুলো। বারো-চোদ্দ রকম।” বাটিটা তুলতেই বেরিয়ে পড়ল অনেকখানি ক্রিম। অন্য জিনিসগুলো নানারকম ডাল আর ফল ভেজানো। বনফুল লিখেছেন, “লক্ষ করে দেখলাম মুগের ডাল, ছোলা, বাদাম, পেস্তা, কিসমিস, আখরোট তো আছেই, আরও নানারকম কী আছে, একটা তো উচ্ছের বিচির মতো দেখাচ্ছিল। ... নীলমণি দুটো কাঁচা ডিম ভেঙে একটা ডিশে করে দিয়ে গেল। রবীন্দ্রনাথ নিজে তাতে গোলমরিচের গুঁড়ো আর নুন দিয়ে নিলেন। নীলমণি দু’টুকরো মাখন-মাখানো রুটিও আনল।
রবীন্দ্রনাথ প্রথমেই ডিশে চুমুক দিয়ে ডিমটা খেয়ে নিলেন। তারপর টেবিলের ড্রয়ার থেকে দুটো শিশি বার করলেন। একটা দেখলাম মার্কের গ্লুকোজ আর একটা স্যানাটোজেন। দুটো থেকেই দু’চামচ বার করে মেশালেন ক্রিমের সঙ্গে। তারপর কিসমিস পেস্তা সহযোগে খেতে লাগলেন সেটা। পরক্ষণেই কফি এল। কাপে নয়, কেতলিতে। কফি ‘ব্রু’ করার যে বিশেষ ধরনের কেতলি থাকে— তাতে।” এরপর রুটি দুখানায় পড়ল মধু, বনফুল দেখলেন সেটা অস্ট্রেলিয়ার আমদানি। মুখ মিষ্টি হয়ে গেছে বলে এল মুড়ি আর কুসুমবীজ ভাজা। তারপর টাটকা খেজুর রস। রবীন্দ্রনাথের প্রাতরাশের উপকরণ যতই খুঁটিয়ে দেখুন না কেন, বনফুলের চোখের মতো মুখও ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল ততক্ষণে। এ কথা তিনি লিখতে ভোলেননি, তাঁর জন্য তখন টেবলে হাজির হয়েছিল ফুলকো লুচি, আলুর ছেঁচকি, গরম শিঙাড়া, কচুরি, সন্দেশ। তা ছাড়া কেক, বিস্কুট, আপেল, কলা। সঙ্গে চায়ের সরঞ্জাম। রবীন্দ্রনাথের চা খাওয়ার গল্পও শুনিয়েছেন রানী চন্দ, “চীনে চা’ই পছন্দ করতেন তিনি। সে চা’ও শুকনো বেল, যুঁই-এর। গরম জলে পড়লেই শুকনো পাপড়িগুলি খুলে ফুলের আকার নিত, আমরা দেখে চিনতাম এটা যুঁই, এটা বেলি। কখনো থাকত শুধুই চন্দ্রমল্লিকা খুদে খুদে আকারের। শুকনো ফুল, গুরুদেব বোধ হয় এই ফুলকেই বলতেন সেঁজুতি।” তাঁর বড়দা মুকুল দে আর্ট স্কুলের অধ্যক্ষ থাকাকালীন তাঁদের চৌরঙ্গির ফ্ল্যাটে কয়েকবার এসে ছিলেন গুরুদেব। তাঁদের বাঙাল রান্না পছন্দ করতেন গুরুদেব, শুধু ঝালের বেলায় ছিল তাঁর আপত্তি। তাঁর নিজস্ব বাবুর্চিও আসত সঙ্গে, অন্যান্য রান্নার পাশাপাশি থালায় রোজ থাকত সুতোর মতো মিহি একগোছা আলুভাজা। কোনও খাবারের প্রতি বাড়াবাড়ি আকর্ষণ না থাকলেও একরকম জিনিসের প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল, তা হল চই। শোনা যায়, মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুর পর কিছুদিন আমিষ আহার ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি। অবশেষে তাঁর শাশুড়ি তাঁকে নিমন্ত্রণ করেন একদিন, সেদিনের বিশেষ পদ ছিল চই দিয়ে কই মাছের ঝোল। প্রতিমা দেবী আড়ালে হেসে বলতেন, বাবামশায়ের শ্বশুরের দেশের জিনিস কিনা, তাই তাঁর এত ভালো লাগে। ফলের মধ্যে পছন্দ ছিল আম, ছুরি চালিয়ে আঁটির দুদিক থেকে কেটে নিতেন দুটো বাটির মতো, চামচ দিয়ে শাঁস তুলে নিতেন তা থেকে। বোঝা যায়, খাওয়ার মতো একটি আপাত সাধারণ বিষয়েও শ্রীকে মর্যাদা দিতেন জীবনরসিক রবীন্দ্রনাথ।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার: ১.গুরুদেব- রানী চন্দ ২.সব হতে আপন- রানী চন্দ ৩.দিনের পরে দিন যে গেল- সুকুমার সেন এবং কৌশিক মজুমদার পোস্টার: অর্পণ দাস
#ছেলেবেলা #কাদম্বরী দেবী #চিংড়ির চচ্চড়ি # ইরাবতী #খামখেয়ালি সভা #সেবাগ্রাম #ক্যাস্টর অয়েল # ‘রবীন্দ্রস্মৃতি’ #বনফুল #চিন ভ্রমণ # থাইল্যান্ড # থাই ইউ মা #কলম্বো #শুঁটকি মাছ #হবিষ্যান্ন #রানী চন্দ #অস্ট্রেলিয়া # মিতাহার #মৃণালিনী দেবী #আমিষ #লুচি #আলুর ছেঁচকি #গরম শিঙাড়া #কচুরি #সন্দেশ #কেক #বিস্কুট #আপেল #মুকুল দে #আম #প্রতিমা দেবী #কই মাছের ঝোল #রসিয়ে কষিয়ে #চতুর্থ পর্ব