বিস্মৃত অক্ষর: কথাসাহিত্যিক সরোজকুমার রায়চৌধুরী
"সরোজ এসব মানুষ কোথায় পেল, আমি এদের দেখিনি"- রবীন্দ্রনাথের মতো বিচক্ষণ পর্যবেক্ষক যখন অমল হোমকে লেখা চিঠিতে এই মন্তব্য করেন, তখন সেকথার ভার অস্বীকার করা সম্ভব নয়। অথচ বনফুলের সতীর্থ, নেতাজীর স্নেহধন্য কথাসাহিত্যিক সরোজকুমার রায়চৌধুরীকে বাঙালি পাঠক মনে রাখেননি। উপন্যাস ও ছোটোগল্পের ভাণ্ডার যে তার খুব অল্প এমনটাও নয়। লিখেছেন তেত্রিশটি উপন্যাস, এগারটি ছোটোগল্পসংকলন, তিনটি কিশোর সাহিত্য সংগ্রহ। সাতটি বারোয়ারি বা যৌথ উপন্যাসে সহযোগী হয়েছেন বনফুল, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ, শরৎচন্দ্র, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, মণীন্দ্রলাল বসু, প্রবোধকুমার সান্যালের মতো মহারথী।
মুর্শিদাবাদের মালিহাটি গ্রামে বৈদ্যবংশীয় সেনশর্মা পরিবারে রীতিমতো বৈষ্ণবীয় আবহাওয়ায় সরোজকুমারের জন্ম। মূল পদবী সেনশর্মা, ব্রিটিশ উপাধিতে রায়চৌধুরী। বাবা মনোরঞ্জন রায়চৌধুরীর চাকরি সূত্রে মুর্শিদাবাদের সালার অঞ্চলে তাঁর বড় হওয়া। ম্যাট্রিক পাশ করে ভর্তি হন হাজারিবাগের সেন্ট কলম্বাস কলেজে। এখানেই বনফুলের সঙ্গে সখ্যের সূত্র ধরে একসঙ্গে নাটক এবং সাহিত্যচর্চা শুরু। এরপর কলকাতায় এসে 'কলকাতা বিদ্যাপীঠ' নামক স্বদেশী মহাবিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এইখানে ইংরেজির অধ্যাপক ছিলেন নেতাজী। নেতাজীর আদেশেই একে একে 'আত্মশক্তি', 'বাংলার কথা' পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্বে চলে আসেন। পরবর্তীকালে সারাজীবন ধরে বৈকালী, নায়ক, নবশক্তি, ফরোয়ার্ড, অভ্যুদয়, বঙ্গশ্রী, আনন্দবাজার, বসুমতী, দৈনিক কৃষক, বর্তমান প্রভৃতি নানা পত্রিকায় সম্পাদনা এবং সাংবাদিকতা করেছেন। সম্পাদনার দাবিতে সাহিত্যভাণ্ডারও হয়েছে সমৃদ্ধ।
১৯২৭ সালে 'আত্মশক্তি' পত্রিকায় 'রমানাথের ডায়েরী' প্রকাশের মাধ্যমে সরোজকুমারের প্রথম সাহিত্য জগতে আত্মপ্রকাশ। এরপরের বছরই 'উত্তরা' পত্রিকাতে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে শুরু করে প্রথম উপন্যাস 'বন্ধনী'। এই রমানাথের ডায়েরির মাধ্যমেই সরোজকুমার কল্লোলগোষ্ঠীর নজরে চলে আসেন। 'কল্লোল' পত্রিকায় প্রকাশিত প্রথম গল্প 'দুনিয়াদারী'। বাড়িতে ব্যক্তিগত যাপনে বৈষ্ণব ধর্মের পরিবেশ থাকায় সরোজকুমারের একাধিক গল্পে উপন্যাসে এসেছে বৈষ্ণবীয় অনুষঙ্গ। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত এবং বহুপঠিত ট্রিলজি 'ময়ূরাক্ষী- গৃহকপোতী- সোমলতা', যা একত্রে 'নতুন ফসল' নামে পরিচিত, পুরোপুরি বৈষ্ণবজীবনের ভাবধারাকে অবলম্বন করে রচিত। 'ময়ূরাক্ষী'তে বিনোদিনী ও হারান নামে এক দম্পতির সাংসারিক জীবন নিয়ে কাহিনির সূত্রপাত হলেও ধীরে ধীরে গল্প বৈষ্ণব জগতের দিকে গড়ায়। 'গৃহকপোতী' অংশে বিনোদিনী ঘর ছেড়ে আখড়ায় থাকলেও সেখানে তৈরি করে এক গার্হস্থ্য পরিবেশ। 'সোমলতা' অংশে বিনোদিনীর স্বামী কাছে ফিরে যাবার আগে পূর্বপ্রণয়ী গৌরহরির সঙ্গে গোপন মিলন হয়। এই ট্রিলজি বৈষ্ণবযাপনের পাশাপাশি আধুনিক বিশ্বের মুক্ত যৌন সম্পর্ককে নিপুণভাবে দেখিয়েছেন। উপন্যাসগুলো হয়ে উঠেছে কালোত্তীর্ণ। 'তিমির বলয়' উপন্যাসটিও বৈষ্ণব জীবনের প্রেক্ষাপটে রচিত। 'বন্ধনী', 'শৃঙ্খলা, 'কৃশানু','মকরকেতন', 'হংসমিথুন' উপন্যাসে একের পর এক উঠে এসেছে সমসাময়িক রাজনৈতিক প্রসঙ্গ। অসহযোগ থেকে সশস্ত্র বিপ্লব। স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকার ছাপ এই উপন্যাসগুলিতে স্পষ্ট। 'কৃশানু' শ্রী নামে এক আদর্শভ্রষ্ট দলনেতার গল্প, যে স্বাধীনতার পর ক্ষমতার লোভে যক্ষ্মারোগী স্বামীকে হাসপাতালে রেখে ইউরোপে পাড়ি দেন। বোঝা যায়, একেবারে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে এইসব ঘটনা ও চরিত্রকে তুলে এনে গল্প বলার পাশাপাশি দ্বিচারিতার মুখোশ খুলে দিতে চেয়েছেন লেখক। প্রসঙ্গত উল্লেখের দাবি রাখে সরোজকুমারের অসমাপ্ত আত্মজীবনী 'ভেসে যাই ভাসে স্মৃতি' তৎকালীন সমাজ ও রাজনীতির একটি নির্ভরযোগ্য দলিল। 'অনুষ্টুপ ছন্দ' একটি ব্যতিক্রমী বিষয় নিয়ে রচিত পরীক্ষামূলক উপন্যাস। বিপত্নীক মধ্যবয়স্ক প্রণব পুত্র কন্যার আপত্তি সত্ত্বেও পূর্বপ্রণয়িনীকে বিবাহ করেন। এই ঘটনা সমসময়ে তো বটেই, একবিংশর যুগেও খুব প্রচলিত নয়। সামাজিক রীতিনীতির বদলে ব্যক্তিমনকেই বারবার গুরুত্ব দিয়েছেন ঔপন্যাসিক।
এগারটি গল্পগ্রন্থে প্রায় একশোর কাছাকাছি ছোটোগল্প লিখেছেন সরোজকুমার। ১৯৫৬ সালে সুনীলচন্দ্র নন্দী ও নিখিলচন্দ্র নন্দী যত্ন করে তাঁর শ্রেষ্ঠগল্প প্রকাশ করেন। 'দেহযমুনা', 'মনপবন', 'ওপিঠ', 'নীড়ের মায়া' প্রভৃতি গল্পে বিষয়ের বৈচিত্র্য দেখলে বিস্মিত হতে হয়। 'ওপিঠ' গল্পে অত্যন্ত সাধারণ গৃহবধূ শোভনা পুরুষতন্ত্রের ওপর সপাটে কষাঘাত করেছেন। আবার 'নীড়ের মায়া' গল্পে বিপত্নীক বনমালীর দুঃসম্পর্কের বোন সুরবালা সংসার পুত্রকন্যার মায়া ত্যাগ করতে না পেরে বনমালীর শয্যায় আত্মসমর্পণ করেছেন। 'আকাল' এবং 'আগুন' গল্পদুটিতে মন্বন্তরের বর্ণনা 'নবান্ন' নাটককে মনে করায়। পুনর্মুদ্রণের অভাবে বাঙালি পাঠক সরোজকুমারের বিপুল সাহিত্যকীর্তি থেকে বঞ্চিত হয়ে আছেন। বিষয়বৈচিত্র্য, মনস্তাত্ত্বিক জটিলতার সঙ্গে সহজ সরল ভাষার মিশেল বর্তমান প্রজন্মের মনোযোগের দাবি রাখে।