বিরিয়ানির নবাবি
ফারসি ‘বিরিয়ান’ শব্দের অর্থ হল 'ভেজে রান্না করা'৷ চাল ও মাংসের সমন্বয়ে ভেজে রান্না করা জনপ্রিয় খাদ্যই হল বিরিয়ানি। বিরিয়ানির নাম এবং তার স্বাদ, রং, আকারে লেগে আছে নবাবিয়ানার ছোঁয়া। মূলত ইসলামিক ঘরানার এই রান্না ভারতের খাদ্যসংস্কৃতির ঐতিহ্যের অন্যতম অঙ্গ হয়ে উঠেছে। হিন্দু, মুসলিম কিংবা খ্রিস্টান, পারসিক, যে-কোনো বিবাহ অনুষ্ঠানের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বিরিয়ানি।
বিরিয়ানি রান্নার উৎস বা কীভাবে বিরিয়ানি ভারতীয়ের খাদ্যতালিকায় ঢুকে পড়ল, তা নিয়ে বিস্তর মতভেদ আছে। মূলত বিরিয়ানিকে মধ্য প্রাচ্যের ফসল বলেই সবাই স্বীকার করে নেন। শোনা যায় আরবের এক যাযাবর জাতি মাটির নীচে গর্ত করে চাল, মাংস, মশলা মিশিয়ে রান্না করত। সেখান থেকেই বিরিয়ানির আইডিয়া আসে। তৈমুর লঙের সঙ্গে কাজাখস্তান থেকে আফগানিস্তান হয়ে এই রান্না ভারতে আসে। অনেকে আবার মনে করেন শাহজাহান-বেগম মুমতাজ সৈন্য ব্যারাক পরিদর্শনে গিয়ে সৈন্যদের অপুষ্টি মেটাতে এই ধরনের খাবার আবিষ্কার করেন। আবার ভিন্ন মত বলে, ভারতীয় হিন্দুদের সনাতন খাবার খিচুড়ি থেকেই নাকি বিরিয়ানির আইডিয়া আসে। চাল, ডাল, সবজি একসঙ্গে সেদ্ধ করে খিচুড়ি রান্না প্রচলন ভারতে অনেকদিনের। রান্নার এবং খাওয়ার সময় বাঁচাতে এই পদ্ধতিতেই নাকি মাংস ও চালের মিশ্রণে বিরিয়ানি রান্নার কথা ভাবা হয়। আবার দ্বিতীয় খ্রিস্টাব্দের তামিল সাহিত্যে 'উনসুরু' বলে একটি পদের উল্লেখ পাওয়া যায়, যা চাল, ঘি, মাংস, হলুদ, ধনে, গোলমরিচ, তেজপাতা দিয়ে তৈরি। এই উনসুরুকে যদি বিরিয়ানির পূর্বপুরুষ ধরি, তাহলে হাজার বছর পরে তৈমুরলঙের বিরিয়ানি আনার পক্ষে যুক্তি খণ্ডন হয়ে যায়।
তবে বিরিয়ানির উৎস যেখানেই হোক না কেন, নবাবজাদা এবং সৈন্যদলের হাত ধরেই ভারতের বিভিন্ন জায়গায় বিরিয়ানি ছড়িয়ে পড়ে। এবং রান্নার পদ্ধতি বেশিরভাগ অঞ্চলেই একরকম। মূলত মশলা মাখানো গোস্ত বা মাংসকে রান্না করে, চাল অর্ধসেদ্ধ করে উভয়কে স্তরে স্তরে সাজিয়ে হাঁড়ির মুখ আটকে ঢিমে আঁচে রান্না করা হয়। এই পদ্ধতির নাম দমপখত পদ্ধতি। আঞ্চলিকতার ভেদে ভাষা বা পোশাক যেমন বদলে যায়, বদলে যায় খাদ্যাভ্যাস। তেমনি একটি রান্নার মধ্যেও প্রভাব পড়ে সেই অঞ্চলের খাদ্যাভ্যাসের। তাই আমরা দেখি অঞ্চলভেদে বিরিয়ানির মূল কাঠামোর পরিবর্তন না হলেও মশলা কিংবা রন্ধনপদ্ধতির এদিক ওদিকে বিরিয়ানির নিত্যনতুন ভার্সান তৈরি হয়েছে। কয়েকটি অঞ্চলভেদে বদলে যাওয়া বিরিয়ানির কিছু বৈশিষ্ট্য নিয়ে আজকে সংক্ষিপ্ত পরিসরে আলোচনা করা যেতে পারে।
প্রথমেই আসা যাক দিল্লি ও লখনউয়ের বিরিয়ানির কথায়। দিল্লিতে মোগল আমল থেকেই বিরিয়ানির প্রচলন রয়েছে। গোস্ত এবং চালকে 'খারে মশালা' অর্থাৎ গোটা গরম মশলা দিয়ে রান্না করা হয়। এই বিরিয়ানির স্বাদ এবং গন্ধ খুব উগ্র। ভাতের সঙ্গে গোটা গরম মশলা মুখে পড়ে। লখনউয়ে এসে এই 'খারে মশালা'-র অবলুপ্তি ঘটল। শোনা যায় নবাব আসফ-উদ-দৌলা বক্সারের যুদ্ধের পর বড়া ইমামবাড়া বানানোর জন্য শ্রমিক নিয়োগ করেন। সেই শ্রমিকদের খাওয়ার জন্য একসঙ্গে চাল ও গোস্ত দিয়ে সারাদিন ধরে রান্না হত। এই রান্নার সুবাস নবাবের ঘরে পৌঁছে গিয়ে রাজদরবারে আওয়াধি বিরিয়ানির উদ্ভব হয়। নবাব নাকি গোটা মশলা মুখে পড়া পছন্দ করতেন না। সেখান থেকে মশলা গুঁড়ো করে মাংসে মাখিয়ে রান্না শুরু হয়। এখানের বৈশিষ্ট্য হল খানসামা অর্থাৎ পুরুষ কারিগরকেই রাঁধতে হবে বিরিয়ানি। এখানকার বিরিয়ানিকে অনেকেই পোলাও বিরিয়ানি বলেন। গোস্তকে আলাদা করে পেঁয়াজ, রসুন, আদা, লংকা মাখিয়ে ঘিয়ে রান্না করে আধসেদ্ধ ভাতের সঙ্গে দমপখত পদ্ধতিতে আওয়াধি বিরিয়ানি তৈরি হয়।
মোগল দরবার থেকে আসাফজাহি বংশের হাত ধরে হায়দ্রাবাদে বিরিয়ানি গিয়ে পৌঁছলেও দক্ষিণ ভারতীয় ছোঁয়ায় বিবর্তিত হয়ে বিরিয়ানি সম্পূর্ণ এক অন্য রূপ নিল। হায়দ্রাবাদের বিরিয়ানি এতটাই বিখ্যাত যে হায়দ্রাবাদকে বিরিয়ানির ক্যাপিটালও বলা যায়। হায়দ্রাবাদে বিরিয়ানিতে মোগল মশলার সঙ্গে দক্ষিণ ভারতীয় মশলার অনবদ্য মিশেল ঘটেছে। এখানে এসে বিরিয়ানিতে একটু টক স্বাদ যোগ হল, যাকে আঞ্চলিক ভাষায় খাট্টা মশালা বলা হয়। তা ছাড়াও এলাচ, শাহ জিরা, শাহ মরিচ, দারচিনি, লাল লংকা, কাঁচা লংকা এবং দই আছেই। ব্যবহার করা হয় ধনেপাতা ও পুদিনাপাতা। এখানে রন্ধনপদ্ধতিও একটু আলাদা। সমস্ত মশলা দিয়ে ম্যারিনেট করা কাঁচা মাংসকেই আধসেদ্ধ চালের সঙ্গে স্তরে সাজিয়ে দমে রাখা হয়। মাংস বা গোস্ত কাঁচা হওয়ার দরুন এই রান্নাকে কাচ্চি বিরিয়ানি বলে। বাংলাদেশের ঢাকাতেও বহুল জনপ্রিয় কাচ্চি বিরিয়ানির মূল উৎস এই হায়দ্রাবাদ। হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানি মূলত দুপ্রকার হয়- সুফিয়ানি বিরিয়ানি এবং জাফরানি বিরিয়ানি। নাম থেকেই তাদের বৈশিষ্ট্য কিছুটা আন্দাজ করা যায়। সুফিয়ানি বিরিয়ানি হয় একেবারে সাদা। কোনো রং তো নয়ই, এমনকি জাফরান, কেশর, লাল লংকাও ব্যবহার করা হয় না সুফিয়ানি বিরিয়ানিতে। উপরন্তু বর্ণের শুভ্রতা বাড়ানোর জন্য দুধের সঙ্গে বাদাম মিহি করে মিশিয়ে ব্যবহার করা হয়। অন্যদিকে জাফরানি বিরিয়ানি হয় রঙিন। জাফরান, কেশর এবং লাল লংকার ব্যবহারে এই বিরিয়ানি হালকা হলদে রং পায়। উল্লেখ্য সুফিয়ানি বিরিয়ানির ঘরানায় কিছুটা ইউরোপীয় ছোঁয়া থাকলেও জাফরানি একেবারেই মধ্য প্রাচ্যের মহিমায় মহিমান্বিত।
মানচিত্রের আরেকটু নীচে চলে যাব একেবারে মালাবার উপকূলে, কেরালায়। সমুদ্রের ধারের এই অঞ্চলে বিরিয়ানি একেবারেই ভিন্ন মেজাজের। স্বাদ গন্ধ এমনকি আকৃতি অনেকটাই আঞ্চলিকতার সঙ্গে মিলে পরিবর্তিত। কেরালার বিরিয়ানিতেও রকমফের দেখা যায় বেশ কিছু। কালিকট বিরিয়ানি, কালিশেরি বিরিয়ানি, মারেপাও বিরিয়ানি বা কুন্নুর বিরিয়ানি মশলা, রন্ধনপ্রণালী আর পরিবেশনের তারতম্যে পৃথক হয়ে যায়। কালিকট বিরিয়ানিতে মশলা দিয়ে ম্যারিনেট করা মাংস এবং চাল কাঁচা অবস্থাতেই একসঙ্গে রান্না করা হয় প্রায় কাচ্চি বিরিয়ানির ধরনেই। কালিশেরি বিরিয়ানিতে আলাদা করে ভাত এবং মাংস রান্না করে আলাদা করেই পরিবেশন করা হয়। এই অঞ্চলে মাংস প্রস্তুতিতে টমেটো ব্যবহার হয় না। আর গোলমরিচ নৈব নৈব চ। দই, পাতিলেবুর রস, আদা, রসুন, লংকাবাটা দিয়ে মাংস ম্যারিনেট করা হয়ে থাকে। সবচেয়ে স্বাতন্ত্র্য এই অঞ্চলের বিরিয়ানির চালে। অন্যান্য সব জায়গায় বড় দানার সুগন্ধী বাসমতী চাল ব্যবহার হয়, কিন্তু বাসমতীর সুগন্ধী দাদাগিরিই নাকি বিরিয়ানির আসল ফ্লেভার নষ্ট করে। তাই এখানে 'কাইমা' নামে এক ছোটো আকৃতির আতপ চাল ব্যবহার হয়। জিরে ফোড়নের সঙ্গে আকৃতির সাদৃশ্য থাকায় একে জিরাকাশালা বা জিরাকাসাম্বাও বলা হয়। কাইমা চালের ব্যবহার মালাবার উপকূলের বিরিয়ানিকে সব অঞ্চলের থেকে পৃথক করে তুলেছে। সমুদ্র উপকূল হওয়ায় এই অঞ্চলে সি-ফিশ দিয়ে বিরিয়ানির চল রয়েছে। হয় চিকেন বিরিয়ানিও, তবে ব্রয়লার চিকেন ব্যবহার হয় না।
সবশেষে দেখে নেব বাঙালির বিরিয়ানি– কলকাতা এবং ঢাকা। উভয়েরই বিরিয়ানির ঐতিহ্য বাইরে থেকে এসেছে, কিন্তু নিজ গুণে পরিবর্তন পরিমার্জনের মাধ্যমে তারা বিরিয়ানিকে নিজের করে নিয়েছে। ১৮৫৬ সালের ১৩ই মে নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ কলকাতায় আসেন এবং তাঁর হাত ধরেই ঘুড়ি ওড়ানো, পায়রা ওড়ানো প্রভৃতি সংস্কৃতির পাশাপাশি এসেছে বিরিয়ানি। এই কাহিনি নতুন নয়। কিন্তু নতুন হল নবাবের এক কলকাতার খানসামা বিরিয়ানিতে পরীক্ষামূলকভাবে আলু ব্যবহার করেন যা নবাবের অত্যন্ত পছন্দ হয়। নবাবের পছন্দের আলু দ্রুত কলকাতার বিরিয়ানিতে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তা ছাড়াও কলকাতাতেই একমাত্র দেখা যায় ঘিয়ের বদলে সরষের তেল দিয়ে মাংস রান্না করতে। কোথাও কোথাও সরষে বাটা দিয়েও ম্যারিনেট করা হয়। আর বিরিয়ানির স্পেশাল মশলায় গোলাপফুলের পাপড়ি ড্রাইরোস্ট করে দেওয়ার রীতিও কলকাতারই একচেটিয়া। পেঁয়াজের মুচমুচে ভাজা অর্থাৎ বেরেস্তা প্রায় সব অঞ্চলেই ব্যবহার হয়। তাই বলা যায় কলকাতার স্বাতন্ত্র্য আলুর সহযোগে আর সরষের তেলের ব্যবহারে। ঢাকার বিপুল জনপ্রিয় কাচ্চি বিরিয়ানি কার্যত হায়দ্রাবাদি কাচ্চি বিরিয়ানির ধরনেই বানানো হয়। এখানে চাল এবং মশলা মাখানো মাংস উভয়কেই কাঁচা অবস্থায় দমে পাক দেওয়া হয়৷ ব্যবহার করা হয় ড্রাইফ্রুটসও। ঢাকা কলকাতা দু জায়গাতেই বাসমতী চাল ব্যবহার হয়। কলকাতায় গোস্ত ছাড়াও চিকেন বিরিয়ানি, ইলিশ বিরিয়ানি, ডিম বিরিয়ানি, এমনকি শুধু আলু বিরিয়ানিরও প্রচলন আছে।
শেষে বিভিন্ন অঞ্চলের সিগনেচার কতকগুলি বিরিয়ানির দোকানের সন্ধান দিয়ে এ যাত্রা ইতি টানব। দিল্লির ঐতিহ্যপূর্ণ খারে মশালার বিরিয়ানি খেতে হলে অবশ্যই যেতে হবে করিমসে। স্বাদে গন্ধে অতুলনীয়। কিন্তু কবজি ডোবানো বাঙালির মতে মন ভরলেও পেট ভরবে না। লখনউয়ের পোলাও বিরিয়ানির জন্য রয়েছে রহিমস। এখানে মাংস রান্নার সময় দুধে সেদ্ধ করা হয়। হায়দ্রাবাদের প্যারাডাইসের কথা কে না জানে। আর কলকাতায় সিরাজ, রয়্যাল ছাড়া খানদানি আওয়াধি বিরিয়ানির স্বাদ পেতে রয়েছে আওয়াধ ১৫৯০ আর গোরুর মাংসের স্পেশাল বিরিয়ানির জন্য জমজমে যেতেই হয়। আর ঢাকায় বাসমতী কাচ্চি, সুলতানস ডাইন, কাচ্চি ভাই এবং অবশ্যই ফকরুদ্দিন।
গ্রন্থ ঋণ: খানা তল্লাশি, পিনাকী ভট্টাচার্য, আনন্দ, জানুয়ারি ২০১৮
[কভার পোস্টার: অর্পণ দাস]
#বাংলা #নিবন্ধ #বিরিয়ানি #প্রতিষ্ঠা আচার্য #মোগলাই খানা #কলকাতা #ওয়াজেদ আলি শাহ #লখনউ #আওয়াধ #জমজম #আর্সলান #রহিমস #কাজাখস্তান #আফগানিস্তান #ভারত #কেরালা #উনসুরু #দমপখত #কাচ্চি #খারে মশালা #আসফ-উদ-দৌলা #হায়দ্রাবাদ #সুফিয়ানি বিরিয়ানি #জাফরানি বিরিয়ানি #কালিকট বিরিয়ানি #কালিশেরি বিরিয়ানি #মারেপাও বিরিয়ানি #কুন্নুর বিরিয়ানি #ইলিশ বিরিয়ানি #করিমস #সিরাজ #রয়্যাল #আওয়াধ ১৫৯০ #বাসমতী কাচ্চি #সুলতানস ডাইন #কাচ্চি ভাই #ফকরুদ্দিন