বারবারা ম্যাক্লিনটক ও সমকালীন পুরুষতান্ত্রিক বিজ্ঞানচর্চা
_shown_in_her_laboratory_in_1947_1366x1366.jpg)
চার ভাইবোনের মধ্যে আলাদা করে তাঁকে চেনা যেত কথাবার্তা এবং ব্যবহার দেখে। ছোটো থেকেই অদ্ভূতরকমের নির্জনতাপ্রিয় এবং ভাবুক। প্রকৃতির নিয়মনীতি নিয়েই মূলত ছিল আগ্রহ। বারবারা ম্যাক্লিনটক জন্মেছিলেন ১৯০২ সালের ১৬ই জুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কানেকটিকাটে। সংস্কৃতিমনস্ক পরিবারে মা পিয়ানো বাজিয়ে গান করতেন, যদিও মন থেকে ছিলেন ভয়ানক রক্ষণশীল।
স্কুল শেষ করে কলেজে পড়তে যাওয়ার প্রথম বাধা এসেছিল মায়ের কাছ থেকে, কারণ মা ভাবতেন এত শিক্ষা এবং মুক্ত চলাফেরা মেয়েদের বিয়ের পক্ষে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। অবশেষে পেশায় হোমিওপ্যাথির ডাক্তার বাবার ইচ্ছায় তা সম্ভব হল। কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চান শুনে সেখানকার ছাত্রদের মধ্যে বিরাট হাসিঠাট্টা শুরু হল এবং 'জেনেটিক্স বিভাগে (তৎকালীন বয়েজ ক্লাব)’ মেয়েরা ভর্তি হতে পারবে না বলে তাঁকে ভর্তি হতে হল উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগে। এ যেন খানিকটা আমাদের কাদম্বিনী গাঙ্গুলীর জীবনের ঘটনা। কলেজে শুরু হল শেখার পালা। ১৯১৯ সালে কলেজে ভর্তি হওয়ার পর ১৯২১ সালে তিনি জেনেটিক্সের প্রথম ক্লাস করেন অধ্যাপক হাচিনসনের। রত্ন চিনতে পেরেছিলেন কিনা জানি না, তবে তাঁর উৎসাহ দেখে হাচিনসন টেলিফোনে তাঁর সঙ্গে কথা বলেন এবং গ্র্যাজুয়েট কোর্সে জেনেটিক্সের ক্লাস করতে ডেকে নেন পরের বছর। ‘সেই যে উনি পড়তে ডাকলেন, তারপর থেকে জেনেটিক্স আর কোনোদিন আমাকে ছাড়েনি’- বারবারা বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে পরে বলেছেন। ১৯২৩ সালে কলেজ শেষ হল বটে কিন্তু ১৯২৭ সালে কর্নেল থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি পেলেন সেই উদ্ভিদবিদ্যার।
এখানে একটু বলে নিই, সাইটোজেনেটিক্স হল জেনেটিক্সের একটি বিভাগ যেখানে ক্রোমোজোমের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে একটি কোষের বৈশিষ্ট্য কীভাবে পরিবর্তিত হয় তা পড়ানো হয়। কর্নেলে অধ্যাপক শার্পের ক্লাসে তিনি সাইটোজেনেটিক্সের ধারণা লাভ করেন। যাই হোক, ডক্টরেট পেয়ে বারবারা সাইটোজেনেটিক্স নিয়ে ভাবতে এবং ভাবাতে শুরু করলেন। কারমাইন নামক গাঢ় লাল রঞ্জক (স্টেইন) ব্যবহার করে উনি ভুট্টাকোষের ক্রোমোজোমের পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করতেন যৌগিক অনুবীক্ষণ যন্ত্রে। ২১ বছর বয়সে দেখান ভুট্টার হ্যাপ্লয়েড বা জননকোষে ১০টি (n=১০) আলাদা ক্রোমোজোম থাকে। এরমধ্যেই ১৯২৮ সালে নিউমোনিয়া সংক্রান্ত বিখ্যাত পরীক্ষায় ফ্রেডরিক গ্রিফিথ দেখান ব্যাকটেরিয়া নিজেদের মধ্যে জিন ট্রান্সফার (ব্যাকটেরিয়াল ট্রান্সফর্মেশন) করতে পারে। মনে রাখতে হবে সেই অন্ধকারে মলিক্যুলার বায়োলজি হাতড়ানোর যুগে এসব আবিষ্কার যেন সূর্যের আলো। ১৯২৯ সালে বারবারা এবং তাঁর ছাত্র হ্যারিয়েট ক্রেটন লক্ষ করেন জননকোষ বিভাজনের (মিয়োসিস) সময় তাদের ক্রোমোজোমের আদানপ্রদান হয় এবং ১৯৩১ সালে তিনি প্রমাণ করেন জিন হল ক্রোমোজোমেরই অংশ। ভুট্টার জেনেটিক ম্যাপও তিনি তৈরি করেছিলেন নিখুঁতভাবে। ১৯৩২ সালের দিকে তিনি স্টেডলারের কাছে শিখে নিলেন কীভাবে নিয়ন্ত্রিতভাবে এক্স-রশ্মি ব্যবহার করে জিনে মিউটেশন ঘটানো যায়। এই কাজ করতে গিয়ে দেখলেন এক্স-রশ্মি দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত ক্রোমোজোমের দুই প্রান্ত জোড়া লেগে বৃত্তাকার হয়ে যাচ্ছে; (যেটা আরেক বর্ষীয়ান বিজ্ঞানী লিলিয়ান মর্গ্যান দেখে ফেলেছিলেন ১৯২৬ সালে)। কারণ খুঁজতে গিয়ে তিনি যে ব্যাপারটার স্পষ্ট উপস্থিতি আন্দাজ করেছিলেন, পরবর্তীকালে ২০০৯ সালে সেই ‘টেলোমিয়ার এবং টেলোমারেজ’ সংক্রান্ত কাজে মেডিসিনে নোবেল আসে। আণবিক এবং পারমাণবিক সূক্ষ্মতায় জীবনবিজ্ঞানে কাজ করা তখন স্বপ্নাতীত।
বলে রাখি, ক্রোমোজোম হল হিস্টোন প্রোটিনের তৈরি লাটাইয়ে পাকানো DNA-র সুতো৷ তখন এসব ব্যাপার কম লোকই জানতেন। ১৯৫৩ সালে DNA-র গঠন নির্ণয় করে ওয়াটসন, ক্রিক এবং উইলকিন্সের ১৯৬২ সালে নোবেল পাওয়া তখনও ভবিষ্যৎ। নিউক্লিয়াস সংক্রান্ত বারবারা-র নিখুঁত গবেষণা আজও বিজ্ঞানীদের রাতের ঘুম কেড়ে নেয়। মজার বিষয় হল এত কভার ড্রাইভ, স্কোয়ার কাট, পুল, স্ট্রেট ড্রাইভের মাঝে হাতে গোনা কিছু বিজ্ঞানী জানতে আরম্ভ করেছেন DNA কী দিয়ে তৈরি, কিন্তু কেমন দেখতে সে ধারণা তো ভাবনাতীত। ১৯৪৪ সালে আভেরি, ম্যাকলিওড এবং ম্যাকার্থি দেখান গ্রিফিথের ১৯২৮ সালের সেই বিখ্যাত ট্রান্সফর্মেশনের জন্য দায়ী DNA, প্রোটিন নয়। গবেষণার সবকিছু ঠিকঠাক চলতে চলতেই সঙ্গত কিছু কারণে তিনি কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে ১৯৪১ নাগাদ বন্ধু মার্কাস রোডসের ডাকে কোল্ডস্প্রিং হারবার ল্যাবে যোগ দেন। এখানে কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৪৪ সালে ন্যাশনাল একাডেমি অফ সায়েন্সেস-এর ফেলো নির্বাচিত হন।
ভুট্টার কোষের ‘জেনেটিক কন্ট্রোল অফ ডেভেলপমেন্ট’ নিয়ে কাজ করতে করতে ১৯৪৮ সালের দিকে তিনি এক অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করেন। তিনি দেখলেন একই জিনোটাইপ (জিনের ধরণ) থাকা সত্ত্বেও ভুট্টাদানার ফিনোটাইপ (দৈহিক বৈশিষ্ট্য- উচ্চতা, পাতার গঠন, ফুলের রঙ, ফলের আকার ইত্যাদি) আলাদা হচ্ছে, যেটা তিনি বুঝেছিলেন দানার (এন্ডোস্পার্ম) রঙ দেখে। অনেক কাটাছেঁড়া করে দেখলেন এক ভয়ঙ্কর ব্যাপার। যে জিন ভুট্টাদানার রঙ নির্ধারণ করে তার মাঝখানে বসে আছে আরেকটা জিন। তাহলে কি এই জিন লাফায় ফড়িঙের মতো? এই জিনের আসল কাজ কী? এই লাফানোর জন্য দায়ী কে? জিনের যে অংশ এভাবে লাফায় সে কি আগের জিনকে কেটে তারপর সেখানে নিজের জায়গা করে নেয়? রাতের ঘুম চলে গেল। দিনের পর দিন ধরে হাজার হাজার দানা পরীক্ষা করে যে সিদ্ধান্তে তিনি উপনীত হলেন তা হল- এমন কিছু জিন আছে যার কাজ হল এলোমেলো লাফিয়ে অন্যান্য জিনের মাঝখানে গিয়ে বসে পড়া (আমাদের মোট জিনের প্রায় ৫০ শতাংশ এরাই) এবং স্থানীয় জিনের প্রকাশে বাধা দেওয়া, যেটা আমরা প্রাথমিকভাবে দানার রঙের পরিবর্তন দিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারি, কারণ তা খালিচোখে দেখা যায়।
জাম্পিং জিন! ১৯৫০ সাল থেকে প্রকাশ হওয়া তার সমস্ত কাজ বিজ্ঞানীমহলে হইচই ফেলে দেয় কারণ তৎকালীন লোকজন ক্রোমোজোম, জিন এসব নিয়ে ভাসা ভাসা কিছু তথ্য জানত; সেখানে জিনের লাফ দেওয়া তো রূপকথার গল্প। তাঁর সমস্ত রিসার্চ পেপারে ব্যবহৃত ক্রসিংওভারের সাংকেতিক ছবি, সংজ্ঞা, ব্যাখ্যা তখনকার সময়ে বোঝার পক্ষে দুরূহ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর লেকচারের সময় শুরু হল ব্যঙ্গ বিদ্রুপ, হাসাহাসি এবং মাঝপথে তাঁকে থামিয়ে এলোপাথাড়ি প্রশ্নবাণ। বিজ্ঞানী এবং চেনা মানুষজনের এহেন বর্বরোচিত ব্যবহারে তিনি মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়লেন। নিজের প্রতি অবহেলা এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে তিনি বাড়ি যাওয়া ছাড়া অন্য কোনো কাজে ল্যাব থেকে বেরোতেন না। টেলিফোনে যোগাযোগ রাখাও বন্ধ করে দেন। ‘বিজ্ঞান নিয়ে রূপকথার গল্প বানানো বন্ধ করুন’ ধরণের কথাবার্তা শোনার পর ১৯৫৩ সালের পর থেকে নিজের কাজ প্রকাশ করা বন্ধ করে দেন যদিও ততদিনে DNA-র গঠন বাজারে আসব আসব করছে। দিনের পর দিন জনসমক্ষে হাসাহাসির পাত্র হয়ে তিনি একরকম অবসাদের স্বীকার হন। ১৯৭৩ সালের তাঁর এক লেখা থেকে সেসব বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতার কথা কিছু জানা যায়।
ষাটের দশকে জাঁক মনো এবং ফ্রাঁসোয়া জেকব দেখালেন ল্যাকটোজের উপস্থিতির সঙ্গে ব্যাকটেরিয়ার প্রোটিন তৈরি (ল্যাকটোজ ওপেরন) কীভাবে জড়িত। জেকব ও মনোর এই পরীক্ষা বিজ্ঞানীদের চোখ খুলে দেয়। ১৯৬০ থেকে ১৯৭০ সালের মধ্যে মলিক্যুলার বায়োলজিতে জোয়ার আসায় জেল ইলেকট্রোফোরেসিসের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হল, রেস্ট্রিকশন এন্ডোনিউক্লিয়েজ, লাইগেজ প্রভৃতি উৎসেচককে কাজে লাগিয়ে ব্যাকটেরিওফাজ, ব্যাক্টেরিয়া, ঈস্ট ইত্যাদি সিস্টেমে জিন কাটাছেঁড়া করে জোড়া দেওয়া সহজ হল এবং একের পর এক পরীক্ষা বারবারার পঞ্চাশের দশকের সিদ্ধান্তকে বিভিন্ন দিক থেকে প্রমাণ করল। ভদ্রমহিলার কাজের প্রতি বাড়তে লাগল বিজ্ঞানীদের আগ্রহ। ট্রান্সপোজন ক্লোন করে তার লাফঝাঁপ সম্পর্কে অবগত হলেন অনেকে। মান্যতা আসতে লাগল পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। ইভলিন ফক্স কেলার নামে এক ভদ্রমহিলা বারবারার সাক্ষাৎকার নেন ১৯৭৮ এবং ১৯৭৯ সালে যেটা ১৯৮৩ সালে 'A Feeling for the Organism' নামে প্রকাশিত হয় এক বিখ্যাত পত্রিকায় এবং সেই বছরেই বারবারা মেডিসিনের নোবেলটি ছিনিয়ে নেন। শেয়ার নয়, সম্পূর্ণ একা এবং প্রথম মহিলা, সর্বোপরি প্রথম আমেরিকান মহিলা যিনি মেডিসিনে একটা গোটা নোবেল পেলেন।
যাই হোক, নোবেল পাওয়ার পর বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে একে একে বেরিয়ে আসতে থাকে তাঁর এতদিনের মন্দ-মধুর অভিজ্ঞতা। একজন মহিলা হয়ে সময়ের থেকে অনেকটা এগিয়ে ভাবাতে পারার কারণে বছরের পর বছর তাঁকে যে দুর্ব্যবহার সহ্য করতে হয়েছে তা এককথায় অমানবিক। প্রায়শ্চিত্তস্বরূপ স্যুইডিশ একাডেমি অফ সায়েন্সেস থেকে তাঁকে গ্রেগর জোহান মেন্ডেলের সাথে একাসনে বসানো হয় ,খান বারো সাম্মানিক ডক্টরেট এবং রয়্যাল সোসাইটির মেম্বারশিপও দেওয়া হয়। ন্যাশনাল উইমেন'স হল অফ ফেম অ্যাওয়ার্ডও পান। সর্বোপরি বিজ্ঞানের জগতে মহিলাদের প্রবেশের পথটি তিনি স্বমহিমায় উন্মুক্ত করে দেন। তাঁর এই জয় তাই সামগ্রিকভাবে পুরুষ এবং মহিলাদের সমানাধিকার সুনিশ্চিত করে অনেকাংশে। অর্জিত অর্থমূল্যে 'ম্যাক্লিনটক প্রাইজ' নামে একটি খেতাবের ব্যবস্থাও তিনি করেন পরবর্তীকালে।
বিয়ে-সংসার হবে না বলে মা তাঁকে উচ্চশিক্ষায় যেতে দিচ্ছিলেন না অথচ সেই গবেষক হিসেবেই তাঁর শান্ত চোখ আর হাসিমুখ চিনল গোটা বিজ্ঞানীমহল। তাঁর সাধনার ধারা স্বতন্ত্র। ১৯৯২ সালে, ৯০ বছর বয়সে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বারবারা ম্যাক্লিনটক, রোজালিন্ড ফ্র্যাঙ্কলিন বা আমাদের দেশের জি.এন. রামাচন্দ্রন বিজ্ঞানীমহলে কখনই ওয়াটসন-ক্রিক-উইলকিনস, আলেকজান্ডার ফ্লেমিং বা চার্লস ডারউইনের মত সেলিব্রেটেড নন, কিন্তু আজকের জীবনবিজ্ঞানের গবেষণাকে তাঁদের মত অনেক বিজ্ঞানী নিঃশব্দে পুষ্ট করে চলেছেন প্রত্যেক মুহূর্তে।
#বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি #বারবারা ম্যাক্লিনটক #শুভেচ্ছা বৈদ্য
Pankoj patra
Good,read same article in Desh patrika , long time ago.
Sayan
Ei lekha kotojon porbe janina.. kintu jara porbe, somriddho hobe. Esob lekha gobeshona ke bhalobaste shekhay, nijer upor bishwas na-harate shekhay.