বন্দী-জীবনে মুক্তির উড়াল : বিপ্লবী শচীন্দ্রনাথ সান্যাল ও তাঁর কারাজীবনের আখ্যান
একমাত্র ভারতীয় বিপ্লবী যার দুবার দ্বীপান্তরের সাজা হয়। এছাড়াও আরও কয়েকবার জেলে থাকতে হয়েছে। সব মিলিয়ে জীবনের সাতাশটা বছর তাঁর জেলেই কেটে গেছে। বিপ্লবী শচীন্দ্রনাথ সান্যাল। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে এক অবিস্মরণীয় নাম হলেও তাঁকে সেভাবে মনে রাখেনি বাঙালি। হিন্দুস্থান রিপাব্লিকান আর্মির সহ-প্রতিষ্ঠাতা তিনি। নিজের জেলজীবন ও বিপ্লবী কার্যকলাপের অভিজ্ঞতা তিনি সবিস্তারে লিখে গেছেন, যা প্রকাশ পেয়েছে 'বন্দী-জীবন' নামে। ভারতীয় কারা-সাহিত্যে শচীন্দ্রনাথের এই বইটি অত্যন্ত মূল্যবান এক সংযোজন।
১৮৯৩ সালে উত্তর প্রদেশের বেনারস জেলায় এক বাঙালি ব্রাহ্মণ পরিবারে শচীন্দ্রনাথের জন্ম। পিতা হরিনাথ সান্যাল জাতীয়তাবাদী ভাবধারায় দীক্ষিত ছিলেন। শচীন্দ্রনাথরা ছিলেন চার ভাই। পিতার প্রভাবে চার ভাইয়ের মধ্যে তিন ভাই-ই জাতীয়তাবাদী কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। শচীন্দ্রনাথের পাশাপাশি তাঁর দুই অনুজ জিতেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথকেও গ্রেপ্তারির মুখে পড়তে হয়েছিল। ১৯০৭ সালে শচীন্দ্রনাথ কলকাতায় থাকাকালীন গুপ্ত বিপ্লবী সংস্থা অনুশীলন সমিতির কলকাতা শাখায় যোগ দেন। ১৯০৯ সালে বেনারসে ফিরে সেখানে অনুশীলন সমিতির শাখা খোলেন। আলিপুর ষড়যন্ত্র মামলায় অনুশীলন সমিতি নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ায় এই শাখার নাম পাল্টে রাখেন 'ইয়াং ম্যান্স এসোসিয়েশন'। বহু বিপ্লবীর সঙ্গে তিনি সরাসরি কাজ করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য রাসবিহারী বোস, ভগৎ সিং, রামপ্রসাদ বিসমিল, জ্যোতিষচন্দ্র পাল, কর্তার সিং সরাভা, আশফাকউল্লাহ, বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, হেমচন্দ্র ঘোষ, উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমচন্দ্র কানুনগো প্রমুখ। এঁদের মধ্যে তাঁর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠতা ছিল রাসবিহারীর সঙ্গে।
জেলের থাকাকালীন নয়, জেলের বাইরে বসে বিভিন্ন সময়ে শচীন্দ্রনাথ বইটি লেখেন। নিজে বাঙালি হলেও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বিপ্লবী বন্ধুদের কথা মনে রেখে তিনি মূল বইটি হিন্দিতে লিখেছিলেন। বইটি প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই ব্রিটিশ সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। এই হিন্দি বলয়ে সশস্ত্র আন্দোলন কীভাবে দানা বাঁধছিল, তার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় শচীন্দ্রনাথের লেখায়। কীভাবে অস্ত্র নিয়ে আসা হত এবং লুকিয়ে রাখা হত তার কিছু হদিশ রয়েছে। রয়েছে তখনকার দিনে বিপ্লবীদের ব্যবহৃত 'গনকটন' বোমার উল্লেখ, যার পলতে বানানো হত কার্পাস তুলো দিয়ে। শচীন্দ্রনাথ জানিয়েছেন এরকম একেকটি বোমা বানাতে তখনকার দিনেই খরচ হত ১৬ টাকা।
১৯১৫ সালে লাহোর ও বেনারস ষড়যন্ত্র মামলায় শচীন্দ্রনাথ যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে দ্বীপান্তরে যান। আন্দামানের জেলখানার অভিজ্ঞতাও তিনি লিখেছেন। চার বছর পর ছাড়া পান। বইটির প্রাথমিক খসড়া তিনি লেখেন এই সময়পর্বেই। প্রথম সংস্করণ কলকাতা থেকে ১৯২২ সালের আগস্ট মাসে প্রকাশিত হয়। কিন্তু পরবর্তী সংস্করণগুলিতে শচীন্দ্রনাথ আরও অনেক নতুন কথা যুক্ত করেন। কয়েক বছর বাদে ১৯২৫ সাল নাগাদ জড়িয়ে পড়েন কাকোরী লুণ্ঠনের কেসে। লখনউয়ের কাছে কাকোরী স্টেশনে একটি মালগাড়ি লুঠ করা হয়। পরিকল্পনা ছিল শচীন্দ্রনাথেরই। বিপ্লবী দলের খরচ চালানোর জন্যই এই লুণ্ঠন, যুক্তি দিয়েছিলেন তিনি। এই মামলায় তার দ্বিতীয়বার দ্বীপান্তর হয়। সে যাত্রায় ১৯৩৭ সালে ছাড়া পান। কিন্তু বছর দুয়েক পরেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার পর তাঁকে আরও একবার গ্রেপ্তার করা হয়। রাখা হয় দেওলী জেলে। জেলে যক্ষ্মা রোগে স্বাস্থ্যের ভয়ানক অবনতি হওয়ায় তাঁকে পাঠানো হয় সুলতানপুর জেলে। ১৯৪১ সালে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। গোরখপুরে নজরবন্দী অবস্থায় রোগে ভুগে ১৯৪২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁর মৃত্যু হয়।
বইটির মোট চারটি সংস্করণ তাঁর জীবৎকালেই প্রকাশিত হয়। এই বইয়ের চতুর্থ সংস্করণ বেরোয় ১৯৩৮ সালে লখনউ থেকে। ভূমিকায় শচীন্দ্রনাথ লেখেন - "আমি ১৯২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আন্দামান থেকে ফিরি এবং কলকাতায় বসে ১৯২২ সালের ২৫ আগস্ট বইটি লিখি। অদৃষ্টের কী সদাশয়তা যে এই বইটির দুটি অধ্যায় আমি যথার্থরূপে লিখতে পারিনি কি আমাকে ফের জেলে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এবার ১৬ বছর পরে আজ ফের এই বইটির সম্পাদন কার্যে হাত লাগিয়েছি।"
শচীন্দ্রনাথ নিজের পরিবারজীবন নিয়ে কথা বলেছেন। দেশের প্রতি কর্তব্য পালন করতে পরিবারের প্রতি কর্তব্যে অবহেলা হয়েছে, এই বেদনা ব্যক্ত করেছেন বারবার। এক জায়গায় তিনি লিখেছেন - "আমার স্ত্রীর মুখ দেখে আমার মনে এই ভাবনা দেখা দিত যে অপরের মেয়েকে আমি এ কোথায় টেনে আনলুম।... নিজের ছেলের মুখ দেখতাম তো চিন্তা হত সে বেচারাও কি নিজের পিতৃস্নেহ থেকে চিরতরে বঞ্চিত হয়ে থেকে যাবে না?"
শচীন্দ্রনাথের বইটি তৎকালীন চরমপন্থী আন্দোলনের একটি বিশ্বস্ত দলিল। এই বইয়ে বিপ্লবীদের ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে আলোচনা করতেও দ্বিধা বোধ করেননি। এসেছে কমিউনিজমের প্রসঙ্গও। লেনিনের জীবনী রচনার কাজেও হাত দিয়েছিলেন কিন্তু তা শেষ করে যেতে পারেননি। কিছুদিন তিনি 'অগ্রগামী' পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। 'বন্দী-জীবন' বইটি সে-সময় বিপ্লবীদের হাতে-হাতে ঘুরেছে। প্রকৃত বিচারে ভগৎ সিং-এর 'জেল ডায়েরি'-র চেয়ে এই বইটির গুরুত্ব কোনও অংশে কম নয়।
..................
ঋণ : ১) বিপ্লবী নায়ক শচীন্দ্রনাথ সান্যাল, বিজয় বন্দ্যোপাধ্যায়
২) বন্দী-জীবন, শচীন্দ্রনাথ সান্যাল, (সম্পাদনা - পণ্ডিত সত্যনারায়ণ শর্মা)
#Sachindra Nath Sanyal #Bandi Jivan #Indian revolutionary #silly পয়েন্ট