নিবন্ধ

<strong>ফলারে বাঙালি<strong>

রণিতা চট্টোপাধ্যায় Sep 6, 2020 at 8:37 am নিবন্ধ

রসিয়ে কষিয়েঃ প্রথম পর্ব

এক যে ছিল বামুন। সেও গরিব, তার যজমানদেরও বিশেষ সচ্ছলতা নেই। এতদিন তাদের বাড়িতে চিঁড়ে দই ফলার করেই তার দিন কাটত, কিন্তু যেদিন থেকে সে শুনেছে পাকা ফলার নাকি ঢের বেশি সুস্বাদু, সেটা চেখে না দেখা অব্দি তার শান্তি নেই। তা আর পাঁচজনের পরামর্শে পাকা ফলার খেতে বামুন চলেছিল রাজার বাড়ি। সে দেশে একমাত্র রাজাই থাকেন পাকা বাড়িতে। দেশের অর্থনীতির হালহকিকত নিয়ে ছোটোবেলায় তেমন মাথাব্যথা থাকে না, তাই বেচারা বামুন যখন ‘পাকা বাড়ি’-কেও পাকা ফলার দিয়ে তৈরি ভেবে দেওয়ালের একটা কোণ কামড়ে ধরেছিল, তখন দুঃখ পাওয়ার বদলে হেসেছিলাম বিস্তর।


‘ফলারটি পাকা হয় লুচি দই আহারে’, এ কথা জানিয়েছেন সুকুমার রায়। কিন্তু গরিব বামুনের কপালে সেরকম পাকা ফলার জুটেছিল কি না, সে গল্প জানেন কেবল উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। সে যাই হোক, এদিক-ওদিক অন্যান্য বইয়ের পাতা ওলটালে আমরা জানতে পারি, ফলার জিনিসটা মোটেই গরিবদের একচেটিয়া ছিল না। তবে, কাঁচা আর পাকা ফলারের মতো গুণমানের ভেদ ছিল না বললে সত্যের অপলাপ হবে। পণ্ডিত রামনারায়ণ তর্করত্নের সাক্ষ্য নেওয়া যাক প্রথমেই। ১৮৫৪ সালে লেখা তাঁর ‘কুলীনকুলসর্বস্ব’ নাটকে বৈদিক ব্রাহ্মণ উদরপরায়ণ ফলারের খোঁজ করে বেড়ায়। উনিশ শতকে ভোজ মানেই ফলার। উদরপরায়ণের মতে ফলার তিন প্রকার— উত্তম, মধ্যম ও অধম।

উত্তম ফলার দেখা যাচ্ছে পাকা ফলারের নামান্তর—


“ঘিয়ে ভাজা তপ্ত লুচি দু চারি আদার কুচি
কচুরি তাহাতে খান দুই।
ছকা আর শাক ভাজা মতিচুর বঁদে খাজা
ফলারের জোগাড় বড়ই।।”


'নিকুতি', 'জিলাপি', গজা, ছানাবড়া, হরেক রকম মণ্ডা, ক্ষীর, শুকো দই, কী নেই এই তালিকায়! আর চেরি অন দ্য টপ, পানের সঙ্গে দক্ষিণা।

মধ্যম ফলারটা কেমন?


“সরু চিঁড়ে শুকো দই মত্তমান ফাকা খই
খাসা মণ্ডা পাত পোরা হয়।
মধ্যম ফলার তবে বৈদিক ব্রাহ্মণে কবে
দক্ষিণাটা ইহাতেও বয়।।”

আর অধম ফলারের কৌলীন্য নেই মোটেও—


“গুমো চিঁড়ে জলো দই তিতগুড় ধেনো খই
পেট ভরা যদি নাই হয়।
রৌদ্দুরেতে মাথা ফাটে হাত দিয়ে পাত চাটে
অধম ফলার তাকে কয়।।”


রামগতি ন্যায়রত্নের ‘বাঙ্গালা ভাষা ও বাঙ্গালা সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব’ (৩য় সংস্করণ, ১৩১৭)-এও পাওয়া যাচ্ছে ফলারের বর্ণনা— “চাঁপাকলা কুশীয়ারি চিনি সন্দেশ। ফলারের যত দ্রব্য আছয়ে বিশেষ।।”

‘কলিকাতার পুরাতন কাহিনী ও প্রথা’-তে মহেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন, “পূর্বে শ্রাদ্ধাদিতে ব্রাহ্মণভোজন করাইতে হইলে ফলার করানো হইত৷ ভাজা চিঁড়ে, ঘি, মোণ্ডা এবং কোন কোন স্থলে খই, দই ইত্যাদি দিয়া ফলার করানো৷” ব্রাহ্মণভোজনের ক্ষেত্রে এহেন ফলারের সুবিধাও ছিল বই কি, লবণের প্রয়োজন না হলে জাত যাওয়ার চিন্তাও থাকে না। তবে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় যখন ‘ইছামতী’ উপন্যাস লিখছেন, ১২৭০ বঙ্গাব্দের পটভূমিতে, সেকালে নুন থাক বা না থাক, অব্রাহ্মণের বাড়িতে খাওয়ার কথাও চিন্তা করতে পারতেন না কুলীন ব্রাহ্মণরা। তাতে অবশ্য নিমন্ত্রণ বাতিল হত না, কেবল ফলারের স্থান নির্ধারিত হত কোনও ব্রাহ্মণগৃহে। খাদ্যতালিকাও তৈরি করে দিতেন নিমন্ত্রিত ব্রাহ্মণরাই। এ উপন্যাসে তীর্থযাত্রী ব্রাহ্মণদের আহার্যতালিকায় ছিল— আধ মন সরু চিঁড়ে, দই, খাঁড়গুড়, ফেনি বাতাসা, কলা, আখ, দশ সের মুড়কি। এর ওপরে আড়াই সের মঠের বরাত পেয়েছিল কেষ্ট ময়রা। বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় আবার লিখেছেন ফলার করার পাশাপাশি নিমন্ত্রিতদের লুচি-মিষ্টি ছাঁদা দেওয়ার কথা, নুন ছাড়া কুমড়োর ছোঁকা সেখানে ‘সকড়ি’ হওয়ার থেকে রেহাই দিত। খাবার আলুনি হোক বা না হোক, ফলারের নিমন্ত্রণে দেখা মিলতই বড় বড় খাইয়েদের। উপেন্দ্রকিশোর-ই লিখেছিলেন এমন এক ব্রাহ্মণের কথা, বিপুল পরিমাণে ক্ষীর চিনি ফলার করার দরুন তিনি মারাই পড়েছিলেন।


ব্রাহ্মণদের জাতপাতের ছোঁয়াছুঁয়ির ঠিক বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে ছিল পাঁচশো বছর আগের ‘চিঁড়ামহোত্‍সব’। পানিহাটিতে নিত্যানন্দের দেওয়া শাস্তি মেনে রঘুনাথদাস গোস্বামী চিঁড়ে দই বিতরণ করেছিলেন হাজার হাজার ভক্তদের মধ্যে। বৈষ্ণবরা অল্পেই সন্তুষ্ট, ফলারের প্রাচুর্য সেখানে ছিল না। চৈতন্যচরিতামৃতেও রয়েছে এ দিনের উল্লেখ— “রঘুনাথদাস নিত্যানন্দ পাশে গেলা। চিঁড়া দধি মহোৎসব তাহাই করিলা।।”


মুকুন্দ চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে নিদয়ার সাধের খাদ্যতালিকায় ছিল ‘চিঁড়া চাঁপাকলা দুধের সর’ এবং মহিষা-দই, খই, চিনি মিশ্রিত ফলার। কবিকঙ্কণ লিখছেন, “স্নান করি দুর্বলা/ খায় দধি খণ্ড কলা/ চিঁড়া দই দেয় ভারি জনে৷” ‘জলপান’ অর্থাৎ জলখাবার হিসেবে এই দ্রব্যগুলির যথেষ্ট প্রচলন ছিল। সহজলভ্যতাই এই খাবারটির জন্ম দিয়েছিল বলে মনে হয়। সেকালে বাঙালির জমিতে ধান ছিল আর গোয়ালে গোরু, ফলে চিঁড়ে দুধ দইয়ের জোগান পেতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। ‘নৌকাডুবি’-তে স্টিমার যাত্রার সময় দেখা যায় লুচির চেয়েও ফলারের প্রলোভন দরিদ্র বালক উমেশের কাছে অনেক বেশি। সুযোগ পেয়েই সে আর্জি পেশ করে, “মাঠাকরুন, দয়া কর যদি, গ্রামে গোয়ালার বাড়িতে বড়ো সরেস দই দেখিয়া আসিলাম। কলা তো ঘরেই আছে, আর পয়সা-দুয়েকের চিঁড়ে-মুড়কি হইলেই পেট ভরিয়া আজ ফলার করিয়া লই।” অবশ্য এই দরিদ্র প্রজাদেরই প্রলোভিত করতে ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসে মধুসূদন যে ফলারের আয়োজন করেছিল, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় তা ‘সামান্য ফলার’ নয়। বিপুল পরিমাণে মাছ দই ক্ষীর সন্দেশ ঘি ময়দা চিনি আমদানি করা হয়েছিল, তবে শোরগোলের পরিমাণ ছিল খাবারের থেকেও বেশি।


হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’-এ ‘ফলার’ অর্থে জানাচ্ছেন, চিঁড়া খই দই চিনি মিষ্টান্ন কলা আম ইত্যাদি নিরামিষখাদ্যের ভোজ। ‘ফলাহার’ থেকেই ফলার শব্দের উৎপত্তি। সে তো আমরা জানিই, কারণ আশাপূর্ণা দেবীর ‘নিজস্ব সংবাদদাতা’ গল্পে পিসিমা কাকচরিত্র-সাধক ভুচুকাকাকে স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, ফলাহার যা ফলারও তা, কেবল উচ্চারণের হেরফের।

ঋণ স্বীকার:
কুলীনকুলসর্বস্ব, রবীন্দ্র রচনাবলী, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী রচনাসমগ্র, বঙ্গীয় শব্দকোষ।
পদরত্নাবলী,গৌতম বসুমল্লিক, ‘এই সময়’, ১৫ জুন ২০১৫।

পোস্টারঃ অর্পণ দাস

#ফলারে বাঙালি #রণিতা চট্টোপাধ্যায় #রসিয়ে কষিয়ে #food #bengali food #নিবন্ধ #ফলার

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

25

Unique Visitors

215798