প্যাট্রিক গ্রাহামের ‘বেতাল’ ও একটি সম্ভাবনার অপমৃত্যু
ভিক্টোরিয় যুগের শেষভাগে রচিত একাধিক জনপ্রিয় কাহিনিতে দেখা যায়, পরাক্রমশালী এবং প্রবল আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান কোনও ব্রিটিশ সাহেব সাম্রাজ্যের দূর প্রান্তে অবস্থিত কোনও উপনিবেশে কাজ করতে গিয়ে মুখোমুখি হচ্ছেন কোনও অলৌকিক অভিজ্ঞতার, যা প্রশ্নের মুখে ফেলে দিচ্ছে তাঁর ইউরোপীয় যুক্তিবোধে পুষ্ট মননকে, ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে তাঁর শারীরিক ও মানসিক ভারসাম্য। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় ব্রাম স্টোকারের ড্রাকুলা, জোসেফ কনরাডের হার্ট অফ ডার্কনেস বা রুডিয়ার্ড কিপলিঙের দ্য মার্ক অফ দ্য বিস্ট গল্পটির (সত্যজিৎ রায়ের ‘খগম’ গল্পের উৎস)। সমালোচকদের মতে, ভিক্টোরীয় যুগের শেষভাগে জার্মানি ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক উত্থান, ব্রিটিশ পণ্যসামগ্রীর পড়তি চাহিদা, বুয়র যুদ্ধের হতাশাব্যঞ্জক পরিণাম ইত্যাদি নানা কারণে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে ইংরেজদের মনে ক্রমশ অনিশ্চয়তা দানা বাঁধতে শুরু করে, তাদের মনে হতে থাকে শহরাঞ্চলের আরামপ্রদ জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত ব্রিটিশ জাতির শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ক্রমাবনতির ফলে তারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রক্ষণাবক্ষেণে অনুপযুক্ত হয়ে পড়ছে, যে আশঙ্কা প্রতিফলিত হয় এই রচনাগুলিতে।
প্যাট্রিক গ্রাহাম পরিচালিত ‘বেতাল’ ওয়েব সিরিজের পূর্বকথায় আমরা পাই এমনই এক কাহিনি। ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষের অত্যাচারী এক অফিসার, জন লাইনডক ছিলেন ৯০তম টনটন ভলান্টিয়ার্স রেজিমেন্টের লেফটেন্যান্ট কর্নেল। ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের সময় সেপাইদের তাড়া খেয়ে তিনি রেজিমেন্টের অন্যান্যদের সঙ্গে এক আদিবাসী গ্রামে অবস্থিত একটি সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়েন, এবং আত্মরক্ষার জন্য নিজের পুত্রকে বলি দিয়ে জাগিয়ে তোলেন আদিবাসীদের প্রাচীন দেবতা বেতালকে। লাইনডকের দেহে প্রবেশ করে বেতালের শক্তি, এবং তাঁর সম্পূর্ণ রেজিমেন্ট অমরত্ব লাভ করে। দূর উপনিবেশে এসে তথাকথিত অসভ্য ভারতীয় আদিবাসীদের দৈবী শক্তিকে আত্মস্থ করেন লাইনডক, তাঁর সম্পূর্ণ সৈন্যদল পরিণত হয় বেতালের আজ্ঞাবহ এক পৈশাচিক বাহিনীতে। ড্রাকুলা উপন্যাসের ভ্যাম্পায়ার কাউন্টের অনুগত ব্রিটিশদের মতই এক ধরণের reverse colonization বা বিপরীতমুখী ঔপনিবেশিকতার নিদর্শন দেখতে পাই আমরা। ব্রিটিশ ভারতে অত্যাচারী অফিসারের কুকীর্তির সঙ্গে জুড়ে যায় স্বাধীন দেশে নয়া সাম্রাজ্যবাদের উৎপীড়ন। আমরা দেখতে পাই, বর্তমান যুগে সেই আদিবাসী গ্রামটির সংলগ্ন পুরো এলাকাটিতে সূর্য কন্সট্রাকশন কোম্পানির উদ্যোগে একটি ইন্ডাস্ট্রিয়াল সাইট বানাবার পরিকল্পনা চলছে, অনিচ্ছুক আদিবাসীদের স্থানান্তরিত করবার জন্য ডাকা হচ্ছে কাউন্টার ইন্সার্জেন্সি পোলিস ডিপার্টমেন্টের অভিজাত ইউনিট ‘বাজ স্কোয়াড’কে। মনে পড়ে যায় অরুন্ধতী রায়ের লেখা, যেখানে তিনি দেখিয়েছেন স্বাধীন ভারতে উন্নয়নের অজুহাত দেখিয়ে কিভাবে একের পর এক শিল্পোদ্যোগের কারণে ঘরছাড়া করে দেওয়া হয়েছে পাঁচ কোটি মানুষকে, যাদের অধিকাংশই আদিবাসী বা দলিত। আদিবাসীদের বারংবার নিষেধ সত্ত্বেও গ্রাম সংলগ্ন বেতাল পাহাড়ে প্রবেশ করে বাজ স্কোয়াডের কমান্ডোরা, এবং জাগিয়ে তোলে ঘুমন্ত বেতাল ও তার আজ্ঞাবহ গোটা রেজিমেন্টকে, যারা পরিণত হয়েছে পৈশাচিক জম্বিতে। বেতাল/লাইনডকের আত্মা যখন একের পর এক কমান্ডোর উপর তার প্রভাব বিস্তার করতে থাকে, আমরা বুঝতে পারি, ক্ষমতালোভী ব্রিটিশ অফিসারের রেজিমেন্ট ও মুনাফালোভী শিল্পোদ্যোগীর কাজে নিযুক্ত মিলিটারি আসলে একে অন্যের প্রতিচ্ছবি, সাম্রাজ্যবাদ মোটেই নিপাত যায়নি, কিঞ্চিৎ চরিত্র বদলেছে মাত্র। যে মুহূর্তে সূর্য কোম্পানির মালিক মুধলভন তার নাবালিকা কন্যা সানভিকে বেতালের হাতে তুলে দেবার জন্য রফা করতে চায়, আমরা বুঝতে পারি লাইনডকের সঙ্গে তার স্পষ্ট সাদৃশ্য।
কিন্তু যেহেতু বেতালকে এক বৃদ্ধার সাহায্যে আদিবাসীরাই প্রথম জাগিয়ে তোলে তাদের বাসভূমিকে রক্ষা করবার জন্য, বেতালের সৈন্যবাহিনি এক্ষেত্রে এক ভিন্ন তাৎপর্য অবশ্যই বহন করে। দেবতাকে জাগ্রত করবার পূর্ব মুহূর্তে আদিবাসী ওঝা বলে ওঠে, ‘বেতাল, বিদেশিরা আমাদের পাহাড় জঙ্গল নদী কেড়ে নিতে আসছে, তুমি এর বিহিত করো।‘ রাষ্ট্রবাদের পরিচিত তত্ত্বকে চ্যালেঞ্জ করে বেতালের বাহিনী হয়ে ওঠে ভারতের সমস্ত পীড়িত নির্যাতিত আদিবাসীদের অলৌকিক বা গথিক প্রতিনিধি, উন্নয়ন ছিনিয়ে নিয়েছে যাদের ঘর বাড়ি সমাজ সংস্কৃতি, ধ্বংস করেছে তাদের চেনা পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র। প্রথম সিজনের কাহিনীর শেষে বেতাল পাহাড় ছাড়িয়ে ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে বেতালের পিশাচেরা, শেষ ফ্রেমে অগ্রসরমান সারিবদ্ধ ভৌতিক ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ আরো একবার মনে করিয়ে দেয় সেই অমোঘ সত্য- সাম্রাজ্যবাদ বিদায় নেবার বদলে তার চরিত্র বদলেছে শুধু, যা আরও ভয়ঙ্কর, অধিকতর আগ্রাসী।
অভিনয়ে আলাদা করে বলতে হবে ‘সেক্রেড গেমস’ খ্যাত জিতেন্দ্র জোশী ও আহলুওয়ালিয়ার চরিত্রে আহানা কুমরার কথা। মুধলভনের মেয়ের চরিত্রে সাইনা আনন্দও যথাযথ। তবে সিরোহীর চরিত্রে বিনীত সিংহকে দেখবার পর যেন অপূর্ণতা রয়ে গেল, ‘বম্বে টকিজ’বা ‘মুক্কাবাজ’ছবিতে আমরা আরও উন্নত মানের অভিনয় পেয়েছি তাঁর কাছে। অজস্র খামতি রয়ে গেল সুচিত্রা পিল্লাই, মঞ্জিরী পুপালা, রিচার্ড ডিলেন প্রভৃতি শিল্পীর কাজেও। একেবারেই মন ভরাতে পারল না শ্রীনিবাস আচারি ও তনয় সাতামের সিনেম্যাটোগ্রাফি, ঘনঘন জমাট অন্ধকার দেখিয়ে দর্শককে কানা করে না দিয়েও যে রহস্য এবং আতঙ্কের আবহ তৈরি করা সম্ভব এটা বোধহয় তাঁরা জানেন না। তবে আঁতকে ওঠার মত খারাপ কাজ উপহার দিয়েছে ভিএফএক্স টিম, নড়বড়ে মাথা ও টুনিবালবের চোখ লাগানো লাইনডকের জম্বি যোদ্ধাদের দেখে প্রাইমারি স্কুলের বাচ্চারাও হেসে উঠবে। এছাড়া প্রথম দুই এপিসোডের পর কাহিনী বড্ড খাপছাড়া ভাবে এগোয়, পরিকল্পনায় তাড়াহুড়োর ছাপ স্পষ্ট। পরিশেষে বলা যায়, তাঁর আগের কাজ ‘ঘাউল’ ওয়েব সিরিজটির মতোই এবারেও একখানা অত্যন্ত শক্তিশালী এবং সম্ভাবনাময় ভাবনা আশ্রয় করে কাজ শুরু করলেও দুঃখের কথা এই যে গ্রাহামসাহেব দুর্বল পরিচালনার জেরে নিজের তরী নিজেই ডুবিয়েছেন।
#Betaal #Netflix #Web series #Patrick Graham #Red Chillies Entertainment #বেতাল #ওয়েব সিরিজ #রিভিউ #বিপ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য্য