বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

পোলিওর টিকা : দুজন ভালোমানুষের বিজ্ঞান

স্বপন ভট্টাচার্য Jan 5, 2021 at 4:36 am বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

একটা গোটা বছর সারা বিশ্বকে নাকানি চোবানি খাইয়ে বছর শেষে করোনাভাইরাস কাবু হওয়ার একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে দু-চারটে টিকা এসে যাওয়ার খবরে। একটা টিকা স্বাভাবিক নিয়মে বাজারে আসতে অন্তত পনের বছর সময় লাগে, কিন্তু অতিমারিকালে নিয়মের নিগড়ও কিছুটা ব্যাকফুটে। ফ্রন্টফুটে খেলছে বাণিজ্য আর টিকা-জাতীয়তাবাদ। ফাইজার কোম্পানিকে করোনা টিকার স্বত্ব বিক্রি করে জার্মানিতে অভিবাসী তুর্কি দম্পতি উঘুর  শাহিন এবং ওজলেম তুরেচি ঠিক কত টাকা পেয়েছে তা অনুমানসাপেক্ষ বটে, কিন্তু সম্পদের নিরিখে এই এক ধাক্কায় তারা যে বিশ্বের প্রথম একশো ধনীর ভিতরে ঢুকে পড়েছে সেটা সত্য। করোনা মানবদেহের স্থায়ী ভিজিটর হলে তাদের টাকাপয়সা কালে কালে আকাশচুম্বী হবে সন্দেহ নেই। কোভিডের প্রকোপে, আর যাই হোক, বাচ্চাদের মায়েদের তেমন চোখের জল ফেলতে হয়নি। পোলিও কিন্তু তা ছিল না। টিকা আবিষ্কারের আগে পোলিওতে শুধু আমেরিকাতেই বছরে লক্ষাধিক শিশু হয় মারা যেত, নয়ত স্থায়ীভাবে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে যেত। সারা পৃথিবীতে এই রোগের অভিঘাত কী ছিল তা যদি অনুমান করতে পারেন, তাহলে এটাও অনুমান করুন, পোলিওর যে দুটো টিকা এখনও সারা পৃথিবীতে প্রতিটি জন্মের পরে দেওয়াই দস্তুর, সেগুলোর আবিষ্কারক দুই ভাইরোলজিস্ট এই টিকা থেকে ঠিক কত টাকা কামিয়েছেন? অবাক করার মতো মনে হলেও এর সহজ উত্তর হল – এক পয়সাও না।

পোলিও টিকায় প্রথম সাফল্য ১৯৪৮ সালে হিলারি কপ্রোওস্কির। তিনি একটা নিষ্ক্রিয় টাইপ-২ (পোলিওভাইরাস তিন টাইপের – ১, ২, ৩) পোলিওভাইরাস ভ্যাকসিন প্রথমে শিম্পাঞ্জির উপর এবং তারপরে নিজের উপরেই টেস্ট করে ফেললেন তাঁর এক সহকর্মীকে নিয়ে। দুজনেই সুস্থ রইলেন তাঁরা। কিছুদিন পরেই কপ্রোওস্কি টেস্ট করলেন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন অথবা মৃগী রোগে ভোগা বাচ্চাদের উপরেও। শুনতে নিষ্ঠুর লাগলেও তখনকার দিনে নতুন ওষুধ বা টিকার ট্রায়ালে এই ধরণের বাচ্চাদের গিনিপিগের মত ব্যবহার করা বিরল ছিল না মোটেই। যাই হোক, সেই বাচ্চারা কিন্তু দিব্যি সুস্থ রইল। তবে কপ্রোওস্কির টিকা ছিল কেবল টাইপ-২ পোলিও-প্রতিরোধী, ফলে তার সর্বজনীনতা নিয়ে সংশয়ও জন্মাল। আমেরিকায় তৈরি সংস্থা ন্যাশানাল ফাউন্ডেশন ফর ইনফ্যান্টাইল প্যারালাইসিসের হয়ে জোনাস সাল্ক প্রথম ট্রায়াল চালালেন ওই বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন বাচ্চাদের উপরেই। টিকা হিসাবে তিনি ব্যবহার করেছিলেন তিন টাইপেরই পোলিওভাইরাসের ‘মৃত’ নমুনা যারা গ্রহীতাদের দেহে অ্যান্টিবডি তৈরি করতে পারবে, কোনোরকম রোগ সৃষ্টি না করেই। দেশবাসীকে নিঃসংশয় করার জন্য তিনি, তাঁর স্ত্রী এবং তিন ছেলে নিজেরাই টিকা নিলেন ইনজেকশনের মাধ্যমে। ফলে সারা দেশ জুড়ে একটা বড়সড় ট্রায়ালের ভিত্তি তৈরি হল আর ১৯৫৪-এর এপ্রিল থেকে ট্রায়াল পুরোদমে শুরুও হয়ে গেল। এত বড় ভ্যাকসিন ট্রায়াল এর আগে কোনোদিন হয়নি।  ২০,০০০ ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মী, ৬৪,০০০ স্কুলশিক্ষক, ২,২০,০০০ স্বেচ্ছাসেবককে অংশীদার করে এই ট্রায়ালে ১৮,০০,০০০ (মতান্তরে ১৩,০০,০০০) স্কুলের বাচ্চাকে ডবল ব্লাইন্ড পদ্ধতিতে (গ্রহীতা বা স্বাস্থ্যকর্মী কেউ জানে না কে আসল টিকা পাচ্ছে আর কে পাচ্ছে নকল) টিকা দেওয়া হয়েছিল। ট্রায়ালের ফলাফল বিশ্লেষণ করতে পুরো এক বছর লেগে গেলেও তার ফলাফল ছিল যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক। প্যারালাইটিক পোলিওর বিরুদ্ধে সাল্কের  টিকার কার্যকারিতা দেখা গেল ৮৫-৯০ শতাংশ। ফলাফল আসার এক দিনের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের অনুমোদন এবং এই টিকার বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের অনুমতি চলে এল। ছটা কোম্পানির হাত ধরে শুরু হল টিকা উৎপাদন এবং গণ টিকাকরণ।  এসবের মাঝে কপ্রোওস্কি টাইপ-১ পোলিওভাইরাসের জন্য একটি খাওয়ার মতো টিকা বার করে ফেলেছেন এবং ট্রায়ালের জন্য চলে গিয়েছেন কঙ্গোতে, কারণ সেখানকার অধিবাসীরা নাকি ওই টাইপ-১ ভাইরাসেই আক্রান্ত হয়ে থাকে সাধারণত। কপ্রোওস্কির দুর্ভাগ্য, ফলাফল বিশ্লেষণের আগেই বেলজিয়ান কঙ্গোতে রাজনৈতিক অস্থিরতার ফলে তাঁকে চলে আসতে হয়।  ওরাল পোলিও যে কার্যকরী হতে পারে তার প্রমাণ ইতোমধ্যেই পাওয়া যাচ্ছিল এবং এখানেই আমাদের যেতে হবে অ্যালবার্ট স্যাবিনের কাছে। স্যাবিন তিন রকম পোলিওভাইরাসকেই নিষ্ক্রিয় করে ওরাল পোলিও ভ্যাকসিন (OPV) তৈরি করতে সমর্থ হয়েছিলেন। তৎকালীন সোভিয়েত সরকার দেশের বাচ্চাদের জন্য একটা কম দামি বিকল্প খুঁজছিল, তারা স্যাবিনের সঙ্গে চুক্তি করল – সে দেশের দশ লক্ষ বাচ্চাকে নিয়ে গণ টিকাকরণের। ওরাল ভ্যাকসিন ব্যবহারে দাম ছাড়াও আরও কয়েকটি সুবিধা আছে। এক তো ওরাল বলে বাচ্চারা ভয় পাবে কম, চাই কি লজেন্সের মতো করেও খাওয়ানো যাবে এবং সরাসরি পেটে যাবে বলে মলের সঙ্গে নিঃসৃত এই নিষ্ক্রিয় ভাইরাস পরিবেশে ছড়ানোর সুযোগ পাবে। ফলে আজকের দিকে আমরা যাকে হার্ড ইমিউনিটি (Herd Immunity) বলি, তা অর্জন করা অপেক্ষাকৃত সহজ হবে। রাশিয়ান এক্সপেরিমেন্ট সফল হলে আমেরিকা আর দেরি করেনি। ১৯৬১-তে তারাও স্যাবিনের ওরাল ভ্যাকসিনকে লাইসেন্স দিয়ে দিল।

সাল্ক ছিলেন একান্তই মুখচোরা গোছের লোক, বেশি মনোযোগ কোনোদিনই আকর্ষণ করতে চাননি। কিন্তু পোলিও ভ্যাকসিনের সাফল্যের পর সেই সাল্ক-ই সারা বিশ্বের কাছে হয়ে গেলেন ‘মিরাকল ওয়ার্কার’। প্লেনে উঠলে পাইলট ঘোষণা করে – “আজ আমাদের সঙ্গে চলেছেন জোনাস সাল্ক”। হোটেলে উঠলে হোটেলমালিক তাঁকে পেন্টহাউস সুইটে রেখে ধন্য মনে করে। খেতে গেলে দু'দণ্ড চুপচাপ খেতেও পারেন না, কেউ না কেউ এসে অটোগ্রাফ চেয়ে বসে, এমনই ছিল তাঁর খ্যাতির বিড়ম্বনা। সেই সাল্ককে  যখন জিগ্যেস করা হয়েছিল, আপনার পোলিও ভ্যাকসিনের পেটেন্ট কার হাতে আছে? তিনি জবাব দিয়েছিলেন – মানুষের হাতে, কেউ কি সূর্যকে পেটেন্ট করতে পারে? সেই তখনই যদি চাইতেন তাহলে সেই ভ্যাকসিনের পেটেন্ট মূল্য দাঁড়াত সাতশো কোটি ডলার।  ন্যাশানাল ফাউন্ডেশন ফর ইনফ্যান্টাইল প্যারালাইসিস এটাকে পেটেন্ট করার চেষ্টা করেছিল বটে কিন্তু তাদের আইনজ্ঞরা পরামর্শ দেয় ভ্যাকসিনের পেটেন্ট পাওয়া সহজ নয়, কেননা এ শিল্প মৌলিক নয় বরং ‘প্রায়র আর্ট’ বলে বিবেচিত হওয়ার ফলে নন-পেটেন্টেবল বলে গণ্য হওয়ার কথা।  পোল্যান্ডের ইহুদি অ্যালবার্ট স্যাবিনের সামনেও ওরাল পোলিও ভ্যাকসিন পেটেন্ট করার সুযোগ ছিল। সাল্কের ভ্যাকসিনের উপাদান ছিল ‘মৃত’ পোলিওভাইরাস যা ইনজেকশনের মাধ্যমে দেওয়া হত আর স্যাবিনের ভ্যাকসিন ছিল অকেজো (inactivated) পোলিওভাইরাস এবং ‘ওরাল’ হওয়ার ফলে ব্যবহারযোগ্যতার দিক থেকে সহজ। উপরন্তু সাল্কের ভ্যাকসিন সরাসরি রক্তে মেশে বলে অন্ত্রের পোলিওভাইরাস তা দিয়ে প্রশমিত হওয়ার কথা নয়। স্যাবিন কিন্তু এর আগেই শব ব্যবচ্ছেদ করে দেখিয়েছেন পোলিও দেহে ঢোকে জলবাহিত হয়ে। দাবি করলেন ওরাল ভ্যাকসিন অন্ত্রেই সেটাকে অকার্যকরী করে দিতে পারে। প্রচুর প্রলোভন দিয়েও তাঁকে দিয়ে এর পেটেন্ট নেওয়ানো যায়নি। কার্যত একটা পেনিও তিনি উপার্জন করতে চাননি ভ্যাকসিন থেকে। অধ্যাপনার চাকরি থেকে যে মাইনে পেতেন তাতেই কাটিয়ে গেছেন সারাজীবন। বলতেন, ওষুধ কোম্পানির হাতে পড়লে গরীব দেশগুলোর পক্ষে পোলিওর অভিশাপ কাটিয়ে ওঠা শক্ত হবে। আজকের এই অতিমারি বাণিজ্যের দিনে দাঁড়িয়ে সাল্ক ও স্যাবিন – এই দু’জন ভাইরোলজিস্টকে কেমন রূপকথার মানুষের মতো মনে হয় না কি?   



#Jonas Salk # Albert Bruce Sabin #polio vaccine #oral vaccine #পোলিও টিকা #ভ্যাক্সিন #প্রযুক্তি #স্বপন ভট্টাচার্য #সিলি পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

64

Unique Visitors

215959