পারিবারিক হিংসা : আইন কী বলছে জেনে নিন
ন্যাশনাল ক্রাইম ব্যুরোর রেকর্ড ঘাঁটলে দেখা যাবে চিরকাল বাইরের চেয়ে ঘরেই মেয়েরা বেশি আক্রান্ত হন। ঘরের আক্রমণকে চিনে নিতে অনেকক্ষেত্রে কিছুটা সময় লাগে, বা দ্বিধা হয়। কিন্তু কিছুটা সামাজিক সম্মতি নিয়ে আসে বলেই ঘরের আক্রমণ অনেক বেশি বহুমাত্রিক। লকডাউন-পরিস্থিতিতে গোটা বিশ্বজুড়ে পারিবারিক হিংসার ঘটনা অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে, এ খবর শুনে তাই আশ্চর্য লাগে না। সভ্যতার আদিকাল থেকে এ রোগ ভোল পাল্টে পাল্টে আমাদের সঙ্গে থেকে যাচ্ছে। অনেকসময় আমাদের অজান্তেই।
সমাজ-মনোবিজ্ঞান বলে, গার্হস্থ্য বা পারিবারিক হিংসা (Domestic Violence) কিংবা এরই অন্যতম শাখা Intimate Partner Violence-কে কোনওভাবেই আকস্মিকতা দিয়ে ব্যাখ্যা করা উচিত নয়। নির্যাতক হঠাৎ রাগের মাথায় এ জিনিস ঘটান না। এটি একটি যত্নে লালিত ও মানসিক অভ্যাসলব্ধ আচরণ। এর আসল কারণ খুঁজতে গেলে পেঁয়াজের খোসার মতো একের পর এক স্তর পেরিয়ে আমরা এসে দাঁড়াব সেই আদি অকৃত্রিম শত্রু লিঙ্গ-বৈষম্যে। পুরুষতান্ত্রিক পরিবেশ আমাদের মগজে এই ভয়ানক অসুখের ডালপালা ছড়িয়ে দেয়। এই ভয়ঙ্কর ভাইরাস থেকে নিজের নিজের মনের জগতে মুক্তি খোঁজা যেমন জরুরি, তেমনই জরুরি এই সংক্রান্ত ন্যূনতম কিছু আইন জেনে নেওয়া। মনে রাখা দরকার, আইন সর্বত্রগামী নয়। ভারতের মতো বিস্তৃত জনবহুল দেশে তো আরোই নয়। আইন সবসময় পারে না সবার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে। কিন্তু আইন মানুষকে সচেতন করতে পারে। এখানেই আইন জেনে রাখার গুরুত্ব। কারণ মানুষকেই আইনের কাছে এগিয়ে আসতে হবে, আইনের পক্ষে ঘরে ঘরে পৌঁছে যাওয়া সম্ভব না।
এক্ষেত্রে যে আইনটি প্রযোজ্য, তা হল ‘পারিবারিক নির্যাতন থেকে নারীদের সুরক্ষা আইন’ (২০০৫)। আইনটির খসড়া রচিত হয়েছে ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০০৫ তারিখে এবং এটি কার্যকরী হয়েছে ২৬ অক্টোবর, ২০০৬ তারিখ থেকে। আজকে আমরা এই আইনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের ৩ নম্বর ধারাটি দেখব, যেখানে পারিবারিক নির্যাতনের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এই আইনের মতে, বিবাদীর আচরণকে পারিবারিক নির্যাতন হিসাবে গণ্য করা হবে, যদি -
ক) কারও শারীরিক বা মানসিক স্বাস্থ্য, জীবন অথবা স্বাচ্ছন্দ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয় বা করার চেষ্টা করা হয়। এই তালিকায় থাকছে শারীরিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন, মানসিক নির্যাতন, মৌখিক ও আবেগ-নির্ভর নির্যাতন এবং আর্থিক নির্যাতন।
খ) নির্যাতিত ও তাঁর পরিবারের কোনও সদস্যকে হেনস্থা, ক্ষতি ও আঘাত করা অথবা বিপদে ফেলে বেআইনিভাবে তাদের থেকে পণ, সম্পত্তি অথবা মূল্যবান দলিল বা সম্পদ দাবি করা হয়।
(গ) নির্যাতিত ও তাঁর পরিবারের সদস্যকে ভয় দেখিয়ে উপরোক্ত (‘ক’ ও ‘খ’-তে বর্ণিত) কোনও আচরণ করা হয়, যা হুমকি হিসাবে গণ্য হতে পারে।
(ঘ) দাবি মিটলে বা না মিটলে উদ্দিষ্ট ব্যক্তির ওপর অন্য যে কোনও রকমের শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার, আঘাত বা ক্ষতির চেষ্টা করা হয়।
এক্ষেত্রে, শারীরিক ও যৌন নির্যাতন সম্পর্কে মানুষের মোটামুটি স্পষ্ট ধারণা থাকলেও মৌখিক ও আবেগ-নির্ভর নির্যাতন ও আর্থিক নির্যাতনের গণ্ডিটি বেশ বড়, ফলে সামান্য বিশদে ব্যাখ্যা করা যাক।
মৌখিক ও আবেগনির্ভর নির্যাতন হিসাবে বোঝান হয়েছে অপমান, অপবাদ, অপদস্থ করা, বাজে শব্দ প্রয়োগ করে ডাকা অথবা সন্তান ধারণ না করা বা পুত্র সন্তানের জন্ম না দিতে পারা সংক্রান্ত টিটকিরিকে।
আর্থিক নির্যাতন বলতে বোঝান হয়েছে,
A) নির্যাতিত ব্যক্তিকে সেই সমস্ত বা যে কোনো বিষয়-সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত রাখা যা নির্যাতিত ব্যক্তির আইনত বা প্রচলিত নিয়মানুসারে পাওয়ার কথা, বা এমন কিছু যা তিনি কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী পেয়েছেন অথবা অন্য যে কোনোভাবে তাঁর পাওনা। অথবা এমন কিছু যা তাঁর জীবনধারণের জন্য প্রয়োজন। অর্থাৎ এই তালিকায় থাকছে গৃহস্থালির নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস যা তাঁর ও তাঁর সন্তানের জন্য জরুরি, স্ত্রীধন, যৌথ বা একক ভাবে প্রাপ্ত সম্পত্তি, বাড়িভাড়া (যেখানে নির্যাতিত ব্যক্তি বিবাদীর সঙ্গে বা একা থাকতেন) এবং খোরপোশের অর্থ।
B) গৃহস্থালির জিনিসপত্র, স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি, শেয়ার, সিকিওরিটির কাগজপত্র, বন্ড এবং এই জাতীয় অন্যান্য সম্পত্তি যা নির্যাতিত ব্যক্তির প্রাপ্য, যা তিনি পারিবারিক সূত্রে পেয়েছেন, বা যা তাঁর ও তাঁর সন্তানের জীবনধারণের ক্ষেত্রে প্রয়োজন অথবা স্ত্রীধন অথবা অন্য যে কোনো সম্পত্তি যা তাঁর যৌথ বা একক ভাবে প্রাপ্য - তা থেকে বঞ্চিত করা।
C) নির্যাতিত ব্যক্তির একক বা যৌথভাবে প্রাপ্য সম্পত্তিতে বাধা সৃষ্টি করা বা নিয়ন্ত্রণ করা। এছাড়া বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা সংক্রান্ত বিষয়, যা ধারাবাহিকভাবে নির্যাতিতের প্রাপ্য, সেই প্রাপ্তির পথে বাধা সৃষ্টি করা।
এই আইনে বিবাদীর কোনো কাজ করা, বা না করা বা তাঁর সামগ্রিক আচরণকে পারিবারিক নির্যাতন হিসাবে গণ্য করা হবে কিনা তা উপস্থিত তথ্যপ্রমাণ ও পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির ভিত্তিতে বিচার করা হবে।
আমরা অতি গুরুত্বপূর্ণ এই আইনটির একটি অংশমাত্র দেখলাম, যেখানে পারিবারিক নির্যাতন বিষয়টাকে কীভাবে চিহ্নিত করতে হবে তার ব্যাখ্যা রয়েছে। এটাই পারিবারিক হিংসা মোকাবিলা করার প্রাথমিক ধাপ। কারণ প্রিয় সম্পর্কের আদর-অনাদরের মাঝখানের ধূসর অংশটিকে ব্যবহার করে অনেক পারিবারিক হিংসার ঘটনা দাম্পত্যজীবনের স্বাভাবিক অঙ্গ হিসেবে বেনিফিট অব ডাউট পেয়ে যায় এবং যাচ্ছে। বিশেষত বিবাহিত মহিলাদের ক্ষেত্রে Intimate Partner Violence-এর মতো অপরাধকে সঠিকভাবে চিনে নিতে গেলে এবং তার মোকাবিলা করতে গেলে আইনের এই দিকগুলো না জানলেই নয়। বিবাহিত মেয়েদের নিজের বাড়ির (এখানে নিজের বাড়ি বলতে ‘বাপের বাড়ি’ বোঝানো হচ্ছে। সমাজ যদিও অলিখিতভাবে বিশ্বাস করে যে মেয়েদের নিজের বাড়ি বলে কিছু হয় না) সদস্যদেরও জেনে রাখা দরকার। তাঁদেরও মনে রাখা দরকার, তাঁরা জেনেশুনে এই নির্যাতনগুলোকে ‘মেয়ে-জামাইয়ের ব্যক্তিগত ব্যাপার’ বা ‘মেয়ের শ্বশুরবাড়ির বিষয়’ বলে হাত গুটিয়ে থাকলে পরিস্থিতি যে কোনওদিন হাতের বাইরে বেরিয়ে যেতে পারে। পণ, চাকরি করা বা না করা, মতের অমিল, বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক ইত্যাদি নানা রূপ ধরে আসা এই ভাইরাসটিকে ভালো করে চিনে নেওয়া দরকার। খেয়াল রাখা দরকার, ক্ষমতা আর দখলদারির ঘৃণ্য খেলায় যাতে আমাদের চারপাশের কেউ আক্রান্ত না হয়ে যায়।
এর জন্য দরকার আমাদের সচেতনতার পরিধিকে আরও খানিক বাড়িয়ে তোলা। দরকার আইনের প্রতি ভরসা রাখা। আলোচনা চলুক। তর্ক হোক। মানুষের কাছে তথ্য পৌঁছক। আইন কী কী ভাবে সুরক্ষাকবচ হয়ে উঠতে পারে, এটুকু জেনে নেওয়া আমাদের সকলেরই প্রয়োজন।
শুধু যখন মনে পড়ে দেশের সর্বশেষ ব্লকবাস্টার ফিল্মের নাম কবীর সিং, সন্দেহ হয় এত আলোচনা আদৌ কোথাও পৌঁছচ্ছে কিনা।
ঋণ : ১) Protection of Women from Domestic Violence Act, 2005/ Women Laws, Professional Book Publishers, New Delhi/2013
২) লেখাটি দাঁড় করাতে সাহায্য করেছেন মৃণালিনী ঘোষাল। বিশেষ ধন্যবাদ তাঁকে।
#Domestic Violence # The Protection of Women from Domestic Violence Act 2005 #Intimate Partner Violence #Legal Consultancy #Indian Penal Code #National Crime Records Bureau #ঐন্দ্রিলা চন্দ্র #পারিবারিক হিংসা #পারিবারিক হিংসা থেকে নারীদের সুরক্ষা আইন ২০০৫