নিবেদিতার স্মৃতি আঁকড়ে দাঁড়িয়ে দার্জিলিং-এর রায় ভিলা
দার্জিলিঙের চৌরাস্তা থেকে যে রাস্তাটা লেবং ও ভুটিয়া বস্তির দিকে নেমে গিয়েছে, সেদিকে কিছুটা এগোলে ডানদিকে পড়বে এই সুবিশাল অট্টালিকা। রায় ভিলা। তেনজিং রকের কাছাকাছি। নির্জন জায়গা। চারদিকে পাইনের সারি। সামনে দিগন্তব্যাপী কাঞ্চনজঙ্ঘা।
তত্কালীন প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রথম বাঙালি প্রিন্সিপাল প্রসন্নকুমার রায়ের ভাই দ্বারকানাথ রায় ইউরোপীয় ক্যাসেলের ধাঁচে এই সুবিশাল অট্টালিকা নির্মাণ করান। বাড়ির নাম দেওয়া হয় ‘রায় ভিলা’। তবে, এই স্থাপত্যে রয়েছে অন্য মাহাত্ম্য। বহু মনীষীর ছোঁয়া পেয়েছে এখানকার ইট-কাঠ-পাথর। ভগিনী নিবেদিতার শেষের দিনগুলি কেটেছিল এই বাড়িতেই। এখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। স্বামী বিবেকানন্দ থেকে জগদীশ চন্দ্র বসু, একাধিকবার মণীষী-স্পর্শ পেয়েছে রায় ভিলা।
আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর স্ত্রী অবলা বসুর ভগ্নীপতি ছিলেন রায় ভিলার নির্মাতা দ্বারকানাথ রায়। পাহাড়-প্রকৃতিকে ভালোবেসে, দীর্ঘদিন এই বাড়িতে কাটিয়েছেন সস্ত্রীক জগদীশচন্দ্র বসু। ১৯০৩ সালের ২৭মে প্রথম রায় ভিলায় আসেন ভগিনী নিবেদিতা। এরপর কখনও অবসর যাপন করতে, কখনও ভগ্নস্বাস্থ্য উদ্ধারের আশায় বারবার তিনি আশ্রয় নিয়েছেন পাহাড়ের কোলে এই ভিলায়। তাঁর সঙ্গী হতেন বসু দম্পতি। সিস্টার নিবেদিতার সঙ্গে জগদীশ চন্দ্র বসু ও তাঁর স্ত্রীর অসাধারণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সম্পর্ক এতটাই বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল যে, অবলা বসুকে কখনও কখনও ‘বউ’ ও জগদীশচন্দ্রকে ‘খোকা’ বলে ডাকতেন নিবেদিতা। রায় ভিলায় থাকাকালীন, কখনও কাছাকাছি পাহাড়ি গ্রামগুলিতে ঘুরে বেড়াতেন নিবেদিতা, কখনও সহযোগিতা করতেন জগদীশচন্দ্রের গবেষণাপত্র তৈরির কাজে।
এই রায় ভিলায় একাধিকবার স্বামী বিবেকানন্দের পায়ের ধুলো পড়েছে। ১৮৯৭ থেকে ১৯০১-এর মধ্যে বেশ কয়েকবার দার্জিলিঙে গিয়ে রায় ভিলায় থেকেছেন তিনি। নিবেদিতার পা পড়ে বিবেকানন্দের মৃত্যুর ২ বছর পর। মোট ৭বার দার্জিলিঙে এসেছিলেন সিস্টার নিবেদিতা। ছিলেন ২৪২দিন। ১৯১১ সালে আমেরিকা থেকে ফিরে নিবেদিতার শরীর স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ে। আরোগ্যের জন্য জগদীশচন্দ্রের প্রস্তাব মেনে দার্জিলিং যাত্রা করেন নিবেদিতা। বসু দম্পতি আগেই পৌঁছে গিয়েছিলেন দার্জিলিংয়ে। একটু সুস্থ হতেই সান্দাকফু যাওয়ার পরিকল্পনা করেন তাঁরা। যেতে হবে ঘোড়ার পিঠে। অন্তত তিনদিন সময় তো লাগবেই। কিন্তু, প্রস্তুতি নেওয়ার সময়ই ফের অসুস্থ হয়ে পড়েন নিবেদিতা। জ্বর-বমি, সঙ্গে রক্ত-আমাশা। সেই সময় দার্জিলিঙেই ছিলেন চিকিত্সক নীলরতন সরকার। তাঁর শুশ্রুষা ও অবলা বসুর যত্নে সেরে ওঠেন নিবেদিতা। সে যাত্রা মুলতুবি রইল।
নিবেদিতা বুঝতে পেরেছিলেন শেষের দিন সমাগত। ৭ অক্টোবর তাঁর নির্দেশ মতো উকিল ডাকা হল, দানপত্র তৈরি করলেন। সঞ্চিত অর্থ, গ্রন্থস্বত্ব থেকে ভবিষ্যতে আয়ের অর্থ ও নারী শিক্ষা প্রসারের জন্য তুলে দিলেন বেলুড় মঠের ট্রাস্টিদের হাতে।
১৩ অক্টোবর, ১৯১১। সকাল থেকেই আকাশ ঘনঘোর। কুয়াশা-মেঘের মতোই উত্কণ্ঠা আচ্ছন্ন করে রেখেছে রায় ভিলাকে। মাথার কাছে বসে, নিবেদিতার নিজের অনুবাদ করা বৌদ্ধ প্রার্থনাবাণী পাঠ করে শোনাচ্ছেন অবলা বসু। নিবেদিতার ক্ষীণ কণ্ঠ থেকে অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে এল... ‘The boat is sinking, still I shall see the sunrise.’ ‘নৌকা ডুবছে, কিন্তু, আমি সূর্য ওঠা দেখব।’
খুলে দেওয়া হল অক্সিজেনের নল। মাত্র ৪৪ বছর বয়সে পাহাড়ের কোলে ডুবল নিবেদিতার জীবন-তরণী। নিবেদিতার প্রয়াণের খবর ছড়িয়ে পড়তেই, রায়ভিলায় উপচে পড়ল মানুষের ভিড়। দার্জিলিং রেল স্টেশনের অনেকটা নীচে মুর্দাহাটি নামে একটি ছোট্ট জায়গায় রয়েছে একটি শ্মশান। সেখানেই তাঁর শেষকৃত্য হয়। পরে, সেখানেই তৈরি হয় স্মৃতি-মন্দির।
২০১৩ সালের মে মাসে রায় ভিলাকে রামকৃষ্ণ মিশনের হাতে তুলে দেওয়া হয়। ১০ জুলাই শুরু হয় সংস্কারের কাজ। ২০১৪ সালের ১২ জানুয়ারি নতুন করে দ্বারোদ্ঘাটন হয় বাড়িটির। এখন ওই বাড়িতে রামকৃষ্ণ মিশন নিবেদিতা এডুকেশনাল অ্যান্ড কালচারাল সেন্টার চালায় রামকৃষ্ণ মিশন। নিবেদিতার ব্যবহৃত বেশ কিছু সামগ্রী এখনও এখানেই রয়ে গিয়েছে।