ব্যক্তিত্ব

নজরুলের শেষ কয়েক বছর

আহ্নিক বসু Aug 29, 2020 at 8:26 am ব্যক্তিত্ব

জীবনের শেষ দু’ দশকেরও বেশি সময় নজরুল কাটিয়েছেন একেবারে জীবন্মৃত অবস্থায়। তাঁর সৃজনপ্রতিভা তো বটেই, বাকশক্তি বা বুদ্ধিবৃত্তিও একেবারে লোপ পেয়েছিল। সেই ১৯৫৩ সালেই ডাক্তাররা নিশ্চিত সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছিলেন - “বর্তমান অবস্থায় কোনো প্রকার সার্জারি করলে রোগীর জন্য তা হিতে বিপরীত হতে পারে। রোগী একরকম চিন্তাহীন, শান্ত, শিশুর মতন (childlike) অবস্থায় আছেন, তাকে সেভাবেই থাকতে দেয়া উচিত, কেন না এর চেয়ে ভালো কোনো অবস্থায় তাঁকে ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে না।” নজরুলের ঠিক কী রোগ হয়েছিল সে নিয়ে কিছু ধোঁয়াশা প্রচলিত। ১৯৫৩ তেই Dr. Hans Hoff-এর রিপোর্টে স্পষ্ট বলা হয়েছে, “রোগটি সম্ভবত GPI (General Paralysis of Insane) নয়, বেশ সম্ভব এটি এক ধরনের Pseudo- Paralytic Condition caused by Meningo- Vascular Syphilis। রোগ বর্তমানে এতদূর অগ্রসর হয়েছে যে সার্জারিতে কোনো প্রকার সুফল পাবার সম্ভাবনা নেই।” এই অবস্থায় নজরুল বেঁচে ছিলেন আরও তেইশ বছর।

১৯৭২ সালের ২৪ মে নজরুলের তিয়াত্তরতম জন্মদিনের ঠিক আগের দিন ভারত সরকারের বিশেষ অনুমতি নিয়ে বাংলাদেশ সরকার বিপুল সমারোহে কবিকে ঢাকায় নিয়ে যান। ততদিনে কবি সম্পূর্ণ বোধরহিত, কার্যত নিশ্চেতন। বিমানবন্দরে কয়েক লক্ষ অনুরাগীর প্রবল উচ্ছ্বাস, রাজকীয় সংবর্ধনা, বিলাসবহুল বাসভবন, স্বাচ্ছন্দ্যের সতর্ক আয়োজন - এসব কিছুই তিনি টের পাবার অবস্থায় ছিলেন না। ডঃ নুরুল ইসলাম, ডঃ ইউসুফ আলির মতো সে সময়ের ঢাকার শ্রেষ্ঠ চিকিৎসকদের নিয়ে গড়া চার সদস্যের একটি মেডিক্যাল বোর্ড নজরুলের স্বাস্থ্য বিষয়ে সদাসতর্ক ছিল। পরের বছর তাঁকে কলকাতায় ফিরিয়ে দেবার কথা ছিল। কিন্তু কোনও কারণে বাংলাদেশ সরকার সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার কথা ভাবেননি। ভারত সরকারও, বাংলাদেশে কবিকে নিয়ে এই অভূতপূর্ব উন্মাদনা ও সম্মান দেখেই বোধহয়, এ বিষয়ে চাপ সৃষ্টি করেননি। কবির পরিবারের পক্ষ থেকেও এমন কোনও দাবি আসেনি। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে তাঁকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হয় এবং ২১ ফেব্রুয়ারি তাঁকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। 

আরও পড়ূন


জর্জ ইস্টম্যান : যাঁর হাত ধরে শুরু হয়েছিল বিখ্যাত কোডাক কোম্পানি


বাংলাদেশের রাষ্ট্রিক পরিস্থিতি তখন গিরগিটির চেয়েও দ্রুত রং বদলাচ্ছিল। শুরু থেকেই আগ্নেয়গিরির চূড়ায় বসে ছিল স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ। সেনাবাহিনীর একাংশের ক্ষমতার লোভ আর পাক- সমর্থনের চোরাস্রোতের সঙ্গে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র মিলেমিশে চূড়ান্ত অশান্ত করে রেখেছিল বাংলাদেশের রাজনীতিকে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিব আর তাঁর পরিবারকে গুপ্তঘাতকেরা রাতের অন্ধকারে হত্যা করার পর জিয়াউর রহমানের সন্ত্রাসের শাসন শুরু হয়, আর একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে যায় কবির ভাগ্যলিপিও। অসুস্থতার দোহাই তুলে কবিকে হঠাৎ স্থানান্তরিত করা হয় সরকারি হাসপাতালে। শোনা যায়, অসুস্থতার সেরকম কোনও লক্ষণ নাকি সেবক ও পরিচর্যাকারীদের চোখে ধরা পড়েনি। জড়বৎ মানুষটিকে হাসপাতালের অপরিসর কেবিনে এনে সিল করে দেওয়া হয় তাঁর সরকারি বাসভবনটিকে। আচমকা এই অভ্যেস-বদলে নজরুলের শারীরিক বিপর্যয় অনেকটা বেড়ে যায়। চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে থাকলেও ক্রমশ অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে । এক বছর ওভাবেই তিনি হাসপাতালে ছিলেন। তারপর জীর্ণ শরীরটাকে আক্রমণ করে জ্বর ও নিউমোনিয়ার মতো সংক্রমণ। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট রবিবার, সকাল দশটা দশ মিনিটে কবির জীবন্মৃত দেহটিকে এসে অধিকার করে নেয় মৃত্যু। 

বেঁচে থাকতে জিয়াউর- সরকার ফিরে তাকায়নি। কিন্তু কবির মরদেহকে রাষ্ট্রীয় সম্মান জ্ঞাপনে আড়ম্বরের ত্রুটি রাখা হল না। কবিকে ঘিরে লক্ষ লক্ষ অনুরাগীর আবেগকে নিজেদের অনুকূলে ব্যবহার করে নেবার সুযোগ ছাড়লেন না রাষ্ট্রনেতারা। তাঁকে তাঁর জন্মভূমি বা জন্মভিটেয় ফিরিয়ে দেবার কথা ভাবার প্রয়োজনবোধই করল না বাংলাদেশ সরকার। নজরুল- পত্নী প্রমীলাদেবীর শেষ ইচ্ছে ছিল, কবির সমাধির পাশে যেন তাঁকে কবর দেওয়া হয়। এই ইচ্ছা রাখতে প্রমীলাদেবীকে চুরুলিয়ায় কবর দেওয়া হয়েছিল এবং তাঁর পাশে কবির কবরের জন্য নির্দিষ্ট স্থান ছেড়ে রাখা হয়েছিল। কিন্তু প্রমীলাদেবীর সে ইচ্ছা পূরণ হয়নি। বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনারের অফিস থেকে নজরুলের প্রয়াণের খবর পেয়ে তাঁর পুত্র কাজী সব্যসাচী ও পুত্রবধূ কল্যাণীদেবী ঢাকায় আসার জন্য প্রস্তুত হন, কিন্তু বিমান ছাড়তে অস্বাভাবিক দেরি হয়। তাঁদের পৌঁছানোর আগেই কবির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শেষ হয়ে যায়। সস্ত্রীক সব্যসাচী যখন ঢাকা বিমানবন্দরে পা রাখেন, ততক্ষণে নজরুলের শবাধারের ওপর মাটি পড়ে গেছে। সেখানে পৌঁছে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি তীব্র ক্ষোভ উগরে দেন ক্রুদ্ধ, শোকার্ত সব্যসাচী। তারপর কবরের মাটি নিয়ে ফিরে আসেন কলকাতায়। মায়ের কবরের পাশে রাখার ব্যবস্থা করেন সেই মাটি। 

জীবিত অবস্থায় বহু মানুষ, বহু প্রতিষ্ঠান নজরুলকে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির কাজে ব্যবহার করেছে। মৃত্যুর দিনেও স্থূল হাতে ব্যবহৃত হবার অভিশাপ থেকে কবি মুক্তি পেলেন না। উপরন্তু জীবনের শেষ একটা বছর রাজনৈতিক পাকেচক্রে লাঞ্ছিত হতে হয় তাঁর চেতনাহীন জীর্ণ শরীরটিকে। সেই অপমান গায়ে মেখেই কবি চিরনিদ্রায় শুয়ে আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণের মসজিদ-সংলগ্ন কবরস্থানে। আমাদের সম্বল শুধু অন্নদাশঙ্কর রায়ের কবিতার অসহায় বিষণ্ণতা - 

“কেউ জানল না ইতিহাসে ফের

      ভুল হয়ে গেল বিলকুল

এতকাল পরে ধর্মের নামে 

     ভাগ হয়ে গেল নজরুল।”



ঋণ : ১) অরুণকুমার বসু/ নজরুল জীবনী/ আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা।

     ২) ডঃ গৌতম দত্ত/ নজরুলের চিকিৎসা/ নজরুল ইন্সটিটিউট, ঢাকা।   

#নজরুল ইসলাম #স্মরণ #নজরুলের মৃত্যু #ফিচার #শ্রদ্ধাঞ্জলি #আহ্নিক বসু

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

9

Unique Visitors

215870