দিন ও লিপি
..............................................
প্রথম কিস্তি
.....................................
আশ্বিনে যারা জন্মায় তাদের জন্মদিনের গায়ে কদম ফুলের গন্ধ। শিউলি ছড়িয়ে রাখে বিষণ্ণ শরৎ। আশ্বিনে যারা জন্মায় তারা অকালবোধনের সঙ্গে খানিকটা অকাল-বিসর্জনও নিয়ে আসে।
আমার বয়সের পায়ে শিকল পরানো। সাতাশের বাইরে কোনোদিন যাবে না। অথচ এই সাতাশিয়া মনের আছে বন্ধকি কারবার। মানুষ তাদের গল্প দিয়ে যায় আমায়। সুদে বেড়ে ওঠে অন্ধকার। আসলের পাত্তা মেলে না।
জন্মদিন বললেই আমার জন্মদিনের গল্প মনে পড়ে। নিজের নয় অবশ্যই। কিছু মানুষ। যারা একসময় কাছে ছিল। কিছু মানুষ। যাদের ভেলা ভেসে গেছে দূর গাঙুড়ে।
আমার এক বন্ধুর জন্মদিনে তার বান্ধবী ঠোঁটে ফুল এঁকে দিত। আর ঠিক সেই সময়েই নাকি সমস্ত ক্লাসরুম ভরে উঠত কদমগন্ধে। এখন কদমের গন্ধ পেলেই তার জন্মদিনের কথা মনে হয়। সেসমস্ত জন্মদিন ক্ষণস্থায়ী শরৎ। মেঘের ভেলা হয়ে ভেসে গেছে রামগিরি পাহাড়ের চূড়ায়।
আরেক বন্ধুর জন্মদিনে দূর সম্পর্কের ফোন আসত। বেশি কথা নয়। শুধু জন্মদিনের শুভেচ্ছা। এইটুকুই। বছরে একবার। কোন দূর ইস্কুলবয়স ভালোবেসেছিল গোধূলি-কিশোরীকে। এবং যা হয়। গোধূলির রংখানি মুছে গেছে কবে। সম্বৎসরের সংকোচকুয়াশা বছরে একবারের জন্য পাতলা হয়। ভেসে ওঠে সেই ইস্কুলবয়স আর গোধূলি-কিশোরীর মুখ। জীবন তাদের নিয়ে এসেছে সাতসমুদ্র তেরো নদীর পার। জন্মদিনের ওই একটা ফোন তাদের সময়যান। বড়জোর দু' মিনিট। তার মধ্যেই ফেলে আসা বয়স উড়ে আসে হঠাৎ হাওয়ায়। চলেও যায়। সেই হাওয়ায় কি কদমের গন্ধ থাকে?
আসলে সমস্ত মানুষের জন্মদিনের একটা নিভৃত উদযাপন থাকে। সমস্ত মানুষের থাকে একটা নিজস্ব শরৎ। একটা একলা চলার রাস্তা। শিউলি বিছানো।
আমার আরেক বন্ধুর জন্মদিন কাটত নির্জন ক্যাফেতে। যার সঙ্গে কাটত, তার সঙ্গে ছেলেটির বয়সের ফারাক অন্তত পাঁচ বছর। যে বিবাহিত। এবং কোনও ধর্ম না মানলেও তার ধর্ম ভারতের সংখ্যাগুরুর ধর্ম নয়। নানা জায়গায় লড়াই করে ক্লান্ত সেই লিলিথ অথবা নন্দিনী এসে বসতো তার থেকে বেশ খানিক ছোট কিশোরের পাশে। তার জন্মদিনে। দুজন ভুল সময়ে জন্মানো, ভুল সময়ে আলাপ হওয়া মানুষ। ওদের পছন্দ-অপছন্দ, ভালোলাগা-মন্দলাগা এতটাই এক যে অবাক লাগে! এবং অবাক লাগে না তাদের পারস্পরিক ভালোলাগাটুকুকে। সেটাই যেন স্বাভাবিক। সেটাই যেন হওয়ার ছিল। কিন্তু হয়নি। জন্মদিনের নির্জন ক্যাফেতে কিশোরের আনা গোলাপ হয়ে উঠত রক্তকরবী। সঙ্গে ক্যাডবেরি। চিনি ছাড়া কফি। অল্প কথা। সেসব বড়ো সংসারী নয়। সেসব কথার সত্যি বলতে কোনও মানে নেই। যেমন মেয়েটির কিশোরী ইচ্ছে, প্যারিসে থাকার। ছবি আঁকার। সেসব হয়নি জীবনে। সেসব হয় না। ফিরতি পথ কোল্ডড্রিংক্সের বোতলে মিশিয়ে নেয় ভদকা। 'ওলা'-র বাইরের কলকাতা বৃষ্টি হয়ে ওঠে। নিয়ন সাজিয়ে রাখে আলপনা। আমার বন্ধুটি পালিয়ে যায় জন্মদিনের থেকে।
জন্মদিন বললেই এইসব বন্ধুর কথা মনে হয়। তাদের বন্ধক রাখা গল্পে আঁকিবুকি কাটি। বাইরে শরতের বৃষ্টি। ভেজা শিউলির মৃতদেহ। জন্মদিন বললেই।
[কভার ছবি : ঐন্দ্রিলা চন্দ্র]
#series #বিবস্বান দত্ত #মুক্তগদ্য #জন্মদিন