অনুবাদ

জোঁক

ঋজু গাঙ্গুলী Nov 1, 2020 at 9:35 am অনুবাদ

মূল কাহিনী : নেগোশিয়াম পেরামবুলান্স
লেখক : ই.এফ.বেনসন

প্রথম কিস্তি

ধরুন আপনি পশ্চিম কর্নওয়ালে বেড়াতে গেছেন। সেক্ষেত্রে, পেনজ্যান্স আর ল্যান্ডস এন্ডের মাঝের ন্যাড়া আর উঁচু জায়গাটা পেরোনোর সময় রোদে পুড়ে, জলে ভিজে বিবর্ণ হয়ে যাওয়া একটা নোটিসবোর্ড আপনার নজরে পড়তেও পারে। তাতে লেখা আছে, ‘পোলার্ন ২ মাইল।’ তখন আপনি গাইড বুক খুলবেন। সেখান থেকে জানবেন যে ওটা একটা মাছ-ধরা গ্রাম। দ্রষ্টব্য বলতে গির্জার রেলিং হিসেবে ব্যবহৃত কিছু কাঠখোদাই আর নকশা — যারা আদতে আরও পুরোনো একটা গির্জার অংশ ছিল। সেখানেই আপনি পড়বেন যে সেন্ট ক্রিডের গির্জাতেও সেই সময়ের নকশা আর স্থাপত্য দেখা যায়— বরং আরও ভালোভাবে সংরক্ষিত আকারে। এরপর আর কে ওখানে যাবে?


তাও ধরুন আপনি যেতে চাইলেন। একটু এগিয়েই বুঝবেন যে খানাখন্দে ভরা ওই সরু রাস্তায় যাতায়াত করে হাঁটু বা সাইকেলের, বা দুটোরই বারোটা বাজবে। তারপর আপনার বাকি ছুটিটার কী হবে?


তাই, একেবারে উত্তুঙ্গ টুরিস্ট সিজনেও পোলার্নে কেউ যায়-টায় না। বাকি সময়ের কথা তো বলাই বাহুল্য। এমনকি পোস্টম্যান অবধি রেজিস্টার্ড চিঠি বা বড়ো পার্সেল গোছের কিছু না এলে ওই গ্রামে যায় না, বরং রাস্তার কাছেই রাখা একটা বড়ো বাক্সে সব চিঠিচাপাটি ফেলে দেয়।


জেলেরা মাছ ধরে সমুদ্রপথেই জেটিতে যায়। সেখানে মাছ বেচার পর ফিরে আসে তাদের ফাঁকা ট্রলারগুলো।


কেউ আসে না পোলার্নে। সেখান থেকেও কেউ কোত্থাও যায় না। এতটা বিচ্ছিন্ন থাকলে যেকোনও জায়গার বাসিন্দাদের মধ্যেই একটা তীব্র স্বাধীনচেতা, বা আরও সহজ ভাষায় বললে একলষেঁড়ে মনোভাব তৈরি হতে বাধ্য। কিন্তু পোলার্নের বাসিন্দারা নিজেদের মধ্যে বেশ ভালোভাবেই মানিয়ে-গুছিয়ে নিত। মনে হত, ঝড় আর বৃষ্টি, রোদ আর হাওয়া যেন আলাদা মন্ত্রগান শুনিয়ে তাদের একসূত্রে বেঁধে রেখেছে। মানুষের ক্ষুদ্র-তুচ্ছ ওঠাপড়ার চেয়েও অনেক বড়, অনেক দুর্জ্ঞেয় কোনও শক্তির অস্তিত্ব যেন তারা সবাই জানে।


দশ বছর বয়সে আমার ফুসফুসের সমস্যা ধরা পড়েছিল। এমনিতেই রোগে ভুগে কঙ্কালসার হয়ে গেছিলাম। তার ওপর এই অবস্থা হওয়াতে বড়রা ঠিক করেছিলেন, আমাকে লন্ডন থেকে দূরে এমন কোথাও পাঠিয়ে দেবেন যেখানে বিশুদ্ধ হাওয়া আর যত্ন— দুটোই জুটবে। আমার পিসেমশাই রিচার্ড বোলিথো ছিলেন পোলার্নের ভাইকার। তিনি ওখানে একটা ছোট্ট বাড়ি কিনে সেখানেই থাকতেন। ভিকারেজটা তিনি জন ইভান্স নামের এক শিল্পীকে ভাড়া দিয়েছিলেন।


রিচার্ডের বাড়ির একপাশে পাথরের দেওয়াল আর ছাদ দিয়ে বানানো একটা ঘর ছিল। ওটাই আমার জন্য বরাদ্দ হয়েছিল। আমি ওতে দিনের ক-ঘণ্টা কাটাতাম বলা মুশকিল। আসলে লন্ডনের ওই ধূসর বাদামি আকাশ, ধোঁয়া আর বদ্ধ পরিবেশের পর এমন একটা জায়গায় এসে আর ঘরবন্দি থাকতে ইচ্ছে হত না। সারাদিন আমি ঘুরে বেড়াতাম পাহাড়ের ঢালে, সমুদ্রের ধারে, ঘাসফুলের ভিড়ে আর জেটিতে। কোনোরকম নিষেধাজ্ঞাই ছিল না আমার ওপর। শুধু দুটো জিনিস একটু অন্যরকম ছিল।


আমার রোজকার পড়াশোনা নিয়ে খুব একটা চাপ ছিল না। বাগানে হাঁটতে-হাঁটতে রিচার্ড আমাকে ল্যাটিন ব্যাকরণ আর সাহিত্য বোঝাতেন। তাঁর পড়ানোর ভঙ্গিটাই এমন ছিল যে আমার বুঝতে আর মনে রাখতে বিন্দুমাত্র অসুবিধে হত না। তারই সঙ্গে তিনি আমাকে ফুল, পাখি, গাছ— এগুলো চেনাতেন, তারপর সেগুলোর বর্ণনা দিতে বলতেন। জটিলতম বিষয়কেও সহজে আর যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করার শিক্ষাটা আমি রিচার্ডের কাছেই পেয়েছিলাম।


তবে রোববার, চার্চের বেদিতে দাঁড়ানো অবস্থায় এই মানুষটির এক অন্য রূপ দেখতাম।


ক্যালভিনিজম আর মিস্টিসিজমের কোন গোপন আগুন এই মানুষটির ভেতরে ছিল, জানি না। তবে অনুশোচনাহীন পাপীদের পরিণতি নিয়ে তাঁর সেই ভয়াবহ বক্তৃতামালা আমাকে ক্ষতবিক্ষত করে দিত। এমনকি সন্ধেবেলায়, যখন ছোটরা আসত তাঁর কথা শুনতে, তখনও রিচার্ডের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসত সেই কালো আগুনের এক-আধটা ফুলকি। সেখানেই তিনি বলেছিলেন, “দেবদূতেরা শিশুদের রক্ষা করেন ঠিকই। কিন্তু সেই শিশু যদি এমন কিছু করে যাতে দেবদূত বিরূপ হন, তাহলে ভয়ংকর বিপদ হবে। দেখা আর অদেখা এমন সব বিপদ আমাদের ঘিরে থাকে, যাদের হাতে পড়লে শিশু থেকে বৃদ্ধ — সবারই পরিণতি হয় অবর্ণননীয়!”


এই কথাগুলো বলার সময় রিচার্ড সেই পুরোনো কাঠখোদাই আর নকশাগুলোর দিকে ইঙ্গিত করতেন, যাদের কথা আমি প্রথমেই বলেছিলাম। সেগুলো খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে বুঝেছিলাম, মোট চারটে প্যানেল আছে তাতে। প্রথমটা নিরীহগোছের— দেবদূত গ্যাব্রিয়েল কুমারী মেরিকে জানাচ্ছেন যে তাঁর গর্ভে জন্ম নিতে চলেছেন ঈশ্বরের সন্তান, অর্থাৎ যিশু। দ্বিতীয়টাও বেশ সম্ভ্রান্ত— আর্কেঞ্জেল মাইকেল যিশুর দেহ কাঁধে বহন করছেন পুনরুজ্জীবনের ঠিক আগে। তৃতীয়টা দেখিয়েছে এন্ডরের উইচকে— মানে যে মহিলার পরামর্শ অনুযায়ী সল স্যামুয়েলের কাছ থেকে ফিলিস্তিনদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য পরামর্শ নিয়েছিলেন।


চতুর্থ প্যানেলটাই গোলমেলে ছিল। ওটা ব্যাখ্যা করার সময় রিচার্ড বেদি থেকে নেমে আসতেন আর আঙুল তুলে-তুলে জিনিসটা দেখাতেন।


ওতে দেখানো জায়গাটা হুবহু পোলার্নের চার্চের সামনের চাতালের মতো। চার্চের গেটে আলখাল্লা-পরা এক পুরোহিত দাঁড়িয়ে ছিলেন। একটা ক্রশ তুলে ধরে একটা বিশাল জোঁকের মতো জিনিসকে ঠেকাতে চাইছিলেন তিনি!


একটা জোঁক যে কতটা ভয়াল হতে পারত, তা ওই প্যানেলটা না দেখলে কখনোই বুঝতাম না। তারই সঙ্গে চলতে থাকত রিচার্ডের ধারাবিবরণী। জিনিসটার নিচে লেখা ‘নেগোশিয়াম পেরামবুলান্স ইন টেনেব্রিস’ কথাটা ব্যাখ্যা করে দিতেন তিনি — সেই ব্যাধি, যা অন্ধকারে থাকে। “এ ব্যাধি শরীরের কম, কিন্তু মনের বেশি!” গর্জন করতেন রিচার্ড, “যা কিছু অশুভ, যা কিছু কদর্য — তার সঙ্গে লেনদেন করে এই প্রাণী। ঈশ্বর যাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন, তাদের শেষ করে দেয় এ।”


আমার সমবয়সী ছেলেরা এগুলো শুনে চোখ চাওয়াচাওয়ি আর ফিসফিস করছিল। মনে হয়েছিল, তারা এই ভাবনা আর তর্জনগর্জনের পেছনের ঘটনা বা কিংবদন্তিটা জানে। তাদের থেকে যে গল্পটা উদ্ধার করেছিলাম, সেটা ছিল এইরকম।

যে চার্চে দাঁড়িয়ে রিচার্ড আমাদের ভয় দেখাতেন, সেখান থেকে বড়োজোর তিনশো গজ দূরেই একটা বহু প্রাচীন ও পরিত্যক্ত চার্চ ছিল। পরে জমির সঙ্গে সেই পরিত্যক্ত বাড়িটাও কিনেছিলেন লন্ডন থেকে আসা এক ভদ্রলোক। চার্চ ভেঙে তার পাথরগুলো দিয়ে তিনি নিজের বাড়ি বানিয়েছিলেন। শুধু ওই প্যানেলটা তিনি রেখে দিয়েছিলেন নিজের ঘরে। তার ওপরেই তিনি মদের বোতল রাখতেন, জুয়া খেলতেন, আরও নানাবিধ অপকম্মো করতেন। তবে যত দিন গেল, ভদ্রলোকের সাহসের ভাঁড়ারে ঘাটতি দেখা দিল। সবসময় বাড়ির সবকটা আলো জ্বালিয়ে রাখতেন তিনি। কেন? উত্তরটা তিনি কাউকে বলেননি। তবু সবাই জানতে পারল একদিন।


সেদিন ভয়ংকর ঝড় উঠেছিল। সমুদ্র থেকে ধেয়ে আসা হাওয়া আর জলের ঝাপটা নিভিয়ে দিয়েছিল বাড়ির আলোগুলো। তৎক্ষণাৎ সেই ভদ্রলোকের মর্মভেদী আর্তনাদে মুখরিত হয়েছিল পোলার্ন! আলো জ্বালিয়ে চাকর-বাকরদের ছুটে আসতে কিছুটা সময় লেগেছিল। তারা এসে দেখেছিল…


বিপুলদেহী ভদ্রলোকের শরীরটা একটা নেতানো বস্তার মতো ফাঁপা হয়ে মাটিতে পড়ে আছে। তাঁর গলার কাছটা ফাঁক হয়ে মাটিতে গড়াচ্ছে রক্ত।


আর মানুষটির শরীর থেকে দূরে সরে গিয়ে অন্ধকারে মিশে যাচ্ছে একটা প্রকাণ্ড জোঁকের মতো কিছু!


- “ভদ্রলোক মারা যাওয়ার আগে ল্যাটিনে কিছু একটা বলেছিলেন।” বক্তাদের একজন নাক চুলকে বলেছিল, “সেটা ঠিক…”

- “নেগোশিয়াম পেরামবুলান্স ইন টেনেব্রিস?” আমি মনে করানোর চেষ্টা করেছিলাম।

- “হতে পারে।”

- “তারপর কী হয়েছিল?”

- “কেউ আর ওদিকে যেতই না। ভদ্রলোকের বাড়িটা রোদে-জলে পড়ে নষ্টই হচ্ছিল। তিন বছর আগে পেঞ্জ্যান্স থেকে মিস্টার ডুলিস এসে বাড়িটা কিনে নিয়েছেন। তারপর সেটাকে মেরামতও করেছেন। তবে উনি বোধহয় জোঁক বা অন্য কিছুতে ভয় পান না। রোজ সন্ধেবেলা পুরো একবোতল হুইস্কি ফাঁকা করার পর তিনি ঠিক কী বোঝেন বা ভাবেন— তা তিনিই জানবেন।”


এরপর থেকে মিস্টার ডুলিস আমার পোলার্ন-বাসের ফোকাস হয়ে গেলেন। ভদ্রলোকের ওপর যথাসাধ্য নজরদারি করতাম। অপেক্ষা করতাম, কখন তিনি আর্তনাদ করে উঠবেন, আর আমিও দেখতে পাব সেই ভয়াল ভয়ংকর জোঁককে— যে অন্ধকারে থাকে! কিন্তু তেমন কিছুই হয়নি। মিস্টার ডুলিস নিজের মতো থাকতেন। গেঁটে বাত না লিভার— কোনটা তাঁকে আগে কাত করবে, সেটা নিয়েই ভাবনা হত। ডুলিস চার্চে যেতেন না, রিচার্ড বা আমাদের মতো কাউকে আপ্যায়নও করতেন না। ফলে একটু-একটু করে পুরো ব্যাপারটাই আমি ভুলে যেতে শুরু করি।


(ক্রমশ…) 



[মূল কাহিনি: ‘নেগোশিয়াম পেরামবুলান্স’, লেখক: ই.এফ.বেনসন, প্রথম প্রকাশ: হাচিনসনস্‌ ম্যাগাজিন, নভেম্বর ১৯২২] 



#বাংলা #অনুবাদ #SILLY পয়েন্ট #Negotium Perambulate #E F Benson #British Writer

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

67

Unique Visitors

216152