অনুবাদ

জোঁক (দ্বিতীয় কিস্তি)

ঋজু গাঙ্গুলী Nov 7, 2020 at 3:48 am অনুবাদ

মূল কাহিনী : নেগোশিয়াম পেরামবুলান্স
লেখক : ই.এফ.বেনসন

(গত কিস্তির পর) 

তিন বছর রোদ, জল আর হাওয়ার মধ্যে থেকে আমার চেহারা আর মন-মেজাজে আমূল পরিবর্তন এসেছিল। পোলার্নের পাট চুকিয়ে আমি লন্ডনে ফিরে এলাম। তারপর এল ইটন আর কেমব্রিজ-এর পালা। সে-সবের পর ব্যারিস্টার হিসেবে আমি যা রোজগার করতে শুরু করলাম তা প্রায় ঈর্ষণীয়। কিন্তু সবকিছুর মধ্যেও আমার একটাই কথা মনে হত।  


আমাকে পোলার্নে ফিরে যেতে হবে।


দু-দশক পর বুঝতে পারলাম, আর আমার রোজগার করার দরকার নেই। সঞ্চয় আর নানা ধরনের বিনিয়োগের মাধ্যমে আমি যে ব্যবস্থা করেছি তাতে প্রতি মাসে আমার হাতে বেশ ভালো টাকাই আসবে। আমি বিয়ে করিনি, কারণ তেমন ইচ্ছেই হয়নি। ব্যারিস্টার হিসেবে বিশাল কিছু একটা হওয়ার মতো উচ্চাকাঙ্ক্ষাও আমার ছিল না। তাই লন্ডনের ওই ব্যস্ততা আর মালিন্যে ভরা জীবনের বদলে খোলা আকাশ, সমুদ্রের নোনা লে রোদের ঝিকমিক আর হু-হু হাওয়া আমাকে টানছিল। পাথর দিয়ে বাঁধানো রাস্তার বদলে ঘাসফুলে ছাওয়া পাহাড়ি পথে ছুটতে ইচ্ছে হচ্ছিল।


রিচার্ডের সঙ্গে চিঠিতে যোগাযোগ বজায় রেখেছিলাম পোলার্ন থেকে চলে আসার পরেও। তাঁর মৃত্যুর পর ওখানে গিয়ে পিসি হেস্টারের সঙ্গে দেখা করতে খুব ইচ্ছে হয়েছিল। কিন্তু আমি যাইনি। আসলে ওখানে গেলে যে আর ফিরতে পারব না— এমন একটা দৃঢ় বিশ্বাস আমার ছিল। তাই শেষ অবধি লন্ডনের পাট চোকানোর সিদ্ধান্ত নিয়েই আমি পিসিকে সেই বিষয়ে জানালাম।  


পিসির সোৎসাহ উত্তর এসে পৌঁছোল কদিন পরেই। তিনি লিখেছিলেন, “নিজের জন্য একটা পছন্দসই বাড়ি না কেনা অবধি আমার সঙ্গেই থেকো। বোলিথো হাউজ এমনিতেও আমার একার পক্ষে বড্ড বড়, বড্ড ফাঁকা।”


রাজি হয়ে গেলাম। জুন মাসের এক সন্ধ্যায় পোলার্ন যাওয়ার হাঁটাপথ ধরে গ্রামে ঢোকার সময় বুঝতে পারলাম, জায়গাটা এই তিন দশকেও তেমন বদলায়নি। ছোটবেলার চেনাজানা জায়গাগুলো বড়ো হওয়ার পর ছোট লাগে, কিন্তু তেমন কিছুও মনে হচ্ছিল না। সবচেয়ে বড় কথা, ‘সবার থেকে আলাদা’ ভাবটা অটুট ছিল পোলার্নের আকাশে-বাতাসে। হাঁটতে-হাঁটতে মনে হচ্ছিল, লন্ডনের সেই আইন-আদালত আর অন্য সব মারপ্যাঁচ মুছে যাচ্ছে স্মৃতি থেকে। সবটা ভরাট করে দিচ্ছে হাওয়া আর সমুদ্রের গর্জন। 


পোলার্ন বদলায়নি। হেস্টার, মানে আমার পিসিও দেখলাম তেমন বদলাননি। তিন দশক লন্ডনে থাকলে লোকজন একেবারে বেঁকে যায়। এই মহিলা কিন্তু বুড়িয়ে যাননি। বরং একটা অদ্ভুত ব্যক্তিত্ব আর লাবণ্য ফুটে উঠেছিল ওঁর চেহারায় আর আচরণে। খাওয়া-দাওয়া সেরে গল্প করছিলাম আমরা। হেস্টারের ঝলমলে আকাশের মতো মুখটায় একফালি মেঘ জমল, যখন আমি মিস্টার ডুলিসের ব্যাপারে জানতে চাইলাম। 


“ডুলিসের মারা যাওয়ার পর দশ বছরেরও বেশি হয়ে গেছে।” কফির কাপটা সরিয়ে রেখে বলেছিলেন হেস্টার, “মানুষটি নিউলিন থেকে এখানে আসার আগেও অনেক অপকর্ম করেছিল। এমনকি এখানেও তুমি তো দেখেইছিলে। মদ খাওয়া আর সবার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার— এই দুটো দিয়েই ডুলিসকে চিনে নেওয়া যেত। তোমার পিসে বলতেন, ওর কপালে দুঃখ আছে। কথাটা সত্যি বলে প্রমাণিত হয়েছিল আর কি।”

-“কিন্তু ঠিক কী হয়েছিল?”

-“চার্চে নানা কথা বলতে-বলতে তোমার পিসে বেদি থেকে নেমে আসতেন। তারপর রেলিঙে লাগানো কাঠখোদাই আর নকশাগুলো, বিশেষ করে চার নম্বর ফ্রেমটা দেখাতেন। মনে আছে তোমার?”

-“বিলক্ষণ।”

-“ওই বিশাল জোঁকের মতো জিনিসটা যে দেখেছে, সেই ভোলেনি। যাইহোক, ওটার কথা তুলে তোমার পিসে যে ভাষণগুলো দিতেন, ডুলিস সেগুলো শুনেছিল। তারপর থেকেই দেখতাম, সন্ধে হলেই ওর বাড়ির সবকটা আলো জ্বলে। এই করতে-করতে ওর ভয় কমার বদলে বেড়েই যাচ্ছিল। তারপরেই কেলেংকারি হল।”

-“কেলেংকারি!”

-“হ্যাঁ। মদ খেয়ে একেবারে চুর অবস্থায় ডুলিস চার্চের দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে ওই প্যানেলটা ভেঙে চুরমার করল।”

-“সে কী! অত পুরোনো প্যানেলটা এইভাবে…?”

-“সকালবেলা চার্চে ঢোকার পর ওই অবস্থা দেখে তোমার পিসে দারুণ রেগে গেছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন, এটা কার কাজ। ডুলিসের বাড়িতে গিয়ে লোকটাকে চেপে ধরতে লোকটা বলেওছিল, ‘হ্যাঁ, আমিই ভেঙেছি ওই জিনিসটাকে। বেশ করেছি। ওটাই ছিল যত কুসংস্কারের ডিপো। জানি, ওটা দেখিয়েই তুমি যতরাজ্যের হাবিজাবি বকতে। সেটাও গেল তো। বেশ হয়েছে!’

তোমার পিসে ঠিক করেছিলেন, সোজা পেনজ্যান্সে গিয়ে পুলিশে অভিযোগ করবেন এই ব্যাপারে। কিন্তু চার্চে ঢুকে তিনি দারুণ চমকে গেছিলেন।”

-“কেন?”

-“প্যানেলটা একেবারে অক্ষত অবস্থায় জায়গামতো রাখা ছিল। এটা মোটামুটি স্পষ্ট হয়ে গেছিল যে পুলিশ, এমনকি চার্চের থেকেও বড় আর ক্ষমতাধর কেউ বা কিছু এই ব্যাপারটায় হস্তক্ষেপ করেছে।”

-“উনি ভুল দেখেননি তো?” আমি জিজ্ঞেস করতে বাধ্য হলাম, “মানে ব্যাপারটা এতই অবিশ্বাস্য…!”

-“লন্ডনের মানুষের পক্ষে এটা মেনে নেওয়া একটু শক্তই।” হেস্টার হাসলেন, “তবে সেই রাতেই ঘটনাটা ঘটল। শুতে যাওয়ার সময়েও দেখেছিলাম, ডুলিসের বাড়ির সবকটা আলো জ্বলছে। রাতে একটা চিৎকার শুনে ঘুম ভাঙল। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই দেখলাম, ওর বাড়িটা একদম অন্ধকার। তারপরেই দেখলাম, রাস্তাটা দিয়ে টলতে-টলতে কেউ ছুটছে আর প্রাণভয়ে আর্তনাদ করছে, ‘আলো! আমাকে কেউ একটু আলো দাও!’

আমি তোমার পিসেকে তুললাম। তিনি আলো জ্বালিয়ে যতক্ষণে রাস্তায় নামলেন ততক্ষণে আরও বেশ ক’জন উঠে পড়েছিলেন। সবাই মিলে রাস্তা ধরে নেমে একেবারে জেটি অবধি চলে গেলেন। ওখানেই পাথরের ওপর পড়ে ছিল ডুলিস। ওর গলার নলিটা ফাঁক হয়ে গেছিল। শরীরটাও একেবারে শুকিয়ে গেছিল। তবে আশেপাশে কোথাও রক্ত দেখা যাচ্ছিল না।” 


হেস্টার আমার দিকে ঝুঁকে বললেন, “সরকারি রিপোর্টে পুরো ব্যাপারটা মাতলামি আর তার ফলে হওয়া দুর্ঘটনা বলেই দেখানো হয়েছিল। তবে আসল কারণটা বুঝতেই পারছ।” 

আরও পড়ুন : জোঁক (প্রথম কিস্তি) 

মাথা নাড়লেও এই নিয়ে কিছু বললাম না। জানতাম, যাই বলব তাকেই ‘লন্ডনের মানুষের’ ভাবনা বলে সাব্যস্ত করা হবে। তাই জিজ্ঞেস করলাম, 

-“ওই বাড়িতে এখন কেউ থাকে?”

-“থাকে।” হেস্টারের মুখটা অন্ধকার হয়ে এল,

-“একসময় আমাদেরই ভাড়াটে ছিল সে।”

-“জন ইভান্স?”

-“সেই। কী ভালোই না ছিল মানুষটা। আর সে এখন…” হেস্টার উঠে দাঁড়ালেন।

-“সে এখন? কথাটা এইরকম মাঝপথে ছাড়ছেন কেন?”

-“ওর কথা ও নিজেই শেষ করবে।” 


আলোটা জ্বালিয়ে হেস্টার বললেন, “রাত কিন্তু অনেক হল। এরপরেও আমরা জেগে থাকলে লোকে ভাববে, আমাদেরও বোধহয় সারারাত আলো জ্বালিয়ে রাখার অবস্থা হয়েছে।”


রাতে শোয়ার সময় ঘরের পর্দাগুলো সরিয়ে দিলাম। কুয়াশামাখা চালগুলো চাঁদের আলোয় চকচক করছিল। সমুদ্রের দিক থেকে ভেসে আসছিল হাওয়া আর মৃদু গর্জন। বাগান থেকে আসা মৃদু সুগন্ধ মিশে যাচ্ছিল সেই হাওয়ায়। মনে হল, পোলার্ন ফিরে আসার সিদ্ধান্তটা আরও আগেও নিতে পারতাম আমি।


আপনা থেকেই চোখ গেল ঢালের ওপরদিকে। গোটা গ্রাম অন্ধকার হয়ে থাকলেও একটা বাড়িতে সবকটা আলো তখনও জ্বলছিল!


ঘুম ভাঙার পর চোখ মেলতে ভয় করছিল। আশঙ্কা হচ্ছিল, দিনের আলোয় যদি পোলার্ন দেখে হতাশ হই? কিন্তু চোখ খুলে বুঝলাম, আমার ধারণাটা একেবারে অমূলক। শুধু তাই নয়, একেবারে আক্ষরিক অর্থে আমি ছোটবেলার সেই তিনটে বছরে ফিরে যেতে শুরু করলাম। পোলার্নের আকাশে-বাতাসে-মাটিতে একটা অন্যরকম শক্তির উপস্থিতি সেই সময় আবছাভাবে টের পেতাম। সেটা এখন একেবারে স্পষ্টভাবে ধরা দিল আমার কাছে। তাকে প্রাকৃতিক বা ঐশ্বরিক বলব না। বরং মনে হত, এখানে মানুষের মধ্যে থেকে দূষিত রক্তের মতো করে অসংযত জীবনযাপন বা অসদাচরণের প্রবণতা যেন শুষে নিচ্ছে কোনো অদৃশ্য জোঁক!


কদিনের মধ্যেই জন ইভান্সের সঙ্গে আমার মোলাকাত হল।


(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)  



[মূল কাহিনি: নেগোশিয়াম পেরামবুলান্স, লেখক: ই.এফ.বেনসন, প্রথম প্রকাশ: হাচিনসনস্‌ ম্যাগাজিন, নভেম্বর ১৯২২] 

#Negotium Perambulate #E F Benson #British Writer #Translation #অনুবাদ #ঋজু গাঙ্গুলী #সিলি পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

58

Unique Visitors

177645