ছোট্ট একটা ‘ক্লিক’!
অ্যালকেমির যুগ পেরিয়ে আধুনিক রসায়নের যুগ যখন থেকে শুরু হয়েছে, প্রায় সব রসায়নবিদেরই মূল চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে একজন – প্রকৃতি। অতি ক্ষুদ্র কোশ থেকে অতি বৃদ্ধ বটগাছ, প্রকৃতির ভাণ্ডারে সরলতম থেকে জটিলতম বিক্রিয়ার কোনও কমতি নেই। গবেষণাগারে ফ্লাস্ক আর টেস্ট টিউব নিয়ে গুঁতোগুঁতি করে আমরা প্রাকৃতিক রসায়নকে অনুসরণ করেই একের পর এক বিপ্লব ঘটিয়ে চলেছি মানবোন্নয়নের লক্ষ্যে। আলেক্সান্ডার ফ্লেমিং-এর আচমকা পেনিসিলিন আবিষ্কারের পথ ধরে আমরা পেয়েছি জীবাণুকে ধ্বংস করার কৌশল, আর সেই কৌশলের মূল সূত্রকে কাজে লাগিয়ে গবেষণাগারেও বানিয়ে ফেলছি কৃত্রিম জীবাণুনাশক। ২০২২ সালে রসায়নের নোবেল পুরস্কার মঞ্চ আলো করে দাঁড়িয়েছিলেন যে তিন বিজ্ঞানী – মর্টেন মেলডাল, ব্যারি শার্পলেস এবং ক্যারোলিন বার্তোজি – যাদের যৌথ গবেষণাকে বলা হচ্ছে রসায়ন জগতের নবজাগরণ, প্রকৃত অর্থে তা শুধু প্রাণরসায়নের মূল সুরটিকে ধরে ফেলা। যা কিছু প্রকৃতিতে ছিল, তাকেই অন্য চোখে দেখেছেন তাঁরা, আর এখানেও সাফল্য এসেছে আচমকা, ফ্লেমিং-এর মতোই।
শতকের পর শতক জুড়ে গবেষণায় রসায়ন যত সমৃদ্ধ হয়েছে, রসায়নবিদরা তত নতুন উৎসাহে সৃষ্টির খেলায় মেতেছেন। জন্ম নিয়েছে একের পর এক কার্যকরী যৌগ, তারা কাজেকর্মে যতটা জটিল, তার চাইতেও জটিল তাদের উৎপাদন প্রক্রিয়া। কাজেই টেস্ট টিউবে করা বিক্রিয়া যখন কারখানার গামলায় করার সময় আসে, তখন সময় এলেগে যায় বিস্তর। যে কোনও রাসায়নিক যৌগের প্রকৃতিজাত উৎপাদন সামান্য, তাকে প্রচুর পরিমাণে বানাতে হলে কিছু অদল-বদল করা আবশ্যিক। আর তার হাত ধরে আসে উপজাত দ্রব্যের ধাক্কা; মনমতো যৌগটি যদি বা পেলেন, উপজাত দ্রব্য সাফ করতে গিয়েই হয়ত কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা গচ্চা। তবে উপায়? সে উপায়েরই খোঁজ করছিলেন ব্যারি শার্পলেস যখন ২০০১ সালে তিনি তাঁর প্রথম নোবেল পুরস্কারটি পান। অবশ্য পুরস্কারের কথা যখন তিনি জানতেনও না তখন থেকেই তিনি বলতে শুরু করেছেন, প্রাকৃতিক যৌগের নকলনবিশির দিন শেষ, রসায়নকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে চাই এক্কেবারে নতুন কোনও রাস্তা, যা প্রকৃতির যেকোনও যৌগের জন্মের মূল সুরটিকে ধরবে। তবেই তা হবে সরল, তবেই কাজে লাগবে মানুষের। কেমনতর ব্যাপার সেটা? উদাহরণ হিসেবে ব্যারি বললেন কার্বন অণুর কথা। আমাদের জৈব এবং অজৈব দুই জগতের যতরকম উপাদান, সবকিছুর গা থেকে রকমারি খোলস খুলে নিলে পড়ে থাকে যে কঙ্কাল, তার ক্যালসিয়াম হল কার্বন অণু। পেট্রোলিয়াম থেকে পট্যাটো চিপস, সবকিছুর মূলে আছে কার্বন-কার্বন জোড়া একাধিক কাঠামো। প্রকৃতি এই কাঠামোগুলো তৈরি করে নিয়েছে বহু লক্ষ বছরের প্রক্রিয়ায়, আমরা চাইলেও কয়েক বছরে তাদের খোলনলচে বদলাতে পারি না। বিভিন্ন যৌগের কার্বন অণু একে অপরের সঙ্গে হাত ধরাধরি (যার পোশাকি নাম কেমিক্যাল বন্ডিং) করতে বড়োই উদাসীন, তাদের রাজি করানোর জন্য প্রয়োজনীয় শক্তির জোগান দিতেই আমরা অপারগ। ব্যারি বুদ্ধি দিলেন, এত খাটাখাটনি করে প্রকৃতির সমকক্ষ হতে চাওয়া কেন বাপু! তার চেয়ে একখানা এমন ছিমছাম যৌগ খুঁজে নাও না যার মধ্যে একখানা মানানসই কার্বন কাঠামো আছে। এবার তার মাথায়, ঘাড়ে চাপাতে থাকো অন্য সব সরল যৌগ, সে দুইয়ের সেতু হবে নাহয় অক্সিজেন আর নাইট্রোজেন। ওরাই কেন? কারণ কার্বন আর হাইড্রোজেনের পরে ওরাই আছে সর্বঘটে, সর্বজোটে। তাছাড়া এই দুই ভালোমানুষের পো অল্প সাধলেই বিক্রিয়া করতে রাজি হয়ে যায়। ব্যারির মতে, এইভাবে যদি প্রকৃতিতে পাওয়া কার্যকরী যৌগের নকল নাও করা যায়, যা তৈরি হবে তাতে ওই একই কাজ হবে। নিজের বক্তব্যের সমর্থনে একাধিক বিক্রিয়ার উদাহরণও দিয়েছিলেন তিনি, যদিও যে বিক্রিয়া তাঁর বাণীকে বাস্তব করবে তা তখন বাড়ছে ডেনমার্কের গোকুলে।
পাওলো কোয়েলহো থেকে শাহরুখ খান, সবাই বলেছেন যে মানুষ যখন কোনও কিছু মন থেকে চায় তখন পুরো দুনিয়া তাকে সেটা পাওয়ানোর জন্য উঠেপড়ে লাগে। কথাটা নির্যস সত্যি, নাহলে যে মর্টেন মেলডাল জীবনের অনেকটা সময় ব্যয় করলেন নতুন জাতের ফার্মাসিউটিক্যাল পেপটাইডের সন্ধানে, রাশি রাশি নতুন যৌগের সংগ্রহশালা বানিয়ে একের পর এক তাদের যাচাই করে গেলেন রোগজীবাণুর মোক্ষম দাওয়াই বের করার জন্য, সেই তাঁর ডেনমার্কের পরীক্ষাগারেই এমন কান্ড হল! একেবারে রোজকার পাতি একটা বিক্রিয়া করছিলেন মর্টেন ও তাঁর সহকর্মীরা – অ্যালকাইন ও অ্যাসাইল হ্যালাইড যৌগের সংযোগ। এই বিক্রিয়ায় সাধারণত অনুঘটক হিসেবে দেওয়া হয় সামান্য তামার আয়ন (Cu++) আর এক চিমটি প্যালাডিয়াম। কিন্তু সেদিন তামার পরিমাণে কিছু রদবদল হয়েছিল, যার ফলে গতানুগতিক বিক্রিয়ার বদলে ঘটল এক অদ্ভুত ব্যাপার – অ্যালকাইন-বাবাজি যৌগের একদিকে থাকা অ্যাসাইল হ্যালাইডের থেকে মুখ ঘুরিয়ে অন্য প্রান্তে থাকা অ্যাজাইডের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে বসে রইল! এর ফলে তৈরি হল এক এমন শৃঙ্খলাবদ্ধ কাঠামো, যার রাসায়নিক পরিচয় ট্রায়াজোল। যারা রসায়ন নিয়ে অল্পবিস্তর পড়েছেন তারা জানেন, এই ট্রায়াজোল এক অতি গুরুত্বপূর্ণ সরল যৌগ। ওষুধ, রং এমনকি কৃষিশিল্পেও এর ব্যবহার যথেচ্ছ, কারণ অন্যান্য যৌগ তৈরির একক হিসেবে দিব্যি কাজ করতে পারে সে। বিজ্ঞানীরা আগেও অ্যাজাইড আর অ্যালকাইন মিশিয়ে ট্রায়াজোল বানানোর চেষ্টা করেছেন, কিন্তু সে পথ খুব একটা মসৃণ হয়নি কখনোই। আঠেরো শতক থেকে বিষ শতক অবধি বহু বিজ্ঞানী চেষ্টা করেও কম শক্তি ব্যয়ে, সহজ পদ্ধতিতে এ কাজ করে উঠতে পারেননি। মেলডাল বুঝলেন, তামাই এখানে আসল কাজটা করেছে, তার ঘটকালিতেই এক অচেনা যুগলের প্রণয় ঘটেছে, জন্ম নিয়েছে বহু কাঙ্ক্ষিত ট্রায়াজোল। মেলডাল যেহেতু পেপটাইড নিয়ে বেশি উৎসাহী ছিলেন তাই একাজ গবেষণাপত্রে ছাপালেও পেপটাইডের কাজে না লাগানো অবধি বেশি মাথা ঘামাননি। অন্যদিকে ব্যারিও হাত গুটিয়ে বসে নেই। মেলডালের কাজের সঙ্গে তার বিন্দুমাত্র পরিচয় না থাকলেও ক্যালিফোর্নিয়ায় বসে একই সময়ে তিনি ওই একই বিক্রিয়া সম্পন্ন করেছেন, বিধিসম্মত ভাবে ফলাফল নথিবদ্ধ করে ছাপিয়েছেন ২০০২ সালে। ঠিক যেই বছর মর্টেন একই কাজে তাঁর গবেষণাপত্র ছাপিয়েছেন।
সমাপতন? হয়ত তাই, কিংবা হয়ত ব্রহ্মাণ্ডের চক্রান্ত! ব্যারি অ্যাজাইড অণুকে তুলনা করলেন একটা গুটিয়ে রাখা স্প্রিং-এর সঙ্গে, তামা যেন সেই স্প্রিং-এর বাঁধন খোলার শক্তি জোগাচ্ছে। একবার বাঁধনছাড়া হলেই সে লাফিয়ে বসে যাচ্ছে অ্যালকাইনের ঘাড়ে। যেহেতু এমন দ্রুত আর খাপে খাপ বিক্রিয়া, ব্যারি এর নাম দিলেন “ক্লিক কেমিস্ট্রি”। তিনিই প্রথম বললেন এই বিক্রিয়ার সুদূরপ্রসারী সম্ভাবনার কথা। এখন বিজ্ঞানীরা চাইলেই যেকোনও দুটো যৌগের মেলবন্ধন করতে পারেন, শুধু সবার আগে একজনের পিছনে অ্যালকাইন গ্রুপ আর আরেকজনের পিছনে অ্যাজাইড গ্রুপ জুড়ে দিলেই হল। বাস্তবে হলও তাই, রসায়নের গবেষণাগার থেকে কারখানা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল ক্লিক বিক্রিয়ার রমরমা। বাকি ছিল শুধু একটি ক্ষেত্র, জৈবরসায়ন। ব্যারি ও মর্টেন, কেউই প্রথাগত ভাবে জীববিজ্ঞানী নন, তাই কোশের উপর পরীক্ষানিরীক্ষা চালানোর কথা তাঁদের মাথায় আসেনি। সেই কাজ করলেন স্ট্যানফোর্ডের গবেষক ক্যারোলিন বার্তোজি। তাঁর মূল আকর্ষণ ছিল আমাদের কোশের এক বিচিত্র উপাদান – গ্লাইক্যান। কোশের মধ্যে প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, লিপিড এসব থাকে আমরা জানি। কিন্তু সেসব ছাড়াও থাকে এক বিশেষ জাতের জটিল শর্করা বা কার্বোহাইড্রেট যা সাধারণত কোশের পর্দায় থাকা কোনও প্রোটিনের সঙ্গে লেপ্টে থাকে। পাশাপাশি কোশের মধ্যে বার্তা চালাচালি থেকে ভাইরাস বা ব্যাক্টেরিয়ার আক্রমণের সময়ে অনাক্রম্যতার পাহারাদারদের জানান দেওয়া, অনেক কিছুতেই এর গুরুত্ব অপরিসীম। ক্যারোলিন যখন এই নিয়ে কাজ করছেন, তখনও বিশেষ কেউ এই জায়গায় সুবিধা করে উঠতে পারছে না, ফলত শুধুমাত্র ইমিউন কোশের গ্লাইক্যান কিভাবে কাজ করে তাই বুঝতেই তাঁর সময় লেগে গেছে চার বছর। ইতোমধ্যে এক কনফারেন্সে বসে তিনি শুনলেন এক বিজ্ঞানী কোশের মধ্যে সায়ালিক অ্যাসিড তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। ক্যারোলিন যেন এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলেন, সায়ালিক অ্যাসিডই তো গ্লাইক্যান তৈরির অন্যতম উপাদান! তিনি বুঝলেন, কোনোভাবে যদি সায়ালিক অ্যাসিডের সামান্য রাসায়নিক রদবদল করে তাকে দাগিয়ে দেওয়া যায়, আর কোশের ভিতর গেলে সে যদি গ্লাইক্যান তৈরিতে কাজে লাগে, তাহলে সহজেই কোশপর্দায় তাকে খুঁজে নেওয়া যাবে। আর সে রদবদলের উপায়? ক্লিক কেমিস্ট্রি!
সায়ালিক অ্যাসিডের সঙ্গে অ্যাজাইড গ্রুপ জুড়ে কোশের ভিতর চালান করলেন ক্যারোলিন। অ্যাজাইড যেহেতু কোশের ক্ষতি করে না, কোশও নির্বিবাদে তাদের ঢুকতে দিল, তারপর শিখিয়েপড়িয়ে পাঠিয়ে দিল গ্লাইক্যান তৈরির কাজে। অ্যাজাইড আটকানো গ্লাইক্যান কোশের বাইরে মুখ বের করতেই ক্যারোলিন পাঠালেন তাঁর দ্বিতীয় সৈন্যকে – সবুজ ফ্লুরোসেন্ট প্রোটিন আটকানো অ্যালকাইন। অ্যাজাইড-অ্যালকাইন মাখামাখি হতেই সে প্রোটিনের আলো শক্তিশালী অণুবীক্ষণ যন্ত্রে চাক্ষুষ করল সবাই। কোশপর্দার পরিধি জুড়ে সে এক অপার্থিব সবুজের খেলা। এই কাজের মধ্যে দিয়ে ক্যারোলিন জৈবরসায়নের জগতকে দিলেন এক অনন্য উপহার। কোশের ভিতরে রাসায়নিক যৌগ জোড়া-ভাঙ্গার খেলায় আর কোনোই বাধা রইল না।
ভুল বললাম। একটা বাধা রয়ে গেছে এখনও। তামা কোশের জন্য ক্ষতিকারক, সে যদি কোশকে মেরেই ফেলে তবে আর কী লাভ এমন বিক্রিয়ায়? ক্যারোলিন নিজেকে ডুবিয়ে দিলেন নিরলস চর্চায়, খুঁজে বের করলেন ১৯৬১ সালের এক প্রায়-বিস্মৃত গবেষণাপত্র যেখানে দেখানো হয়েছে যে অ্যাজাইড-অ্যালকাইন ক্লিক বিক্রিয়া তামা ছাড়াও একইভাবে করা সম্ভব যদি অ্যালকাইনকে চাপ দিয়ে ষড়ভুজাকার রিং বানিয়ে নেওয়া যায়। এই চাপাচাপির ফলে যে শক্তি অ্যালকাইনে সঞ্চিত হল তাই তামার অনুঘটকের কাজ করে দেয়। ২০০৪ সালে ক্যারোলিন প্রকাশ করলেন তাঁর গবেষণার ফলাফল – তামা বিহীন, অ্যালকাইন রিং সমৃদ্ধ কোশীয় ক্লিক কেমিস্ট্রি। এই পদ্ধতির মাধ্যমে টিউমার কোশের গতিপ্রকৃতি নির্ণয়, শরীরে ক্যানসারের প্রাদুর্ভাব নির্ণয় – আজকের দিনে সবকিছুই হচ্ছে।
মানুষ শুধুই প্রকৃতির দাস নয়, তার পরমতম সাধকও বটে।
.....................................
#The Nobel Prize in Chemistry 2022 #Carolyn R. Bertozzi #Morten P. Medal #K. Barry Sharpless #science