নিবন্ধ

ছবিতে বাঙালি প্রেমের বিবর্তন : বিংশ শতক

বিজলীরাজ পাত্র Sep 2, 2020 at 5:23 am নিবন্ধ

১৯২০-র কালপর্ব থেকেই চলচ্চিত্রকে কেন্দ্র করে একটা নতুন সাংস্কৃতিক ইতিহাস শুরু হচ্ছিল বঙ্গদেশে। বিশেষত কলকাতার উচ্চ এবং মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকদের জীবনে একটা পরিবর্তন আসছিল। আর এই পরিবর্তনের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন মহিলারা। এই পরিবর্তনের প্রসঙ্গে আমরা অভিনেতা বা অভিনেত্রীদের কথা বলছি না, বরং যারা উপভোক্তা, যারা চলচ্চিত্রের দর্শক - সেই মহিলাদের ব্যক্তিগত পরিসর নির্মিত হচ্ছে জনপরিসরে। একটা নতুন মাতৃত্বের ধারণা তৈরি হচ্ছে। যেখানে মা এবং সন্তান উভয়ের একটা প্রাইভেট স্পেস রয়েছে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের এই ধারণাটি ঔপনিবেশিক সরকারের হাত ধরে বঙ্গদেশে প্রবেশ করলেও নিপাট বিলিতি অনুকরণ ছিল না। একটা মিশ্র সাংস্কৃতিক বিকাশ ঘটেছিল সেদিনের উচ্চ-মধ্যবিত্তের নাগরিক জীবনে।

১৯৩৬ সালে প্রকাশিত অজানার উজানে উপন্যাসটি নানা কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গ্রন্থ সম্পাদক শ্রীক্ষিতীশচন্দ্র ভট্টাচার্য্যের দাবি অনুযায়ী এটিই বাংলা সাহিত্যের প্রথম বারোয়ারি শিশু-উপন্যাস। বারোজন লেখক মিলে এই উপন্যাসের কাহিনি তৈরি করেছিলেন। তালিকাটি চিত্তাকর্ষক- শ্রীমোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায়, শ্রীশোভনলাল গঙ্গোপাধ্যায়, শ্রীঅখিল নিয়োগী, শ্রীসুনির্ম্মল বসু, শ্রীযতীন সাহা, শ্রীশৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, শ্রীপ্রেমেন্দ্র মিল, শ্রীপ্রবোধ সান্যাল, শ্রীবিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রীসুবিনয় রায়চৌধুরী, শ্রীখগেন্দ্রনাথ মিত্র এবং শ্রীক্ষিতীশচন্দ্র ভট্টাচার্য্য। গ্রন্থটির নামকরণ করেছিলেন কবি কৃষ্ণদয়াল বসু। ভাবলেও অবাক লাগে এমন একটি আশ্চর্য সৃষ্টি আমাদের স্মৃতির পাতা থেকে হারিয়ে গেছে।


গ্রন্থের কাহিনি শুরু হয় সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ভাবে অসম স্থানে থাকা রাজা এবং বিজন নামে দুই বালকের বন্ধুত্বের ভেতর দিয়ে। রাজা অভিজাত পরিবারের সন্তান, আর বিজনের দিন কাটে অভাবের সংসারে। একদিন বিজন রাজার বাড়ি আসে। রাজার মায়ের সঙ্গে বিজনের আলাপ হয়। বিজনকে রাজার মা মাথায় হাত বুলিয়ে আদর দেন। কিন্তু দুই বন্ধুকে দেওয়ার মত সময় সেদিন রাজার মায়ের ছিল না। রাজার মা বলে – ‘আমি তোমার বাবার সঙ্গে বায়োস্কোপে যাচ্ছি। তুমি লক্ষ্মীটি হয়ে থেকো।’ অভিজাত বাঙালি পরিবারে বায়োস্কোপ দেখা সেদিন সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে উঠেছিল। শিক্ষিত ভদ্র জনেদের পারস্পরিক দেখা সাক্ষাতের স্থানও ছিল বায়োস্কোপ। নতুন দম্পতির একটা ধারণাও গড়ে উঠছে তখন। এই নতুন দম্পতির পরিমণ্ডলে সন্তানও জানে তার অধিকারের সীমারেখা। তাই মা তাকে বায়োস্কোপে নিয়ে যাচ্ছে না বলে রাজা মনখারাপ করে না বা তার চোখে জলও আসে না। সে জানে এটাই ভদ্রতা। ঘর-বাহির এর প্রচলিত বৈপরীত্য তখন ভেঙে পড়ছে ধীরে ধীরে।


উপন্যাসের গল্পমাফিক রাজার মাকে ঘিরে আছে শাড়ির খসখস শব্দ, এসেন্সের মধুর গন্ধ এবং জুতোর খটমট আওয়াজ। গ্রন্থে রাজার মায়ের একটি চিত্রও যোগ করা হয়েছে। ছবির মহিলা চরিত্রে আমরা কোনও জড়তা দেখি না। তাঁর পোশাকে যেমন আভিজাত্য আছে, তেমনি পায়ের জুতোতে অল্প হিলও রয়েছে। পোশাক, জুতো বা এসেন্সকে কেন্দ্র করে রীতিমত একটা পণ্য সংস্কৃতির বাজার গড়ে উঠছে সেকালে। উচ্চ অভিজাত সমাজের একাংশের কাছে নিজেকে সুন্দর করে তোলার জন্য ইউরোপীয় ধরনের পোশাক, জুতো, এসেন্স নিত্য-প্রয়োজনীয় হয়ে উঠছে। ১৯২০-র কালপর্বে কলেজ স্ট্রিটে জনপ্রিয় কাপড়ের দোকান ছিল - পল এণ্ড কোং লিমিটেড । নানান বিজ্ঞাপনে তারা জানিয়ে দিত - উচ্চশ্রেণির ইউরোপীয় ধরনের পোশাক সেখানে সুলভ মূল্যে বিক্রয় করা হয়। জমাটি ছবিও যোগ করা হত বিজ্ঞাপনে। বাবা-মা এবং ছেলে-মেয়ে সবাই রীতিমত বিলিতি পোশাকে আবির্ভূত হয়েছে দর্শকের সামনে। আর সেকালের এসেন্সের বিজ্ঞাপন তো তাক লাগিয়ে দেওয়ার মত। ১৯২০-তেই ১৭ নং গিরিবাবু লেনের মিঃ এস ফিসারের আইবিস এসেন্স তো মন কেড়ে নিয়েছিল উচ্চ-মধ্যবিত্ত বাঙালির। বিজ্ঞাপনে লেখা হচ্ছে - আপনি হতাশ প্রেমিক! যার প্রেম লাভের জন্য এ সংসারের সর্বস্ব দিতে ইচ্ছুক! তার সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার আগে নিজের পোশাক, পরিচ্ছদ বা রুমালে সাত ফোঁটা করে আইবিস এসেন্স দিন। একমাস যেতে না যেতে, যিনি আপনাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, তিনিই প্রাণ মন আপনাকে দিয়ে বসবেন। কিন্তু উচ্চ-মধ্যবিত্তের এই নতুন সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে কি বিজনের মত একটি সাধারণ ছেলে মানিয়ে নিতে পারবে? না, বরং তার লালাপেড়ে শাড়িপরা গরীব মায়ের কথা মনে পড়ে। যত তাড়তাড়ি সম্ভব সেখান থেকে চলে যায় বিজন।


বায়োস্কোপ দেখার এই গল্পকে কেন্দ্র করে নতুন দম্পতি ভাবনার একটা আঁচ পাওয়া গেলেও এখনও পুরো ব্যপারটা স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। দম্পতির এই নতুন ধারণা সেদিন ছড়িয়ে পড়ছিল রঙিন ছাপা-ছবিকে কেন্দ্র করে। দর্শকদের কাছে এই ছবিগুলির ক্ষেত্রে শিল্পীর নাম তেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। বরং তাঁরা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত নতুন ছেলে-মেয়েদের দাম্পত্যযাপন দেখতে চেয়েছিলেন ছবির পাতায়। ১৯২০ নাগদই নতুন দম্পতিকেন্দ্রিক ছবি ছেপে বিখ্যাত হয়েছিল The Milan Printing Works, Calcutta। বাহারি রঙিন সে ছবিতে মহিলাদের অন্তঃপুরে আটকে থাকতে হয় না। বর্তমান ছবিটিতে আমরা দেখছি এক জোড়া পুরুষ-নারী পাশাপাশি চেয়ারে বসে আছে। তাদের কারও চোখে মুখে আড়ষ্টতা নেই। বরং মেয়েটি তাকাচ্ছে পুরুষটির মুখের দিকে। অন্য এক মহিলা পুরুষটির দিকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিচ্ছেন। চা-পানকে কেন্দ্র করে সেকালের উচ্চ-মধ্যবিত্ত সমাজে একটা আলাপচারিতার সংস্কৃতি গড়ে উঠছিল। জড়তা আর নানান ব্যবধান মুছে যাচ্ছিল একটু একটু করে। এই ছবিটির চিত্রকর ছিলেন গণেশ। উনিশ শতকের শেষ থেকেই মুখ্যত পৌরাণিক ছবির শিল্পী হিসাবে পরিচিত ছিলেন গণেশ। কিন্তু নতুন দম্পতির ধারণা এত জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল সেকালে যে গণেশের তুলিও নিজের ঘরানা থেকে বেরিয়ে এসে এমন ছবি তৈরি করার দিকে ঝুঁকছিল। কিন্তু শুধুই কী আর আলাপচারিতা বা চায়ের আসরে প্রেম জমতে পারে! সেকালের বাজারে যে ‘Intellectual Love’ নামে একটি নতুন প্রতর্কের আগমন ঘটে গেছে!

যতীন্দ্রমোহন সিংহ-র লেখা ‘ধ্রুবতারা’ উপন্যাসটি বাঙালির প্রেমের ইতিহাস বুঝতে বেশ জরুরি। ১৯০৮ সালে ভট্টাচার্য্য এণ্ড সন্স থেকে এর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ফিজিকাল, ইন্টেলেকচুয়াল, মরাল - হরেক কিসিমের প্রেমের তত্ত্বায়ন করা হয়েছে এখানে। পুরুষ-নারীর মধ্যে শুধু প্রেম নয় সখ্য বা ফ্রেন্ডশিপও ঘটতে পারে বলা হচ্ছে। আধুনিক নারী-পুরুষকে কেন্দ্র করে প্রেম এবং সখ্যর এই পার্থক্য বেশ চিত্তাকর্ষক। নারী-পুরুষের ফ্রেন্ডশিপ বাঙালি জীবনে তখনও অত সহজ ছিলনা। যতীন্দ্রমোহন কথিত এই ‘Intellectual Love’-এর রূপটিও জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল বাংলার নতুন দম্পতি ভাবনাকেন্দ্রিক রঙিন ছবির জগতে। ১৯২৭ সালে এমনই একটি ছবি তৈরি করেন শিল্পী নরেন সরকার। ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে- রাতের বেলা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যিখানে বইয়ের অবস্থান। স্বামী স্ত্রীকে বই পড়ে শোনাচ্ছে। তাদের মধ্যে বয়সের ফারাকও খুব বেশি নয়। দূরে জানলা দিয়ে আকাশের চাঁদ দেখা যাচ্ছে। একটা রোম্যান্টিক আবহ ঘিরে রয়েছে সমস্ত ছবি জুড়ে।


ছাপা ছবির জগতে এই নতুন প্রেম বা দাম্পত্যের ধারণাটি এতদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল যে ১৯৩০-এর কালপর্বে শ্রীপূর্ণচন্দ্র চক্রবর্তী 'নদী স্বপ্ন' বলে একটি চূড়ান্ত রোম্যান্টিক ছবি এঁকেছিলেন। দুটি ছোট বালক-বালিকা পালতোলা নৌকোতে এগিয়ে চলেছে নদীপথে। প্রেমের এমন অসামান্য চিত্রণ সেকালের সামাজিক বিচারে যে শুধুমাত্র স্বপ্ন হতে পারে তা বেশ ভালোরকম বুঝেছিলেন শিল্পী।


কিন্তু এমন রোম্যাণ্টিক বালক বালিকা হওয়ার জন্য তো রীতিমতো তালিম চাই। অজানার উজানে উপন্যাসে কোটপরা ছোট্ট রাজার ছবিটির দিকে তাকালেই সেই তালিমের ইঙ্গিত পাব আমরা। প্রশ্ন উঠবে এই শতক গুলিতে কি পৌরাণিক ছবি আঁকা হয়নি? একেবারেই তা নয়। রামায়ণ বা মহাভারতকে কেন্দ্র করে যথেষ্ট পৌরাণিক ছবি আঁকা হত সেকালে। কিন্তু সামাজিক বিষয়বস্তুযুক্ত ছবির প্রভাবে পৌরাণিক এবং সামাজিক ছবির একটা সমঝোতাও তৈরি হচ্ছিল তলে তলে।

বিশ শতকের শুরুর দশকেও ইউরোপীয় শিক্ষায় শিক্ষিত নাগরিক লোকেদের একটি অংশের চোখে পুথি একেবারেই ‘ছোটলোকে’র সংস্কৃতি। কিন্তু তা বলে সবাই পুথির থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়নি। শ্রীযুক্ত সুবলচন্দ্র পাল ১৯৩০-এর আশপাশে ছেলেদের তালপাতাতে খাগের কলমে লেখার ছবি এঁকেছিলেন। মনে রাখতে হবে পুথিকে সেকালে পবিত্র বস্তু মনে করত হিন্দু পরিবারের একটি বড় অংশ। এই যে পুথির একটা সেক্রেড জার্নি যা বিশ শতকের পরিবারের মধ্যেই বর্তমান, ঠিক এই প্রতর্ককে ভিত্তি করেই পৌরাণিক ছবির সঙ্গে সামাজিক ছবির একটা সন্ধি স্থাপিত হয়। সুবলবাবুর আঁকা পুথির ছবিটিকে কোনো ভাবেই পৌরাণিকের একমাত্রিক ঘেরাটোপে আটকানো যাবেনা। এই ছবির রোম্যান্টিক আবহ রীতিমত চোখে পড়ার মত। একই ভাবে ১৯৩০-র কালপর্বে আঁকা জনপ্রিয় রাধা-কৃষ্ণকেন্দ্রিক ছবিগুলি কাঠামোগত ভাবে পৌরাণিক হলেও নতুন রুচির নতুন দর্শকের চোখে রোম্যান্টিক হয়ে ওঠে।


বাঙালির প্রেমের ইতিহাসের এই ‘Visual Transformation’-এর নানান শাখা-প্রশাখা রয়েছে। এই ক্ষুদ্র প্রবন্ধে আমরা তার একটা নিপাট কথামুখ করলাম শুধু।

#ছবি #বিজ্ঞাপন #প্রেম #সমাজতত্ত্ব #সামাজিক ইতিহাস #বিজলিরাজ পাত্র

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

34

Unique Visitors

219177