ঘুমপাড়ানি গান কিংবা বাংলার শিক্ষা

আয় রে আয় ছেলের পাল মাছ ধরতে যাই
মাছের কাঁটা পায় ফুটেছে দোলায় চেপে যাই
দোলায় আছে ছ’পণ কড়ি, গুনতে গুনতে যাই
আয় রে আয় ছেলের পাল মাছ ধরতে যাই...
ঘুমপাড়ানি গান। ছোটবেলায়, যখন প্রবল দস্যুতা পেতো, রাতজাগা চোখ মেলে প্যাটপ্যাট করে তাকিয়ে থাকতুম আমরা, গুঁতোগুঁতি করতুম, মা দিদিমারা এই গান গেয়ে থাবড়েথুবড়ে আমাদের ঘুম পাড়াতেন। ভাতঘুমের অন্য একটা গান ছিল। ‘আয় ঘুম যায় ঘুম দত্তপাড়া দিয়ে’। আমাদের বাচ্চাকাচ্চার ভাতঘুম আজকাল দত্তপাড়া দিয়ে আসে না, গুগল মিট দিয়ে আসে। তারা মাথাভর্তি ঘুম নিয়ে আধোমনা হয়ে তাকিয়ে থাকে, কেউ কেউ টুক করে সরে যায়, নিয়মিত পেট ব্যথার মতোই নিয়মিত নেটওয়ার্ক প্রবলেম শুরু হয়ে যায় তাদের। কারও কাছে স্মার্টফোন নেই, অভিভাবক নতমুখে এসে বলেন, “কাজ ছিল না, সংসার চালাতেই জেরবার, ছেলেটার অনলাইন ক্লাসের ব্যবস্থা করতে পারিনি ম্যাডাম, ছেলের আমার সত্যি কোনও দোষ নেই। ওর বাপের অক্ষমতা, ক্ষমা করুন। অ্যাক্টিভিটি টাস্কগুলো দিলে ও আপনাকে কালকেই খাতা জমা করে দেবে।” কী বলবো ভেবে পাই না। কী দায়দায়িত্ব ছিল শিক্ষক হিসেবে, ভুলে যাই। শুধু দেখতে পাই আমাদেরও অক্ষমতা। অভাবী অথচ মেধাবী কিশোরের অনতিদূর, নষ্ট ভবিষ্যৎ।
বাণিজ্য চলছে। বিশ্ববাণিজ্য। অশিক্ষিত, অপুষ্টিতে ভোগা শিশুকিশোরের কাতার দিয়ে ধ্বংসযজ্ঞও যে চলছে পাশাপাশি, আমরা তাকিয়েছি? মহানগরের প্রাণকেন্দ্রে, যে স্কুলে আমি শিক্ষকতা করি, এই অতিমারি পর্বে সেখানে আমরা অ্যাকাডেমিক কাজে প্রয়োজনমতো যাচ্ছি, নিয়মিতই খোলা রাখছি অফিসরুম, অনলাইন ক্লাসের জোরদার রুটিন বানিয়েছি, প্রশ্নতালিকা-নোটস-ক্লাস টেস্ট কিছুই যদিও বাদ দিচ্ছি না ,তাও, ক্লাসে ছাত্রদের উপস্থিতির হার গত দু’বছর ধরে অপরিবর্তিতভাবে ন্যূনতম। বেশিরভাগই আসে না।
তাহলে তারা কী করে? তাদের কারও কাছেই কি স্মার্টফোন নেই? না, তা নয় ব্যাপারটা। ব্যাপারটা হলো শৃঙ্খলা ভেঙে গেছে। তাদের ইচ্ছে করে না পড়তে আসতে, আসে না। এখন তারা বেশ নিশ্চিন্তভাবে জানে, পড়াশোনা পরীক্ষা এসমস্ত ছাড়াই মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিক হায়ার স্টাডিজের গণ্ডি পেরিয়ে যাওয়া যায়। উপস্থিতির হার এখন বানান ভুলের মতোই নিতান্ত উপেক্ষার বিষয়। আর গ্রামে? স্কুল বলতে বেশিরভাগ মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ে বলেন, ওগুলো রেশন বিতরণের জায়গা। মাস্টারগুলো চাল আলু দিতে আসে। পরিস্থিতি না বুঝে তাঁদের রাগ এসে পড়ে শিক্ষকদের ওপর। আচ্ছা, শিক্ষকরা সত্যি সত্যি কেমন আছেন? আগের মতোই আছেন তো? না, বুকে হাত রেখে এ’কথা আর বলতে পারি না আমাদের এনার্জি অটুট, আমরা দিনে পাঁচটা থেকে সাতটা ক্লাস যে দম নিয়ে করে গেছি বছরের পর বছর, পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে গেলে সেই উদ্যম নিয়েই তক্ষুনি আবার ঝাঁপাতে পারব। পারা সম্ভব নয়। কারণ আমরা অভ্যাসের দাস। এই অনলাইন ক্লাস, এই অনিয়মিত হাজিরায় আমরাও আমাদের অন্তর্গত শৃঙ্খলার টলমলে হওয়াটা টের পাচ্ছি। বাহানা দিয়ে আত্মগোপন করার জায়গা নেই।
জানুয়ারি মাসে নতুন সেশনে ক্লাস শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু তখন শিক্ষককুলকে মিড-ডে মিল বিতরণ এবং স্টুডেন্টদের ভ্যাক্সিনেশন প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করানো হল। ফলে ক্লাস ফাইভ থেকে এইটের ছেলেমেয়েরা না পেল ক্লাস না পেল ভ্যাক্সিন। তারা ওই ফাঁকা সময়টা কীভাবে কাটালো? আমরা খোঁজ নেওয়ার সত্যিই সময় পাইনি। সে-পর্ব মেটামাত্র যেই অনলাইন ক্লাস শুরু করলাম, অভিভাবকদের হাজিরা বাড়তে লাগল স্কুলে। কী কারণ? না, তাঁরা সন্তানের অ্যাক্টিভিটি টাস্ক জমা করতে চান। সেসব নাকি বাজারে এসে গেছে। অথচ এখনও সেভাবে সিলেবাসের কিছুই এগোয়নি। তাহলে এরা অ্যাক্টিভিটি টাস্ক কীভাবে শেষ করছে? মুখ্যত গৃহশিক্ষকতার সুবাদে। আজই একজন পরিচিত মাস্টারমশাই বলছিলেন, সরকারি উদ্যোগে জি-টিভিতে টেন আর টুয়েলভ স্ট্যান্ডার্ডের যে ক্লাস নেওয়া হবে, তা শুনে তাঁর ছাত্ররা বলছে “বাড়িতে কেবল কানেকশন নেই, ফোনে পয়সা ভরে ক্লাস করবার সামর্থ্যও নেই, আমরা তাহলে কী করবো?” শহরে মফস্বলে গ্রামে যেখানেই যান, এই শ্রেণির ছাত্রসংখ্যা নেহাত কম নয়। অনেকেই পরিবারের প্রথম শিক্ষিত প্রজন্ম। তাদের ভবিষ্যৎ কতটা অন্ধকার, মেপে দেখবার সাহস হয় না। নিজেদের বড় অপরাধী লাগে। কিন্তু এক্ষেত্রে কী করবেন শিক্ষকরা? নীরবে মেনে নেওয়া ছাড়া উল্লেখযোগ্য কিছু তো করিনি আমরা, গত দু’বছরে। স্কুল তাহলে এখন থেকে একটি এমন প্রতিষ্ঠান, যাকে বলা যায় সেন্টার, যেখান থেকে পরীক্ষায় বসে পাশ দেওয়া যাবে, ক্লাসে ওঠা যাবে। এমনকি পরীক্ষা না দিয়েই স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে ভর্তি হওয়াও যাবে! তাহলে আর নতুন শিক্ষক নিয়োগের কী প্রয়োজন? বৎসর বৎসর চলে গেল। আরও যাক। দীর্ঘকাল, স্কুল সার্ভিস পরীক্ষার কোনও প্রয়োজনই থাকবে না! শিক্ষা পঙ্গু হয়ে গেল। বাঁকা মেরুদণ্ড নিয়ে জন্মাবে এবার থেকে, আমাদের আগামী প্রজন্ম। আমরা কি একবারও ভয়ে কেঁপে উঠব না?
কেঁপে ওঠার প্রতিশব্দ -- আন্দোলন।
..............................
[মতামত লেখকের ব্যক্তিগত]
#অতিমারী #শিক্ষা #লকডাউন #বাংলা পোর্টাল #সিলি পয়েন্ট #পূর্বা মুখোপাধ্যায় #নিবন্ধ #lockdown #education #silly point