বইয়ের খবর

গল্পের বই - ব্রজ সৌরভ চট্টোপাধ্যায়

তীর্থঙ্কর মণ্ডল Jan 26, 2021 at 7:08 am বইয়ের খবর

ব্রজ সৌরভ চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম গল্প-সংকলন ‘গল্পের বই’। মোট ১৫টি গল্পের পরিকল্পিত সজ্জা। একটানা এক নিমেষে পড়ে ফেলার স্বাভাবিক প্রবণতা নিয়ে বসলে যেন কিছুটা হোঁচট খেতে হয় ব্রজ সৌরভের ‘গল্পের বই’ পড়তে গিয়ে। প্রতিটা গল্প শেষ হওয়ার পরই যেন কিছুটা অতিরিক্ত সময় চেয়ে নেয় পাঠকের কাছে। এই সময় কখনও নিবিড় রোমান্টিকতায় হারিয়ে যাওয়ার, আবার কখনও অদ্ভুত কোনো মানসিক অস্থিরতা, তীব্র-ঘিনঘিনে কোনো শরীরী বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে অস্বস্তিতে পড়ার।

গল্প-সংকলনের সজ্জাতে স্পষ্ট এই দু-ধরনের গল্প এলোমেলোভাবে পরস্পরের ফাঁকে গাঁথা পড়েছে। অনেকটা সেই ‘চন্দ্রবিন্দু’র গানের অ্যালবামগুলোর মতো। প্রায় প্রতিটা অ্যালবামেই অত্যন্ত যত্ন নিয়ে তৈরি নিখাদ রোমান্টিক মেলোডি থেকেছে পরিকল্পিতভাবে, অথচ ‘চন্দ্রবিন্দু’র গান বললেই মাথায় ঘোরাফেরা করবে ছকভাঙা স্ট্রেটকাট অথবা ব্যঞ্জনাধর্মী কিছু গান।

ব্রজ সৌরভের সংকলন তাই মিষ্টি প্রেমের গল্প ‘পিপড়ে’ দিয়ে শুরু হয়ে তার পরপরই ‘হ্যালুসিনেশন’, ‘C/o মিমি’ বা ‘খানকি’-র মতো আপাত ‘নোংরা’ শরীরী বাস্তবতার ধাক্কা দিতে থাকে পাঠককে। ‘সাদা ভাত’ আর ‘সাদা রঙের প্রজাপতি’-র রোমান্টিসিজমের মাঝে থাকে ‘বাঁ দিকে হৃদয় থাকে’-র মতো ঘিনঘিনে অদ্ভুতরসের গল্প। ‘সেতার’ বা ‘অস্তরাগে’র শান্তধর্মিতার পর ‘জন্মদিনের পরের দিন’ বা ‘বেড়াল’-এর বীভৎসতা। এসবের ফাঁকে ফাঁকে আবার থেকেছে ‘পতঙ্গ’, ‘রোগ’, ‘বাবলু’ গল্পগুলির একাকীত্ব, বিপর্যস্ত মানসিক অস্থিরতা, ভারসাম্যহীনতার ছবি। ‘হরিরামের ডায়রি (ভূমিকা ও টীকা সম্বলিত)’ সংকলনের শেষ গল্প। লেখক স্বনামে এ গল্পে অবতীর্ণ। হরিরামের ব্যর্থ দিনলিপির কাহিনির পাশাপাশি কাটাছেঁড়া চলেছে গল্প, গল্পকার, পাঠক ইত্যাদি নানা সত্তার মানসিক অবস্থানের। ছক ভাঙতে চাওয়া গল্পকথক তথা লেখক ব্রজসৌরভের ঘোষণা — “আলবাল না লিখতে পারা লেখকদের বাড়িতে দোদমা ছুঁড়ে দেব এমনি এমনি। আর সমস্ত বই পুড়িয়ে দেব। দূর থেকে দেখব পাঠক মাথা চুলকোচ্ছে। ঘন ঘন চশমা মুছছে। সরু সরু লাইলন দড়ি পেঁচিয়ে নিচ্ছে গলায়। তারপর ঝুলে পড়ছে মৃত লেখকের সঙ্গে।”

তবে যাই হোক, এই ‘আলবাল’ লেখার দাবি জানানো লেখক ব্রজ সৌরভ গল্পদের হয়ে ওঠা বিষয়ে অত্যন্ত সচেতন। খুব যত্নে, একের পর এক ছোট ছোট বাক্য ব্যবহার করে, ছোট ছোট ছবি জুড়তে জুড়তে এগিয়ে চলে তাঁর গল্পরা। অধিকাংশ গল্পে সময়কে এগিয়ে-পিছিয়ে জাগলিং করতে করতে গল্পের প্লট নির্মাণ করেন লেখক। প্রায় সমস্ত গল্পেই বর্তমান ও অতীতের মধ্যে এই নিরন্তর চলাচল লেখকের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যকে চিহ্নিত করলেও কখনো কখনো তা একঘেয়েমিও তৈরি করে।

সামগ্রিকভাবে ‘গল্পের বই’-এ সংকলিত গল্পগুলির আর একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য, গল্পগুলি বেশিরভাগ একটি নির্দিষ্ট বয়ঃক্রমের মধ্যে ঘোরাফেরা করে। শুধু তাই নয়, ‘খানকি’, ‘সাদা ভাত’, ‘অস্তরাগে’ এবং ‘বেড়াল’ — এই চারটি ব্যতিক্রম ছাড়া বাকি সমস্ত গল্পই আঠার থেকে পঁচিশ বছর বয়সী কলেজ বা ইউনিভার্সিটি জীবনের কথা বলে। প্রচণ্ড নিঃসঙ্গ অথবা অবাধ স্বেচ্ছাচারিতার মেসজীবন এই গল্পগুলির অধিকাংশর পটভূমি নির্মাণ করেছে। ফলে যৌবনের উদ্দামতা, রোমান্টিকতা, একাকীত্ব, অস্থিরতা, দোলাচলতা, অস্বস্তি ইত্যাদি মূল সুর হয়ে থেকেছে ‘গল্পের বই’-এর। এর আগে অন্য কোনো লেখকের লেখায় মেসজীবনের এই দিকগুলি এত স্পষ্ট হয়ে সম্ভবত উঠে আসেনি। এককথায় তরুণ লেখক ব্রজ সৌরভ তাঁর অভিজ্ঞতার সময়পর্ব থেকে খুব একটা বেরোননি। যা গল্পগুলিকে একদিকে এক ছাঁচের সাধারণ বৈশিষ্ট্যে আবদ্ধ করলেও আবেদনের দিকে রেখেছে সৎ, স্পষ্ট ও সাহসী।

আরও পড়ুন - এক সত্যি গল্পের পাঠ প্রতিক্রিয়া / সবর্ণা চট্টোপাধ্যায়

ব্রজ সৌরভের বলিষ্ঠ লেখনশৈলী আর গল্প নির্মাণের ক্ষমতা তাঁর ‘গল্পের বই’-কে অনন্য করে তুলেছে। বইটির শেষে সামগ্রিক গল্পগুলির নিরিখে তাই প্রচ্ছদকারের দাবিটি যথার্থ ও উদ্ধারযোগ্য — “প্রেম-অপ্রেম, ঘিনঘিনে যৌনতা, ক্লিশে প্রস্তাব, বিড়ির ধোঁয়া, টিনের দরজার ধড়াম, ব্যর্থ দিনলিপি — এমন কিছু কুচুটে সত্যিদের নিয়ে ঘর করে ব্রজ সৌরভের গল্পরা। এ বই তাই নামেও ভড়ংহীন। সব গল্প লজেঞ্চুস নয়। কখনও কখনও বিষম খাবেন। জল রাখবেন পাশে এক গেলাস।”

#বইয়ের খবর #গল্পের বই #ব্রজ সৌরভ চট্টোপাধ্যায় #বাংলা বই #তীর্থঙ্কর মণ্ডল #সিলি পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

38

Unique Visitors

215814