কোভিড ভ্যাকসিনঃ নিষ্ঠুর উপেক্ষা পেরিয়ে শাশ্বত সাধনার গল্প
গোটা কলোসিয়ামের রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষার সামনে এখন হাতেগোনা কিছু গ্ল্যাডিয়েটর। প্রতিপক্ষ কোনও ক্ষুধার্ত সিংহ নয়, অসংখ্য অতি-আণুবীক্ষনিক জীব যাদের দাপট একুশ শতকের ইতিহাসে একটা নতুন অধ্যায় যোগ করেছে – অতিমারী। সেইদিনের রোমান সম্রাটের মতো আজকে এক একজন গ্ল্যাডিয়েটরের পৃষ্ঠপোষক এক একটি বহুজাতিক সংস্থা। পুঁজির লড়াই নিশ্চয়ই, কিন্তু সবশেষে লড়াইটা সেই প্রকৃতি বনাম বিজ্ঞানের, মানুষের অপরিণামদর্শিতা বনাম ক্রম-উন্নত মানবমেধার। তাই শরীরের ভিতরে যুদ্ধের ময়দান এই যোদ্ধারা চিনে নিলেও, তাদের রণদক্ষতায় শান দেওয়ার কাজ সেই নাওয়া-খাওয়া ভোলা বিজ্ঞানীদের।
ভ্যাকসিনের গল্প শুরুর আগে আসুন একবার জেনে নিই ক্যাটালিন কারিকোর কথা। ভদ্রমহিলা সাদাসিধা মানুষ, সেই ১৯৮৫ সালে স্বামী-সন্তানসহ হাঙ্গেরি থেকে আমেরিকার পথে পাড়ি দিয়েছিলেন, ফিলাডেলফিয়ার টেম্পল ইউনিভার্সিটিতে পোস্ট-ডক্টরাল গবেষণায় যোগ দেওয়ার জন্য। পকেট তখন এমনই গড়ের মাঠ যে ক্রেডিট কার্ড, মোবাইল ফোন এমনকি যথেষ্ট নগদ টাকাও সঙ্গে নেই। সাধের গাড়িটিকে চোরাবাজারে বিক্রি করে সেই টাকা দিয়ে আসলেন নতুন দেশে। এরপর শুরু হল তাদের আরেক সংগ্রাম। চারবছরের মাথায় গবেষণা শেষ করে ক্যাটালিন পেনসিলভ্যানিয়া ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হলেন। একবছরের মধ্যে তিনি mRNA-থেরাপি নিয়ে গবেষণার খাতিরে অনুদানের জন্য আবেদন করলেন। বিষয়বস্তু একটু সহজ করে বুঝিয়ে বলা যাক? জীবদেহের লক্ষ লক্ষ কোশের মধ্যে সবরকম তথ্যের আধারকার্ড হয়ে বসে আছে DNA আর তার থেকে ক্রমাগত তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন প্রকার RNA। এদের মধ্যে mRNA যাবতীয় প্রোটিন তৈরির মূল সাংকেতিক বার্তা বহন করে আর প্রোটিন দিয়েই কোশের সমস্ত কাজ সম্পন্ন হয়। কাজেই mRNA-এর গুরুত্ব বুঝতেই পারছেন! কারিকোর লক্ষ্য ছিল, বাইরে থেকে কৃত্রিম উপায়ে কোশের মধ্যে নির্দিষ্ট সংকেত-যুক্ত mRNA ঢুকিয়ে তার সাহায্যে নির্দিষ্ট প্রোটিন তৈরি করা। নব্বই-এর দশকে দাঁড়িয়ে এই ভাবনা শুধু চ্যালেঞ্জিং নয়, ছিল রীতিমতো বৈপ্লবিক। হাতেনাতে ফল পেলেন তিনি। কর্তাদের মনে হল না তেমন কিছু সম্ভাবনা আছে এই কাজের, তাই পত্রপাঠ আবেদন খারিজ। এরপর এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে থাকল বছরের পর বছর। সরকারি অনুদান থেকে প্রাইভেট ফার্মের সাহায্য – ছবিটা বদলালো না। হাল ছাড়লেন না কারিকোও, লাগাতার চেষ্টা চালিয়ে গেলেন আরও উন্নত mRNA, আরও স্থিতিশীল কোশীয় প্রতিস্থাপনের জন্য।
কথায় বলে, কষ্ট করলে কেষ্ট মেলে। তা কেষ্ট মিলল বৈকি ক্যাটালিনার। ১৯৯৫ সালে তাঁর ক্যানসার ধরা পড়ল আর ঐ একই সময়ে, উল্লেখযোগ্য সাফল্য না থাকার অজুহাতে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে অধ্যাপক থেকে নিচের পদে নামিয়ে দিলেন! আপনি-আমি হলে নিশ্চয়ই ইউনিয়ন রুমে গিয়ে হল্লা করতাম অথবা ডিপ্রেশনের ওষুধ খেতাম, ক্যাটালিনা সকাল থেকে রাত অবধি ল্যাবেই নিজের মনপ্রাণ সঁপে দিলেন। বহু বিনিদ্র রজনী পেরিয়ে তিনি বুঝলেন, বাইরে থেকে mRNA পাঠালেও কোশ তাকে প্রথম সুযোগেই বহিরাগত বলে চিনে নিচ্ছে এবং তার বিরুদ্ধে নিজের সবরকম প্রতিরোধী অস্ত্র শানাচ্ছে। ইঁদুরের উপর পরীক্ষা চালাতে গিয়ে দেখা গেল, কখনও কখনও এই প্রতিরোধ এমন মাত্রাছাড়া যে তার ফলে অনেক স্বাভাবিক কোশ বিনষ্ট হচ্ছে। কাজেই প্রয়োজন ছিল এমন কোনও পদ্ধতির যার মাধ্যমে সহজেই কোশকে বোকা বানানো যাবে। এইখানে ভাগ্য সহায় হল কারিকোর। ১৯৯৭ সালে নেহাতই ঘটনাচক্রে তাঁর সঙ্গে আলাপ হল ইমিউনোলজিস্ট ড্রিউ ওয়াইজম্যানের। দুজনের মিলিত ব্রেইন-স্টর্মিং প্রমাণ করল mRNA গঠনকারী একক, নিউক্লিওসাইডের বিশেষ বিশেষ জায়গায় মিথাইল গ্রুপ বসিয়ে দিলে অথবা ইউরিডিন (uridine) নামক নিউক্লিওসাইডের বদলে সিউডো-ইউরিডিন নামের এক পরিবর্তিত সংস্করণ ব্যবহার করলেই কোশ সেই mRNA-কে আপন বলে জড়িয়ে ধরে। দুজনে মিলে গবেষণালব্ধ ফলাফল ছাপিয়ে দিলেন আন্তর্জাতিক জার্নালে, প্রশংসাও জুটল বিস্তর।
কিন্তু বিধি বাম। একে মহিলা, তায় আবার অভিবাসী! আভিজাত্যের পাহাড়প্রমাণ অহং-এর সামনে বিজ্ঞানীর মেধা তো নেহাতই চুনোপুঁটি। কাজেই তাবৎ প্রশংসা সত্ত্বেও নিজের ঘরেই সম্মান পেলেন না কারিকো। কখনও তাঁর পরিচয়ে বলা হল তিনি ওয়াইজম্যানের পোস্ট-ডক্টরাল ফেলো, কখনও তাঁর পুরুষ সহকর্মীরা ‘প্রোফেসর’ সম্বোধিত হলেও তিনি রয়ে গেলেন ‘মিসেস’। একজন স্বাধীন গবেষক হিসেবে এই পরিচয়-সংকট তাঁকে এতটাই আতংকিত করে তুলেছিল যে তাঁদের আবিষ্কারের পেটেন্ট ফাইল করার সময় ওয়াইজম্যানের নাম প্রথমে আছে দেখে তিনি দস্তুরমতো ঝগড়া করে নিজের নাম প্রথমে আনেন। আপাতদৃষ্টিতে হয়ত তুচ্ছ বিষয়, কিন্তু এই আইডিয়া একান্তভাবেই তাঁর সাধনার ফসল, তাঁর একমাত্র উষ্ণীষ। ঐটিকে কোনোমতেই তিনি হারাতে চাননি। যাই হোক, পেটেন্ট পাওয়ার পরেও তাঁরা কাজ চালিয়ে গেলেন mRNA-এর মাধ্যমে ভ্যাকসিন বানানোর লক্ষ্যে। কেমন করে? বুঝতে পারা কঠিন নয় মোটেই। কোশের ভিতর mRNA পাঠিয়ে এতদিনে পছন্দমতো প্রোটিন তো তৈরি করাই যাচ্ছিল, এখন ভাইরাসের বিশেষ বিশেষ প্রোটিন বানানোর সংকেত যদি পুরে দেওয়া যায় ঐ mRNA-তে, তাহলে আমাদের শরীরে উৎপন্ন হয়ে তারা আমাদের প্রতিরোধী ব্যবস্থাকে উজ্জীবিত করবে। তৈরি হবে লড়াই করার মত অ্যান্টিবডি ও অন্যান্য লিম্ফোসাইট কোশ। এতটুকুও রোগ না হয়েই শরীর চিনে যাবে তার সম্ভাব্য দুশমনদের।
ভালো জাতের পরিমার্জিত mRNA বানানো যদি এই কাজের প্রথম অধ্যায় হয়ে থাকে তবে পরবর্তী অধ্যায় ছিল সেই mRNA-কে কোশের ভিতর পাঠানোর জন্য সুযোগ্য পরিবহণ মাধ্যম তৈরি করা। এই কাজে দিশা দেখালেন MIT-এর অধ্যাপক রবার্ট ল্যাংডন। ১৯৭৬ সালে নেচার পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রবন্ধে তিনি দেখিয়েছিলেন, পলিভিনাইল অ্যালকোহল জাতীয় পলিমার দিয়ে DNA বা RNA-কে ধরে রেখে বেশ খানিকটা সময় জুড়ে অল্প অল্প করে তাদের কোশীয় পরিবেশে ছাড়া সম্ভব। এর ফলে আমাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থাও গড়ে উঠবে ধীরে ধীরে, একধাক্কায় কাজ করতে গিয়ে আর সেমসাইড গোল হবে না। কালে কালে এই আবিষ্কার ভ্যাকসিন সংক্রান্ত গবেষণায় যুগান্তকারী সংযোজন হয়ে উঠেছে। রবার্টের ঝুলি ভরে গেছে বিভিন্ন সম্মানে।
বেশ তো, নাহয় বোঝা গেল যে ভাইরাসের বিরুদ্ধে mRNA-নিয়ন্ত্রিত ভ্যাকসিন বানাতে এই দুই বিজ্ঞানীর কাজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তা বলে কোভিড ভ্যাকসিনের ধান ভানতে এসে সেই কবেকার বঞ্চনা আর উপেক্ষার গীত গাইতে বসা কেন? কারণ এতকিছুর পরেও পেনসিলভ্যানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাটালিনকে অধ্যাপক পদে ফিরিয়ে নিতে নারাজ, তাই ২০১৩ সালে তিনি চাকরি ছেড়ে একটি অখ্যাত কোম্পানির ভাইস প্রেসিডেন্টের পদে যোগ দেন। তাঁর সহকর্মীরা ঠাট্টা করে বলেন, “শেষে এমন কোম্পানিতে চললে যার নিজস্ব একটা ওয়েবসাইট পর্যন্ত নেই?” তবু ২০১৭ সালে সেই কোম্পানির বানানো mRNA-ভ্যাকসিন প্রাণঘাতী জিকা ভাইরাসের বিরুদ্ধে অভাবনীয় সাফল্য দেখায়। বিজ্ঞানমহলে পরিচিত নাম হয়ে ওঠে বায়োএনটেক (BioNTech)। অন্যদিকে, ল্যাংডন তাঁর আরও তিন সহকর্মীর সঙ্গে mRNA-থেরাপি নিয়ে কাজ করার উদ্দেশ্যে একটি কোম্পানি খোলেন যার মূল আইডিয়া সেই ক্যাটালিন আর ওয়াইজম্যানের প্রদর্শিত Modified RNA – এর থেকে আদ্যক্ষর নিয়েই তার নাম, মডার্না (Moderna)।
চেনা চেনা ঠেকলো বুঝি? আজ্ঞে হ্যাঁ, ফাইজার-বায়োএনটেক এবং মডার্না – এই দুই সংস্থার ভ্যাকসিন এই মুহূর্তের সবচাইতে দক্ষ দুই গ্ল্যাডিয়েটর। ব্রিটেন ও আমেরিকাসহ বেশ কিছু দেশে এই দুই ভ্যাকসিনের সর্বাত্মক প্রয়োগ শুরু হয়ে গেছে। শুরু হয়ে গেছে করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে তাদের মরণপণ লড়াই। ভ্যাকসিন যে সংস্থারই হোক না কেন, যতবার আপনি তার সাফল্য কামনায় কপালে হাত ঠেকাবেন, ততবার এমন অনেক ক্যাটালিনের দিনরাত এক করা পরিশ্রমের ঘাম, সমস্ত উপেক্ষার জবাবে হীরের দ্যুতি হয়ে জ্বলবে।
ঋণস্বীকারঃ
(১) The story of mRNA: How a once-dismissed idea became a leading technology in the Covid vaccine race, 2019, STAT news.
(২) Suppression of RNA recognition by Toll-like receptors: The impact of nucleoside modification and the evolutionary origin of RNA, 2005, Immunity.
(৩) Katalin Kariko, Wikipedia.