উত্তমকুমারের অভিনয়-শিক্ষক সন্তোষ সিংহ : এক বিস্মৃত অভিনেতা
'জয় বাবা ফেলুনাথ' সিনেমার প্রতিমাশিল্পী শশীবাবুকে মনে আছে? ছোট্ট অভিনয় কিন্তু সেটুকুতেই মনে দাগ রেখে যান বৃদ্ধ মানুষটি। এই শশীবাবু চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন সন্তোষ সিংহ। তাঁর ব্যক্তিগত জীবনও ছিল সিনেমার মতই বর্ণময়। এমনই সব ছোট-মাঝারি চরিত্রে অভিনয় করে মন কেড়ে ছিলেন দর্শকদের। কিন্তু কেবলই চলচ্চিত্রের ছোট ছোট পার্শ্বচরিত্রে অভিনয়ই তাঁর অভিনয় জীবনের একমাত্র পরিচয় ছিল না। রিল লাইফের পার্শ্ব চরিত্রের মতই তাঁর রিয়েল লাইফেও অনেক নায়ক চরিত্রের পাশে থেকে শিখিয়ে গেছেন অভিনয়ের খুঁটিনাটি। হ্যাঁ, তিনি কেবলমাত্র অভিনেতা না, একজন দক্ষ অভিনয়-শিক্ষকও ছিলেন। আর তাঁর ছাত্ররাও যে সে ছিলেন না। সেই তালিকায় ছিলেন স্বয়ং মহানায়ক উত্তম কুমার। 'ফ্লপ মাস্টার' থেকে 'মহানায়ক' - এই গোটা যাত্রাপথটায় উত্তমবাবুর পথপ্রদর্শক ছিলেন তাঁর মাস্টারমশাই সন্তোষ সিংহ। অরুণকুমার, যিনি আজকে মহানায়ক উত্তমকুমার হিসেবে পরিচিত, তাঁর অভিনয় জীবনের শুরুটা মোটেও মহানায়ক-সুলভ ছিলনা। প্রথম ছবি 'মায়াডোর' (অপ্রকাশিত), পরবর্তী ছবি দৃষ্টিদান এবং পর পর আরও কয়েকটি ছবির একটিও সাফল্যের মুখ দেখেনি।
আর ঠিক সেই সময়ই হঠাৎ একদিন তাঁর কাছে এম.পি. পিকচার্স কোম্পানিতে যোগ দেয়ার অনুরোধ জানিয়ে মুরলিধর চট্টোপাধ্যায়ের চিঠি আসে। সেখানেই তিনি শিক্ষক হিসেবে পান সন্তোষ সিংহকে। শুরু হয় সন্তোষ সিংহের কাছে তার চলচ্চিত্র জীবনের শিক্ষানবিশি। পরবর্তীকালে সন্তোষ সিংহই নায়ক হিসাবে উত্তমবাবুকে গণ্য করার অনুমতি পত্র দেন এম.পি. পিকচার্সকে। উত্তমকুমারকে অভিনয়ের খুঁটিনাটি শেখানোর সঙ্গে সঙ্গে প্রায় ৫৬ রকমের ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন শিখিয়েছিলেন সন্তোষবাবু। শুধুমাত্র চলচ্চিত্রে অভিনয়ই নয়, থিয়েটার ও স্টেজ শো-র যাবতীয় রকমফেরও উত্তমকুমার তাঁর কাছেই শেখেন। স্টার থিয়েটারে বিখ্যাত 'শ্যামলী' নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার আগেও উত্তমবাবু অভিনয়ের পাঠ নিয়েছিলেন সন্তোষবাবুর কাছেই।
নিজের অভিনয় জীবনে সন্তোষবাবু যেটুকু ছাপ রেখে গেছেন তা-ও অবশ্য মিলিয়ে যাবার নয়। কখনও 'ভগবান শ্রী কৃষ্ণচৈতন্য' চলচ্চিত্রে শোকাহত মায়াময় বৈষ্ণব পন্ডিত, কখনও 'জিঘাংসা'র মত সিনেমায় তাঁর দক্ষ অভিনয়, আবার কখনও 'পৃথিবী আমারে চায়', 'চন্দ্রনাথ', 'অভয়ের বিয়ে' ইত্যাদি ছবিতে তাঁর জোরালো উপস্থিতি আমাদের মন জয় করে নিয়েছে। রুপোলি পর্দার বাইরেও মঞ্চের অভিনয়ে তিনি ছিলেন সমান সাবলীল। স্টার, মিনার্ভা, রংমহল সব মঞ্চেই কাজ করে গেছেন তিনি। 'ক্ষুধা', 'আরোগ্য নিকেতন', 'চিরকুমার সভা', 'কর্ণার্জুন' - তাঁর প্রযোজিত এই প্রত্যেকটি নাটকই সাফল্যের সঙ্গে চলেছিল। অভিনয় ছাড়াও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যবিভাগে তিনি অধ্যাপনা করেছেন প্রায় ১২ বছর। অভিনয়ের জন্য সংগীত নাটক অকাডেমী থেকে তাঁকে পুরস্কৃত করা হয়েছে। সত্যজিৎ রায়ের 'জয় বাবা ফেলুনাথ' সিনেমায় অভিনয় করার পর তাঁর ডাক এসেছিল মৃণাল সেনের 'একদিন প্রতিদিন'- এ অভিনয়ের জন্য, কিন্তু শরীর সায় না দেওয়ায় তিনি রাজি হননি আর। দুবার নিজের নাট্যদলও খুলেছিলেন তিনি। একবার তুলসী চক্রবর্তীদের সঙ্গে 'রূপ মহল' আরেকবার দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে চিৎপুরে 'রঙ্গমহল'। কিন্তু শেষপর্যন্ত কোনটাই সফল হয়নি সেভাবে । অনেক সমালোচক মনে করেন তিনি ছিলেন অহীন্দ্র চৌধুরীর ডুপ্লিকেট। তাই সেই ছায়া কাটিয়ে হয়তো তিনি জায়গা করে নিতে পারেননি রুপোলি পর্দার সামনের সারিতে।
সন্তোষ সিংহ আজীবন পার্শ্ব চরিত্রেই অভিনয় করে গেছেন, কিন্তু সেই পাশের মানুষটি আগলে না রাখলে অনেক অভিনেতাই হোঁচট খেয়ে পড়তেন সেদিন।
........................
[ কভার ছবি: অন্তর্জাল]
#বাংলা #ফিচার #Silly পয়েন্ট #উত্তমকুমার #সন্তোষ সিংহ #অভিনয় #টলিউড #ছায়াছবি #জয় বাবা ফেলুনাথ #শশীবাবু #এম পি পিকচার্স #মুরলিধর চট্টোপাধ্যায় #শ্যামলী #ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য #জিঘাংসা #চন্দ্রনাথ #পৃথিবী আমারে চায় #অভয়ের বিয়ে #ক্ষুধা #আরোগ্য নিকেতন #চিরকুমার সভা #কর্ণার্জুন #রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় #একদিন প্রতিদিন #মৃণাল সেন #সত্যজিৎ রায় #তুলসী চক্রবর্তী #রূপমহল #দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় #রঙ্গমহল #অহীন্দ্র চৌধুরী #সবর্ণা চট্টোপাধ্যায়