বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

আপনি কি ঘুমোতে ভালোবাসেন?

সৌভিক সিনহা Jan 4, 2022 at 4:24 am বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

সারাদিনে অফিসের কাজের ফাঁকে দু-ফর্মার স্প্রেডশিটের কলাম জড়িয়ে যখন-তখন ঢুলে পড়েন অতিমাত্রিক ঘুমে? প্রেমিকের অনর্গল বকবকমে গ্র্যাভিটেশনের আদর টের পান চোখের পাতায়? অতি ধীর বাতিল প্রক্রিয়ায় মাথা ঝুঁকে পড়ে কি নিটোল ডায়াফ্রামে? যেমন-তেমন কথা বলতে গিয়ে কি জিভ জড়িয়ে কেমন-কেমন হয়ে যায়, পরি এসে ঘন চুলে চিরুনি চালায়? মনে রাখবেন বন্ধু, আপনি তবে একা নন। বরং আজকের রেসিপিতে স্রেফ ঘুমিয়ে ছাপান্ন ইঞ্চি ছাপানোর হদিস মিলতে পারে একখান, তবে তা পাঁচকান না করাই ভালো। দালি অবশ্য ঘুছিয়ে হাটে-বাজারে করেছেন ঘুম আর কৃষ্টির আঁতাত।

“50 Secrets of Magic Craftsmanship” বইতে সালভাদোর দালি জায়ান্ট ঘুম থেকে মাইক্রো ঘুম, সবরকম ঘুমের সঙ্গে শিল্পীর অন্তর্দৃষ্টির যোগাযোগের পথ বাতলেছেন। মাইক্রো ঘুম মানে ঐ ডায়াফ্রামে ঢলে পড়া আর কি, পার্থক্য কেবল ঘুমের উপর দালি সাহেবের নিয়ন্ত্রণ, যা আপনার নেই বলেই আপনি দালি হয়ে ওঠার সুযোগ ইঞ্চিখানেকে মিস করে গেছেন। এই মাইক্রো ঘুমের সময় দালি কাজের মাঝেই আরামকেদারায় মাথা এলিয়ে, হাতের মুঠোয় একটা চাবি রেখে, ঘুমিয়ে পড়বার তোড়জোড় করতেন। হাল্কা ঘুম ধরলেই হাত ফসকে চাবি গিয়ে পড়ত পায়ের কাছে রাখা পাত্রের উপর, আর সেই টং-ঠকাস-ঠকেই ঘুম যেত চটকে। দালি সাহেবের মতে, এই যে প্রায় আধা-সেকেন্ডের আধো-ঘুম, এতে নাকি অবচেতনে সজাগ থাকা অভিজ্ঞতাগুলো বিচিত্র অনুভূতি বা ইমেজ তৈরি করত। বলা বাহুল্য, সেই ইমেজই ক্যানভাসে উজাড় করে দিলে অবিনশ্বরতার ম্যাজিক তৈরি হয়। বেঞ্জিন রিং বলতে যে ষড়ভুজের মতো দেখতে রাসায়নিক যৌগ বেঞ্জিনের আকার বোঝায়, তার আবিষ্কারক অগস্ট কেকুলে নাকি আধা-ঘুমে একটা সাপকে নিজের লেজ নিজেই কামড়ে ধরতে দেখে বেঞ্জিন রিংয়ের ধারণা পান। লিওনার্দো-দা-ভিঞ্চিও নাকি মোনালিসা আঁকার সময় প্রতি চার ঘণ্টা অন্তর ২০ মিনিট করে ঘুমিয়ে নিতেন। থমাস আলভা এডিসন, যার একারই প্রায় ১১০০-এর কাছাকাছি পেটেন্ট করা আবিষ্কার রয়েছে, তিনি মনে করতেন ঘুমের মতো সময় নষ্ট করা বদভ্যাস আর কিছু নাই, তবে তিনিও হাতে বলজাতীয় বস্তু নিয়ে দালিমার্কা মাইক্রো ঘুম দিতেন নিয়মিত। এবং এদের সবার ক্ষেত্রেই একটি ব্যাপার সত্য, আধো-ঘুমে পাওয়া hypnagogic images বা অধচেতনলব্ধ অভিজ্ঞতাকে নিজ নিজ বিশালতায় একনিষ্ঠ স্থান দেওয়া। তবে এ সবই ঘুরেফিরে ঐতিহাসিক ফান ফ্যাক্টস, মাইক্রো ঘুমের আসল রহস্যের খানিক কিনারা করা গেছে Paris Brain University-এর গবেষক Delphine Oudiette ও তার সহকর্মীদের সাম্প্রতিক গবেষণার হাত ধরে। 

এই গবেষণার জন্য ১০৩ জন ভলান্টিয়ার জোগাড় করা হয়, যাদেরকে কিছু বিশেষ গাণিতিক সমস্যার সমাধান করতে দেওয়া হয় ও সমাধানের সুবিধার জন্য দুটো সহজ নিয়মও বাতলে দেওয়া হয়। সমাধানের আরেকটা গোপন উপায় থাকলেও তা অংশগ্রহণকারীদের জানানো হয় না। মোটামুটি কিছুটা শিখিয়ে পড়িয়ে নিয়ে গবেষণার প্রথম ধাপে ৩০ টা অঙ্কের সমধান করতে দেওয়া হয়, এবং এই ধাপেই ১০৩-এর মধ্যে ১৬ জন সমাধানের ঐ গোপন পদ্ধতিটা ধরে ফেলে। তাদেরকে আর বাকি গবেষণায় রাখা হয় না। বাকিদের এরপর একটা ২০ মিনিটের বিরতি দেওয়া হয়। এই বিরতিতে প্রত্যেক অংশগ্রহণকারীকে একটা আরামকেদারায় শুইয়ে এডিসনের মতো হাতে একটা বল দিয়ে বলা হয় চোখ বন্ধ করে বিশ্রাম নিতে, যাতে ঘুমিয়ে পড়লে বল হাত থেকে পড়ে ঘুম ভেঙে যায়, মানে ঐ মাইক্রো ঘুম পদ্ধতি আর কি! এই বিশ্রামের সময় অংশগ্রহণকারীরা ঘুমের ঠিক কোন ধাপে আছে তা বুঝতে পলিসমনোগ্রাফি নামে এক বিশেষ পদ্ধতির ব্যবহার করা হয়। 

হেঁটমুণ্ড, উর্ধনিতম্ব – তায় আবার ধাপ কি? আছে বইকি, আপনার পদ্মে আর হাতে ধাপ্পা থাকতে পারে, আর ঘুমের ধাপ থাকতে পারে না! আলবাৎ পারে। ঘুমের মোটামুটি চারটে ধাপ – প্রথম তিন ধাপ মিলে Non-rapid Eye Movement (NREM) sleep আর শেষপাতে গভীর ঘুম বা Rapid Eye Movement (REM) sleep। রাতে যখন আপনি ঘুমোন, এই চারটে ধাপই মিলে ঘুমের এক এক চক্রের ৪-৫ বার পুনরাবৃত্তি হয়। প্রথম ধাপে, মানে N1-এ আপনি ঘুম আর সজাগ অবস্থার মাঝামাঝি থাকেন, মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে বিরতির পথে হাঁটে, চোখের মণির নড়াচড়া থেকে শ্বাসপ্রশ্বাস আস্তে আস্তে কমে আসে। এই ধাপ মিনিট পাঁচ-দশেক স্থায়ী হয়। পরের ধাপ N2-তে শরীর কিছুটা ঠাণ্ডা হয়ে আসে, আর গোটা দিনে লব্ধ সমস্ত অভিজ্ঞতা বা স্মৃতির ঝাড়াই-বাছাই হয় মস্তিষ্কে। এই ধাপ স্থায়ী হয় মিনিট কুড়ি। N3-তে আপনার শিক্ষা-দীক্ষা থেকে শব্দকোষ, মানে ডিক্ল্যরেটিভ মেমোরির পরিচর্যা হয়, তার সাথে শারীরিক মেরামতির কাজও চলে। এই ধাপই গভীর ঘুমের সূচনা। N3 ধাপে যতক্ষণ সময় কাটাবেন, ঘুম ভেঙ্গে তত মুচমুচে বোধ করবেন। শেষ ধাপ মানে REM sleep-এ আপনার মস্তিষ্ক প্রায় জেগে থাকার সময়ের মতো সক্রিয় থাকে, আপনি আঁচিল-পাঁচিল স্বপ্ন দেখেন কিন্তু কিছু করতে পারেন না, কারণ সাময়িক পঙ্গুত্ব শরীর অবশ করে রাখে। ঘুমের চক্র শুরু হয় N1-এ, তারপর N2 হয়ে N3, আবার N2 হয়ে শেষে REM। এই REM ধাপে নতুন তথ্য মেমোরিতে গেঁথে দেওয়ার কাজ চলে, সুতরাং এই ধাপে ঘুমে গড়বড় হলে পরীক্ষায় গাড্ডু বাঁধা। 

আচ্ছা, অংশগ্রহণকারীদের বিশ্রাম এতক্ষণে খতম, এইবার গবেষণার দ্বিতীয় ধাপ। এই ধাপে ভলান্টিয়ারদের তিন ভাগে ভাগ করা হয় – যারা ২০ মিনিটে একবারও ঘুমায়নি, যারা ১ মিনিট মতো N1-এ কাটিয়েছে আর বাকি সময় জেগে, আর শেষ ভাগে যারা N1 পেরিয়ে N2 বা আরো গভীর ঘুম ঘুমিয়েছে। এই ধাপে যখন প্রত্যেককে আবার অঙ্ক কষতে দেওয়া হয়, তখন দেখা যায় N1 ঘুমধারীদের প্রায় ৮০% ঐ গোপন পদ্ধতি ধরে ফেলে, যেখানে জেগে থাকাদের ৩০% আর N2-দের মাত্র ১৫% এই সাফল্য পায়। আমাদের মগজের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে সারাক্ষণ ইলেকট্রিক্যাল সিগন্যাল ছোটাছুটি করছে, বিভিন্ন গতিতে। গতির উপর ভিত্তি করে এই সিগন্যালকে পাঁচরকমের ওয়েভে ভাগ করা হয়েছে, সবচেয়ে দ্রুত গতির গামা ওয়েভ থেকে সবচেয়ে শ্লথ ডেল্টা, আর মাঝমাঝি আলফা। গবেষকদল লক্ষ করেন, যে সমস্ত অংশগ্রহণকারীর মগজ মোটামুটি আলফা ওয়েভ তৈরী করেছে বিশ্রামের সময়, তারা সবচেয়ে তাড়াতাড়ি গোপন পদ্ধতিটা ধরে ফেলেছে, আর যারা যত বেশি ডেল্টা তৈরী করেছে, তারা সমাধানেও ততই শ্লথ হয়েছে। মজার ব্যাপার, N1 ধাপ হল মাঝারী পরিমাণ আলফা আর অল্প পরিমাণ ডেল্টার এক অদ্ভুত ককটেল, সেই কারণেই গভীর ঘুমে ঢলে না পড়ে যারা N1 ছুঁয়ে ফিরে এসেছে, তাদের ‘ইউরেকা’ মুহূর্ত খুঁজে পেতেও অসুবিধা হয়নি। তবে এই গবেষণা যেকোনো রকম ওয়েভ বা মগজস্থ তরঙ্গের সঙ্গে অন্তর্দৃষ্টির সরাসরি কোনো সম্পর্কের বিষয়ে তেমন কোনো দিশা দেয়না। তবুও, দালি থেকে দা-ভিঞ্চির ‘ইউরেকা’ মুহূর্তের রহস্যোদ্ঘাটনের দিকে এই কচি পদক্ষেপ আপন গুণেই আশাব্যঞ্জক।

তবে ঐ কথা রইল! ঘুমিয়ে যদি মুখ দিয়ে নাল পড়ে যায়, তবে সেই লালামথিত অন্তর্দৃষ্টি কিন্তু আপনাকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করা ছাড়া আর কোনো ইউরেকায় কাজে আসবেনা। আর যদি শুধু N1 মেরে আনতে পারেন, আপনার বস আপনার চামচা হয়ে পেছনে পেছনে ঘুরবে, পড়শিরা অটোগ্রাফের জন্য হ্যাঁচোড়-প্যাঁচোড় করবে, বন্ধুরা ঈর্ষায় গুটিয়ে কেন্নো হয়ে যাবে, আর আপনি স্রেফ বল হাতে মাঝে-মধ্যে মাইক্রো সাইজে নিদ্রা যাবেন।    


কৌতূহলী পাঠকের জন্য:

১। https://www.science.org/doi/10.1126/sciadv.abj5866

২। https://www.verywellhealth.com/the-four-stages-of-sleep-2795920

********************************************

প্রচ্ছদ ঋণ: দালি চিত্রিত Le Sommeil-এর প্রতিরূপ, ইন্টারনেট 

********************************************


#বিজ্ঞান #বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি #মাইক্রো ঘুম #ঘুম রহস্য #মানব মস্তিষ্ক #সৌভিক সিনহা #সিলি পয়েন্ট #ওয়েবজিন #বাংলা পোর্টাল #web portal

  • Arindam Dutta
    Jan 6, 2022 at 6:30 am

    Nije ghumiye pore agochalo bhabnaguloke guchiye goppo korar sujog kore dile, orai sholaporamorsho kore notun bhabna chintar kuthurir daar udghaton kore. Amra holam adhar, jekhane sristir upadan gulo bivinno bhabe binnosto hoi.

  • Arindam Dutta
    Jan 6, 2022 at 6:30 am

    Nije ghumiye pore agochalo bhabnaguloke guchiye goppo korar sujog kore dile, orai sholaporamorsho kore notun bhabna chintar kuthurir daar udghaton kore. Amra holam adhar, jekhane sristir upadan gulo bivinno bhabe binnosto hoi.

  • Sanjukta Basak
    Jan 4, 2022 at 7:07 am

    খুব ভালো লিখেছিস 😇

  • Sanjukta Basak
    Jan 4, 2022 at 7:07 am

    খুব ভালো লিখেছিস 😇

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

52

Unique Visitors

225548