নিবন্ধ

“সবাই ঘাতক আমরা, সবার পিঠেই গাঁথা ছুরি” – ব্রাত্য বসুর নাটক ‘সুপারি কিলার’

শ্রীজিতা হালদার Dec 19, 2020 at 6:11 am নিবন্ধ

.................................

                                        “Tell me tutor,’ I said, ‘Is revenge a science or an art?” –

                                          Mark Lawrence, Prince of Thorns (The Broken Empire, 1)


১৮৯০ সালে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের ‘বিসর্জন’ নাটকে রঘুপতি রাজহত্যার সপক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে জয়সিংহকে বুঝিয়েছিলেন “এ জগৎ মহা হত্যাশালা।” আর দু-শতকেরও বেশি সময় পেরিয়ে এসে ২০১১ সালে প্রকাশিত ব্রাত্য বসুর নাটক ‘সুপারি কিলার’ শুধু পরহত্যার যুক্তি-অযুক্তির কথা বলে না, আত্মহননেচ্ছার মত কূট প্রশ্ন নিয়েও খেলতে হয় তাকে। কারণ এটা একুশ শতক। হত্যা আর আত্মহত্যার পরিসংখ্যান এখন পাল্লা দেয়। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং-এ অজস্র মানুষের সঙ্গে সংযুক্ত থাকা সত্ত্বেও প্রতিদিন আরও আরও বেশি একা হয়ে যাচ্ছে মানুষ। পরিবারপিছু অন্তত একজন করে প্রায়শই কোনও না কোনও মানসিক সমস্যার শিকার। 

বিশ্বায়ন-উত্তর সময়ের একজন শ্রেষ্ঠ রূপকার ব্রাত্য বসু। যে সময় প্রতিনিয়ত ঝাঁপিয়ে পড়ছে আমাদের ওপর, অথচ যে সময়কে সম্যক বুঝে নিতে কেবলই দেরি হয়ে যাচ্ছে আমাদের – সেই অস্থির, ক্ষয়িষ্ণু, শ্বাসরোধকারী সময়ের রূপকার তিনি। ভোগসর্বস্ব, মূল্যবোধহীন, পণ্যপীড়িত আধুনিক যুগের সংকটকে বাংলা ভাষায় সবচেয়ে বিশ্বস্তভাবে রূপায়িত করতে পেরেছেন যে অল্প কয়েকজন সাহিত্যিক, ব্রাত্য বসু তাঁদের মধ্যে অন্যতম। সেই ধাবমান, গর্জনশীল, নিরবলম্ব সমকাল তার সমস্ত কৌতুক, সমস্ত দীর্ঘশ্বাস, সমস্ত সর্বনাশ নিয়ে এসে দাঁড়ায় আমাদের আলোচ্য ‘সুপারি কিলার’ নাটকেও। 

এ নাটক শুধু প্রতিশোধের নাটক নয়, নিছক আত্মহত্যাকামী একজন মানুষের গল্পও নয়। এ নাটক আসলে আত্মজিজ্ঞাসার নাটক। কোয়েন্তিন তারান্তিনোর বিখ্যাত ‘Kill Bill’ ছবিটির কথা যারা জানেন, তাঁদের মনে পড়বে ছবির শুরুতে পরিচালক একটি প্রাচীন আফ্রিকান প্রবাদ ব্যবহার করেছিলেন। “Revenge is a dish best served cold.” একজন ধ্বস্ত নারী তিলেতিলে নিজেকে প্রস্তুত করেছিল প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য। প্রবল জিঘাংসায় একে একে শেষ করেছিল সমস্ত শত্রুকে। কিন্তু শেষ শত্রুকে মারার ঠিক পরেই তার মনে হয়েছিল জীবনের আর কোনও উদ্দেশ্য নেই। ‘সুপারি কিলার’ নাটকে আমরা দেখি দময়ন্তী সুপারি কিলার র‍্যাঞ্চোর সঙ্গে তিনটি হত্যাকর্মের চুক্তি করে। প্রথম দুজনকে মারার পর দময়ন্তী জানায় তৃতীয়জন সে নিজেই। ‘Kill Bill’ ছবির নায়িকার মত সে-ও প্রতিশোধকেই জীবনের একতম উদ্দেশ্য করে ফেলেছিল। তফাৎ হল, ছবির নায়িকা নিজের মেয়েকে ফিরে পেয়ে বাঁচার উদ্দেশ্য ফিরে পেয়েছিল। আর দময়ন্তীকে বাঁচার উদ্দেশ্য ফিরিয়ে দিয়েছিল সুপারি কিলার র‍্যাঞ্চো। তফাৎ আরও একটা জায়গায়। তারান্তিনো অস্তিত্ববাদী প্রশ্ন নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাননি, কিন্তু ব্রাত্যর নাটকে প্রতিশোধের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে জীবনের সংকট। তারান্তিনো মূলত ভিস্যুয়াল এবং স্টাইলাইজেশনে মনোনিবেশ করেছেন। পক্ষান্তরে, মূল প্লটের অনেক গভীরে নেমে খনন চালিয়েছেন ব্রাত্য।  

দময়ন্তীর সঙ্গে র‍্যাঞ্চোর কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে একুশ শতকের মানুষের দমবন্ধ করা একাকিত্ব আর বিচ্ছিন্নতার মুখ উঁকি মারে। দময়ন্তীর ভিতরের ভাঙাচোরার জ্যামিতি বড় চেনা লাগে আমাদের। তার জীবনের দুজন শত্রুকে মারার পর র‍্যাঞ্চোকে সে জানায় যে তিন নম্বর টার্গেট সে নিজে। কারণ, জীবন থেকে তার আর কিছুই পাওয়ার নেই। এই দুজনের প্রতি এক তীব্র প্রতিশোধস্পৃহাই তাকে এতদিন বাঁচিয়ে রেখেছিল। প্রতিশোধ নেওয়া হয়ে যাওয়ার পর বাঁচার আর কী মানে! আর তো কোনও সম্বলই ছিল না তার।  

কিন্তু র‍্যাঞ্চো জানে সে যে আজ বেঁচে আছে, সেটা তার ভাগ্য ছাড়া আর কিছুই না। আজ সে অন্যদের দিকে বন্দুক তাক করতে পারছে। হয়তো কালকেই অন্য কেউ তার দিকে বন্দুক তাক করবে। তাই বেঁচে থাকা নিয়ে র‍্যাঞ্চো কোনও প্রশ্ন করতে চায় না। সে জানে জীবন প্রবল অনিশ্চিত। তবু তো জীবন। যে কটা দিন বাঁচা যায় প্রাণপণে জীবনকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে হবে। হয়তো কিছুই পাওয়ার নেই তবু কোনও মূল্যেই জীবনকে ছাড়তে নেই। দময়ন্তীকে এটাই বোঝাবার চেষ্টা করেছিল সে। 

‘প্রতিদিন’ সংবাদপত্রের ৬ নভেম্বর ২০১১ সংখ্যায় ‘আমরা একইসঙ্গে হত ও হন্তারক’ নামে একটি লেখায় ব্রাত্য এই নাটক প্রসঙ্গে যা লেখেন তা খুবই প্রণিধানযোগ্য - “নাটক লিখতে গিয়ে কোনো একটা খোপে আটকে পড়ায় আমি বিশ্বাস করি না। বাস্তবতাকে সবাই যেভাবে দেখতে অভ্যস্ত, তাকে অন্য কোনো দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায় কিনা, তা নিয়ে বরাবরই আমি ভেবেছি। লুকিয়ে থাকা প্রশ্নকে খুঁজে বের করা, যে ফর্মে বাস্তবতাকে দেখছি, তাকে ভেঙে অন্য ফর্ম দেওয়া- এভাবেই সবসময় অন্য নাট্যভাষার খোঁজ করেছি। সেই ধারাবাহিকতারই একটা মুহূর্ত ‘সুপারি কিলার’। আসলে আমাদের সকলের মধ্যেই এক সুপারি কিলার আছে, আবার একইসঙ্গে যে খুন হচ্ছে সে-ও আছে। এটা একটা দমবন্ধ করা পরিস্থিতি। আমরা এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি।… কোনো খুনই বৈধ হতে পারে না। খুন এমন এক সিদ্ধান্ত, যার মধ্যে রয়ে গেছে স্নায়ুহীনতা। যেমন কামুর ‘দ্য স্ট্রেঞ্জার’-এর নায়ক মারসো খুন করে ওই স্নায়ুহীনতা থেকেই। যেমন কিয়েসলস্কির ‘আ শর্টফিল্ম অ্যাবাউট কিলিং’-এ ছেলেটি কেন ট্যাক্সি-ড্রাইভারকে খুন করে অর্থাৎ মৃত্যুদণ্ড দেয়, তাও এক স্নায়ুহীনতারই পরিচয়। ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’-এ রাসকলনিকভের খুনেরও কোনো বৈধতা নেই। কোনো খুনই বৈধ নয়। তবু এরই মধ্যে আমরা বাঁচি। একই সঙ্গে হত এবং হন্তারক হয়ে বেঁচে থাকি। ‘সুপারি কিলার’ এই নির্মম ও অসহায় সত্তাকেই ছুঁতে চেয়েছে।”  

কিন্তু ব্রাত্য এই ক্ষয়ের গল্পে থেমে যান না। দময়ন্তী নাটকের শেষে নিজেকে হত্যা করতে চায় আর র‍্যাঞ্চো তাকে ফিরিয়ে আনে। ফিরিয়ে আনে চলমান জীবনের ভিতর। যেখানে প্রত্যেকটা মুহূর্তে বেঁচে থাকার উত্তেজনা আর মৃত্যুকে প্রতিহত করা, স্থগিত করে চলা। এই নাটক মৃত্যুর ভিতর দিয়ে হয়ে ওঠে জীবনকে জয় করার নাটক। পাঠক বা দর্শকের মনে পড়বে সেই দৃশ্যটি যেখানে মৃত্যু এসে বলডান্স করে র‍্যাঞ্চোর সঙ্গে।  

অস্তিত্ববাদী একটা ঝোঁক ব্রাত্যর লেখার মধ্যে বরাবর আছে একথা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু সেটাকে ছাপিয়ে জীবনের কথা বলতে ভালোবাসেন ব্রাত্য। তিমিরবিলাস নয়, তিমিরবিনাশের নাটককার তিনি। রবিশংকর বলকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ব্রাত্য বলেছেন- “জীবনের যে নানারকম স্মৃতি মানুষ বহন করে, সেটা কখনও ওই হিউ ওয়ালাপাল যেটা বলেছিলেন- লাইফ হ্যাজ আ ট্র্যাজেডি হু ক্যান ফিল। তাই চিন্তা আর অনুভব, এই দুয়ের মধ্য দিয়েই এমন একটা বয়ান হয়তো গড়ে উঠবে। সেটা আমার নাটকে বারবার এসেছে।” 

অন্যান্য সাহিত্য সংরূপের থেকে নাটক এখানেই অনেকটা চ্যালেঞ্জিং যে তাকে মঞ্চোপযোগীও হতে হয়। নাটকের পক্ষে আরও বেশি করে জরুরি জীবনের আঁকাড়া বাস্তবের সঙ্গে সংলগ্ন হয়ে থাকা। সাধারণত পাঠমূল্যের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ তার মঞ্চভাষ্য। ব্রাত্য কিন্তু সেই বিরল জাতের নাটককার, যাঁর নাটকের পাঠমূল্য অপরিসীম। ব্রাত্যর ভিতর আক্ষরিক অর্থেই একজন কবি বাস করেন, একথা বলেছেন জয় গোস্বামী। আর ‘ব্রাত্য ভার্সেস ব্রাত্য’ শীর্ষক প্রবন্ধে কবি সুবোধ সরকার ব্রাত্য বসু সম্পর্কে বলেন- “ব্রাত্যকে আমি গত আঠারো বছর একটা উপত্যকার নাগরিক হিসেবে দেখে এলাম। উপত্যকা? না একটি ডিসকমফোর্ট জোন? একটা মানুষের ওপর যখন জ্যোৎস্না এসে পড়ে তখন শুধু তার মুখটুকু মায়াময় হয়ে ওঠে না, জ্যোৎস্না তার আধার কার্ডেও এসে পড়ে, চলকে যায়। ব্রাত্য বাইরে যতটা লজিক্যাল, ভেতরে ততটাই উপদ্রুত। সেখানে নাটকটাকে এগিয়ে নিয়ে যান। এখানেই ব্রাত্য বাংলা নাটকের নতুন পরিত্রাতা। আমরা একটা মানুষের তত্ত্ব দেখি, জাত দেখি, ধর্ম দেখি, এথনিসিটি দেখি, তার উপদ্রুত উপত্যকা লক্ষ করিনা। বিকেলবেলার ব্রাত্য আর সন্ধেবেলার ব্রাত্যর মধ্যে একটা বিনাশকারী গোধূলির জন্ম হয়, ব্রাত্য সেই গোধূলিকে আবিষ্কার করেন, নির্মাণ করেন, বন্দনা করেন এবং শেষে তাকে অগ্রাহ্য করে সিঁড়ি দিয়ে উঠে যান রাত্রি প্রহরের দিকে। তাঁর নাটক হয়ে ওঠে ‘প্রহর পুঁথি’, সেই অমোঘ শব্দবিন্যাস যে কথাটা বুদ্ধদেব বসু ব্যবহার করেছিলেন একদিন। একই মানুষের ভিতর যে লুকিয়ে লুকিয়ে রয়েছে বিষমাখা তির আর বিশল্যকরণী, সেটা ব্রাত্যর নাটক যতটা ধরতে পেরেছে (না পারলে তার শো হাউসফুল হতো না, মন্ত্রী হিসেবে একদিন দুদিন হাউসফুল করানো যায়, রোজ করানো যায় না) ততটা আমাদের সাম্প্রতিক গল্প-উপন্যাস করাতে পারেনি।” হয়তো বা এটাই নাটককার ব্রাত্য বিষয়ে শ্রেষ্ঠ মূল্যায়ন।  


* [শিরোনামের উদ্ধৃত অংশটি কবি হিমালয় জানার একটি কবিতা থেকে নেওয়া] 


[ছবি : প্রাচ্য নাট্যদলের প্রযোজনায় বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় 'সুপারি কিলার' নাটকের একটি দৃশ্যে সুপ্রিয় দত্ত ও পৌলমী বসু। ছবিটি আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত ব্রাত্য বসুর নাটকসমগ্র - ৩ থেকে নেওয়া] 


#সুপারি কিলার #ব্রাত্য বসু #নাটক #Play #Bratya Basu #সুপ্রিয় দত্ত #পৌলমী বসু #প্রাচ্য #বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায়

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

62

Unique Visitors

184129